বিজয়নগরে গুলিবিদ্ধ ওসমান হাদি: উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার একটি দিন
রাজধানীর বিজয়নগরে নির্বাচনি গণসংযোগে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। এই হামলার পর পরেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে তাকে স্থানান্তরিত করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বুলেটে হাদির মাথার এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে যা অত্যন্ত জটিল ও জীবননাশী আঘাত হিসেবে বিবেচিত।
এই হামলাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি উঠেছে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার এই দিনটি নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশ এর বিস্তারিত প্রতিবেদন।
অপারেশনের সময় দুইবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, প্রচুর রক্তক্ষরণ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও হাদির চিকিৎসকদের একজন ডা. সুমন রানা জানিয়েছেন, হাদির আঘাতটি জীবননাশী।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরেক চিকিৎসক ডা. জাহিদ রায়হান জানান, দীর্ঘ ও জটিল অস্ত্রোপচারের সময় হাদির দুইবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। পাশাপাশি তীব্র রক্তক্ষরণের কারণে নাক ও মুখ দিয়েও রক্ত বের হতে থাকে, যার ফলে পরিস্থিতি একেবারেই সংকটাপন্ন।
তিনি বলেন 'এই মুহূর্তে কন্ডিশন খুবই খারাপ। ক্রিটিক্যাল বলতে যা বোঝায় তাই। আমরা রোগীর বিষয়ে কোনো আশার কথা বলব না, তবে তিনি এখনো বেঁচে আছেন। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আবু জাফর বলেন, হাদির ব্রেনের অবস্থা ছিল— গুলি কানের ডান দিক দিয়ে ঢুকে বাম দিয়ে বের হয়ে গেছে। বুলেট ইনজুরি হচ্ছে— যেদিক দিয়ে ঢুকে সেদিক ছোট, যেদিক দিয়ে বের হয়, সেখানে বড় ইনজুরি হয়, সেটাই হয়েছে। ব্রেন ইনজুরি হচ্ছে, ব্রেন ফুলে ফেঁপে যায়, প্রেশার বেড়ে যায়। এটা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এটা যেন না হয়, এজন্য নিউরো সার্জনরা যারা ছিলেন, ডা. জাহিদ রায়হান ও তার টিমরা ব্রেনের খুলিটা বড় করে খুলে দিয়েছে, যেন প্রেশার না বাড়ে।
স্বাস্থ্যের ডিজি বলেন, কিছু রক্তক্ষরণ হচ্ছিল নাক ও গলা দিয়ে। সেটা নাক-গলার চিকিৎসকেরা ঠিক করে দিয়েছেন। আমাদের সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত ছিল তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে চাচ্ছিল এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আমরা এভারকেয়ার হাসপাতালে যোগাযোগ করে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি।
এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর
ঢামেকে অস্ত্রোপচারের প্রথম ধাপ শেষ হলেও অবস্থার দ্রুত অবনতি ও ক্রমাগত রক্তক্ষরণের কারণে সন্ধ্যার দিকে ওসমান হাদিকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
চিকিৎসকরা জানান, মাথার ভেতর ব্যাপক ক্ষত এবং কার্ডিয়াক জটিলতার কারণে হাদির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক—পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ।
যেভাবে হামলার শিকার হাদি
রিকশাযোগে জুমার নামাজের পর নির্বাচনী প্রচার কাজে বের হয় হাদি। বিজয়নগর গেলে সেখানে মোটরসাইকেলে করে আসা দুইজনের মধ্যে থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালায়। ইনকিলাব মঞ্চের একজন সদস্য দাবি করেন, সন্দেহভাজন দুই ব্যক্তি প্রায় দুই সপ্তাহ আগে হাদির নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত হয়েছিলেন এবং কিছুদিন নিখোঁজ থাকার পর আবারও দলের কাজে যোগ দেন।
ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, মোটরসাইকেলে করে আসা দুইজনের মধ্যে একজন ওসমান হাদির মাথায় গুলি চালায়। 'এই দুইজন হঠাৎ প্রচার দলে যোগ দেন, মাঝখানে দেখা যায়নি—তারপর আবার ফিরেই আজকের ঘটনার কিছুটা আগে থেকেই দলের কাজে যুক্ত হন।'
ভিডিও সংগ্রহ ও তদন্ত
ঘটনার পরপরই পুলিশ ও র্যাব ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই কর্মকর্তা জানান, সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এখনো কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্দেহভাজন হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি।
ইনকিলাব মঞ্চের প্রতিক্রিয়া
ইনকিলাব মঞ্চের সেক্রেটারি ও হাদির জনসংযোগ টিমের প্রধান আব্দুল্লাহ আল জাবের বলেন, 'ঘটনার সময় হাদির সাথে থাকা দুইজন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাই পুরো ঘটনাটি তারা স্পষ্টভাবে বলতে পারছে না।'
তিনি জানান, যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে, তারা হয়তো হাদির রাজনৈতিক বক্তব্যের বিরোধিতায় কিংবা নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে তাকে ‘হুমকি’ মনে করে হামলা চালাতে পারে। সংগঠনটির হাতে থাকা ভিডিও ফুটেজ থেকে শনাক্তকরণের আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের গভীর উদ্বেগ
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এক বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচনী পরিবেশে এমন সহিংসতা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। তিনি অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্রুত ও ব্যাপক তদন্তের নির্দেশ দেন এবং হাদির সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে নির্দেশ প্রদান করেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিক্রিয়া
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো স্থান নেই। এ ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই।'
জামায়াত আমির শফিকুর রহমান দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানান।
এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ পোস্টে লেখেন, 'আল্লাহ আমার ভাইকে বাঁচাইয়া রাখো।'
রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য আদীব মন্তব্য করেন, 'জান দেব তবু জুলাই দেব না — ওসমান হাদি।'
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী এ ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সদ্য সাবেক উপদেষ্টা আসিফমাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, 'হাদি ভাই গুলিবিদ্ধহয়েছেন। বেঁচে থাকুন, আমাদের মাঝে ফিরেআসুন- এই দোয়া করুন সবাই।'
তিনি বলেন, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যইআইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জাতীয়নির্বাচনের তফশিলের পরপরই এরকম ঘটনাঅশনিসংকেত। দ্রুত সময়ের মধ্যে জড়িতদেরগ্রেফতার করুন।
আলোচিত হাদি
জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশে আলোচিত চরিত্র শরিফ ওসমান হাদি।
মাদ্রাসার শিক্ষকের ছেলে হাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে পড়াশোনা করেন নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করার পর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন তিনি।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে আলোচনায় আসেন হাদি। সাংস্কৃতিক এই প্ল্যাটফর্ম তাদের লক্ষ্য ঠিক করে—‘সমস্ত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ’। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়েই একটি সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তোলেন তিনি।
সে প্রথম থেকেই রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ এবং আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙায়ও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি।
নভেম্বরে ওসমান হাদি নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে দাবি করেন, দেশি–বিদেশি অন্তত ৩০টি ফোন নম্বর থেকে তাঁকে ফোন ও মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে; তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়া, তাঁর মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে