পুতিনের দৃষ্টিতে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর তার দেশের মর্যাদা কমার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ফের ইঙ্গিত দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ করার চেয়ে রাশিয়ার হারানো কোল্ড ওয়ার সময়কালের মর্যাদা ফেরানোর দিকেই তার বেশি মনোযোগও আকৃষ্ট হয়েছে বিশ্বজুড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় শুক্রবারের (১৫ আগস্ট) ওই শীর্ষ সম্মেলনে পুতিনের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে নিবন্ধ লিখেছেন অ্যান্ড্রু হিগিন্স। মস্কোর এই সাবেক সংবাদদাতা এখন পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ থেকে রিপোর্টিং করেন। ভিউজ বাংলাদেশ-এর পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটির সারমর্ম তুলে ধরা হলো:
আলাস্কার সাম্প্রতিক বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ ও ল্যান্ড সোয়াপ। সবকিছু ছাপিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, ‘ইউক্রেনকে ঘিরে পরিস্থিতি’। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ করার চেয়ে রাশিয়ার হারানো মর্যাদা ফেরাতে বেশি মনোযোগী তিনি। পুতিন অবশ্য আগে যা বলেছিলেন এবারও তারই পুনরাবৃত্তি করলেন।
২০০৭ সালে মিউনিখের নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রথমবারের মতো একই ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভ্লাদিমির পুতিন। ক্ষোভের বশেই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলা চালায় রাশিয়া। সেসব ইতিবৃত্ত ফের তুলে ধরে সম্মেলনের পর পুতিনের মন্তব্য ছিল, ‘ইউরোপসহ পুরো বিশ্বে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ন্যায্য ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করতে হবে।’
পুতিন বলেন, এর মাধ্যমেই কেবল ‘এই সংকটের মূল কারণ’ দূর হবে। এটি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপে মস্কোর প্রভাব কমে যাওয়া সম্পর্কিত। সরাসরি যুদ্ধের উল্লেখ না করেই পুতিন শুধু বলেন, ‘যা হচ্ছে তা থামাতে আন্তরিকভাবে আগ্রহী’, কারণ, রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয়দের ‘মূল একই’ এবং ‘আমাদের জন্য এটি একটি ট্র্যাজেডি ও বড় দুঃখ।’
যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, সেখানে রাশিয়াকে শিকার হিসেবে দেখানোকে ক্রেমলিন প্রোপাগান্ডার প্রধান কৌশল হিসেবেই পুতিনের বক্তব্যের মূলসূত্র বলে মনে করা হচ্ছে। লিথুনিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লরিনাস কাশিউনাস তাই বলেন, ‘পুতিন ও রাশিয়া সংস্কারবাদী, তারা কোল্ড ওয়ারে হার মেনে নিতে পারে না।’ ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল লিথুনিয়া, যেটি পরে ন্যাটোতে যোগ দেয়। পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়াসহ মস্কোর প্রাক্তন সামরিক জোট ওয়ারসা চুক্তির অন্য সদস্যরাও এখন ন্যাটোতে।
কাশিউনাস আরও বলেন, পুতিন কখনো যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন না। বরং ‘ইউক্রেনকে ঘিরে পরিস্থিতি’ বলেন, যেন ‘সবকিছুকে পশ্চিমাদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখানো যায়, যেখানে ইউক্রেন কেবল হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।’
কিন্তু পুতিন-ট্রাম্প বৈঠকের ঠিক আগে ভিস্টুলা নদীর তীরে ট্যাংক ও অন্য সামরিক সরঞ্জাম প্রদর্শন করে পোল্যান্ড মস্কোকে স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘পুরোনো বিশ্বের সময়কাল শেষ।’
সম্মেলনের পর ফক্স নিউজের শোন হ্যানিটিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার বিশ্বজুড়ে অবস্থানকে অবশ্য আরও বড় করে দেখিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে উপেক্ষা করে তিনি বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বের ১ নম্বর এবং তারা ২ নম্বর।’
আলাস্কায় পুতিনকে যেভাবে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন ট্রাম্প, তাকে রাশিয়ার সাফল্য হিসেবেই দেখছেন ক্রেমলিন-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া। এটিকে রাশিয়ার ফের মর্যাদাপূর্ণ জাতির দলে স্বীকৃতি পাওয়া হিসেবে উদযাপন করছেন দেশটির জাতীয়তাবাদী বিশ্লেষকরাও।
জ্যোতির্বিদ্যাগত তত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার দুগিন টেলিগ্রামে বলেন, ‘আমি এতো ভালো ফলাফলের আশা করিনি। আমি সবাইকে চমৎকার সম্মেলনের জন্য অভিনন্দন জানাই। এটা ছিল অসাধারণ।’
জাতীয়তাবাদী সিনেটর আন্দ্রেই ক্লিশাস বলেন, সম্মেলনটি রাশিয়ার ‘দীর্ঘমেয়াদি ও ন্যায্য শান্তির ইচ্ছা’ নিশ্চিত করেছে এবং দেশটিকে বিশেষ সামরিক অভিযান চালানোর স্বাধীনতা দিয়েছে। তিনি আরও যোগ করেন, ‘ইউরোপীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার নতুন স্থাপত্য সূচিতে রয়েছে এবং সবাইকে এটি মেনে নিতে হবে।’
বিশ্ব সম্প্রদায় নিশ্চিত নয় যে, এই নতুন স্থাপত্য কেমন হবে। তবে পুতিনের বক্তব্যের মূল স্তম্ভ হলো, রাশিয়াকে কোল্ড ওয়ারের সময়কার অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যা দেশটিকে আঞ্চলিক নেতা ও বিশ্বশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।
২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলার আগে রাশিয়া ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তাবনা পাঠায়, যেন সামরিক জোটটি পূর্ব ইউরোপ থেকে সরে আসে এবং ইউক্রেন কখনো তাতে যোগ দিতে না পারে। এই দাবি দ্রুত প্রত্যাখ্যাত হলে পুতিন টেলিভিশন ভাষণে হামলার ঘোষণা দেয়ার সময় ইউক্রেনের বদলে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে দমনমূলক আচরণ এবং রাশিয়ার বৈধ স্বার্থ ও মর্যাদাকে অবজ্ঞা করার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘গত ৩০ বছরে আমরা ইউরোপে সমান ও অখণ্ড নিরাপত্তার নীতিতে ন্যাটোর প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে ধৈর্য ধরেছি। আমাদের প্রস্তাবে, আমরা প্রায়শই মুখোশধারী প্রতারণা ও চাপের মুখোমুখি হয়েছি। পাশাপাশি নর্থ আটলান্টিক জোটটিও আমাদের প্রতিবাদ ও উদ্বেগ উপেক্ষা করে সম্প্রসারিত হয়েছে।’
পুতিনের কোল্ড ওয়ার পরবর্তী বিশ্বের পুনর্গঠন প্রচেষ্টার মূল অংশ হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ককে দুর্বল বা ধ্বংস করা। তবে ইউক্রেনে হামলা ব্যর্থ হয়েছে, রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর উপস্থিতিও বেড়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে ৮৩০ মাইল সীমান্ত থাকা ফিনল্যান্ড, এমনকি সুইডেনও যুদ্ধ শুরুর পর পরই ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে।
ইউক্রেনকে সমর্থনের লক্ষ্যে কয়েক মাস ধরে উত্তপ্ত ও ঠান্ডা মাথায় কাজ করেছেন ট্রাম্প। আলাস্কায় শীর্ষ সম্মেলনের আগেই জরুরি যুদ্ধবিরতি নিশ্চিতের বদলে ইউক্রেনকে ব্যাপক শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরে পুতিনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে জোটে বিভেদের বীজও বপন করেছেন তিনি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রতি বেশ শীতল মনোভাব দেখিয়েছেন ইউরোপের নেতারা। কারণ, তারা আগেও অনেকবার দেখেছেন, পুতিনের সঙ্গে কথা বলার পর ইউক্রেন সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত বদলে দেন ট্রাম্প।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে