গণঅভ্যুত্থানের এক বছর: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ
এক বছর আগে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেন ভারতে। সেই উত্তাল দিনগুলোতে দেশের রাস্তায় গর্জে ওঠা স্লোগান ছিল—‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র চাই’, ‘সবার জন্য সমান অধিকার চাই।’ ঠিক তিন দিন পর, ৮ আগস্ট নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তবে গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয়ের যে স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল, সেই স্বপ্ন আজ চরম হতাশায় নিমজ্জিত। ক্ষমতা হস্তান্তরের এক বছর পূর্ণ হলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বরং অপরাধের বিস্তার ও সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এক বছরের চিত্র: খুন, ধর্ষণ, মব সহিংসতার লাগামহীনতা
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সারা দেশে খুনের মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৫৫৪টি, ধর্ষণ মামলা ৪ হাজার ১০৫টি, ডাকাতির মামলা ৬১০টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ১২ হাজার ৭২৬টি এবং অপহরণের মামলা ৮১৯টি। উদ্বেগের বিষয় হলো, শুধু পুলিশ আক্রান্তের ঘটনায়ই মামলা হয়েছে ৪৭৯টি।
অবস্থার ভয়াবহতা এখানেই শেষ নয়। এই সময়ে সারা দেশে মব সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৬৩৭ জন, যার মধ্যে ৪১ জনই পুলিশ সদস্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সংকটকে স্পষ্ট করছে।
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা: ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র’ স্বপ্নে ধাক্কা
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নে আমরা প্রাণ দিয়েছি; কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত এক বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অন্তত ২ হাজার ৪৪২টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে হত্যা ৫৯টি, মন্দিরে হামলা ১৯২টি, ধর্ষণ ৩৩টি, এবং ঘরবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ১ হাজার ৯৯৩টি। কোনো ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার হয়নি।’
তিনি আরও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকারপ্রধান শুরুতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন—মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই এক পরিবার; কিন্তু সংবিধান সংশোধন বা ঐকমত্য কমিশনে সংখ্যালঘুদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ফলে আমাদের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে।’
‘জুলাই চেতনার ব্যবসা’—অপরাধে জড়াচ্ছেন আন্দোলনের নেতারা
অপরাধ বিজ্ঞানী ড. তৌহিদুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন; কিন্তু সরকার সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, যারা জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন সরাসরি অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ জুলাই চেতনাকে ব্যবসায়িকভাবে ব্যবহার করছে। অথচ সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতনের হার বাড়ছে। এর পেছনে সামাজিক সম্প্রীতির অভাব দায়ী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সীমিত ভূমিকায় আছে; তারা শুধু বিবৃতিতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দেশে সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে আছে। আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুল কাদের একসময় বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে কয়েক লাখ মানুষ মারা যাবে।’ যদিও সেই ভয়াবহতা ঘটেনি, তবে সহিংসতার চিত্র কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক নয়। মব সন্ত্রাস, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং অপরাধ বৃদ্ধির বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে