আমাদের মাহফুজা আপা, স্মৃতিতে-স্মরণে
এ লেখা যখন লিখছি, তখন এ কথাই সত্য যে, আমাদের শ্রদ্ধেয় মাহফুজা খানম আপা নিরন্তরের পথে যাত্রা করেছেন। জন্ম নিলে মরতে হবে- এটাই সত্যি; কিন্তু কিছু মানুষ জন্ম নিয়ে শুধু ঘরে বসে থাকেন না। তারা তাদের কাজ দিয়ে দাগ রেখে যান। যে দাগের কারণে তাকে মনে রাখতেই হয়।
মাহফুজা আপার মৃত্যুর খবর পেয়ে একটি বিষয়ের জন্য কষ্ট পাচ্ছি। ইন্দিরা রোডের এই বাসাটা অজস্র মানুষের ভরসার জায়গা ছিল। যে কেউ কোনো কাজ নিয়ে গেলে তিনি সাধ্যমতো সাহায্য করতেন। এ কারণে অনেকেই তাকে ‘মা’ বলে ডাকতেন। তার একরোখা স্বভাবের জন্য অনেকে যে কষ্ট পেতেন না, তা নয়! কিন্তু সবকিছুর পরেও তিনি যেটা বুঝতেন তার বাইরে যেতেন না।
আমার মনে আছে, মাহফুজা আপার স্বামী সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের কাছে একটা কাজের জন্য যেতে হবে; কিন্তু ব্যারিস্টার সফিক সাহেবের কাছে পৌঁছাব কী করে? আমার মাথায় এলো মাহফুজা আপার কথা। তার কাছে গেলে, তিনি বললেন, ‘আমি বলে রেডি করে তোমাকে সময় বলে দেব।’ এই মানসিকতার মানুষ ছিলেন তিনি।
মাহফুজা আপা ২০১৫ সালে তার লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ছাত্র রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ আগে ও পরে’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি ৫৫ বছর ধরে কোনো না কোনোভাবে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত।’ এটা এখন আর কে বলে। আমৃত্যু তিনি এই আদর্শে থেকেছেন ও হৃদয়ে লালন করেছেন।
সবশেষে শিশু-কিশোর সংগঠনের সভাপতি ছিলেন তিনি। ছাত্র ইউনিয়ন করা, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি লক্ষ্য করা যায় তার লেখা- ‘ছাত্র রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ আগে ও পরে’ বইটি পড়লে। এই বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৫৯ সাল আমি তখন বাংলাবাজার গার্লস হাই স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্রী।
আমাদের স্কুলের পাশেই ছিল খ্রিষ্টান মিশনারি ছাত্রদের একটি হোস্টেল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক প্রচারিত ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কিছু লিফলেট দিয়ে গেল ওই হোস্টেলের কিছু ছাত্র। সেই প্রথম ‘ছাত্র ইউনিয়ন’ নামের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এরপর থেকে গত ৫৫ বছর আমি কমবেশি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত।’
মাহফুজা খানম ১৯৪৬ সালের ১৪ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক এবং ১৯৬৭ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের লেখাপড়ার সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন তিনি। পেশাগত জীবনে মাহফুজা খানম বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। মাহফুজা বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর আসরের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় ২০২১ সালে একুশে পদক পান অধ্যাপক মাহফুজা। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনের বহু আগে থেকেই পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন, শোষণমুক্তির আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। দেশপ্রেমের জারক রসে জারিত এই সংগ্রামীর মৃত্যু নেই। মাহফুজা আপাকে লাল সালাম।
দীপংকর গৌতম: লেখক ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে