নূরজাহান মসজিদ: তিনশ' বছরে কখনোই ধ্বনিত হয়নি আজান, পড়া হয়নি নামাজ
পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে সূর্য। অস্তমিত সূর্য সূচনা করবে মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত। অথচ, চুন-সুরকি আর পোড়া ইটের তৈরি এই মসজিদের সামনে সুনসান নীরবতা। এখান থেকে ভেসে আসবে না আজানের ধ্বনি, হবে না মাগরিবের নামাজ পড়ার আয়োজন। নির্মাণের পর থেকে আজ অবধি গত তিনশ বছরে কখনোই এখান থেকে ধ্বনিত হয়নি প্রার্থনায় আসার আহ্বান, হয়নি এক রাকাত নামাজও। গা ছমছমে নীরবতায় দাঁড়িয়ে থাকা চুন-সুরকির প্রাচীন এই স্থাপনাটি যেন ইতিহাসের নীরব ভাষ্যকার। এটি ‘নূরজাহান মসজিদ, যদিও এলাকার মানুষের কাছে এটির পরিচয় “নাটি বিবি”র মসজিদ’।
মসজিদটি ১৭শ শতকের এক অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন যা আজও স্মরণ করিয়ে দেয় ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল এক অধ্যায়। মসজিদের দেয়াল প্রায় ৭ ফুট পুরু, ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত। মূল প্রার্থনা কক্ষ একটি গম্বুজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। দেয়ালে অলংকরণে ব্যবহৃত হয়েছে পোড়ামাটির নকশা। মসজিদের ভেতর প্রবেশ করলে দেখা মেলে সূক্ষ্ম খোদাই কাজের- যেখানে আরবি ক্যালিগ্রাফির পাশাপাশি ফুল-লতা ও জ্যামিতিক নকশা এখনো স্পষ্ট।
এক সময় নদীর পাড় হলেও এখন জনবসতির মঝে দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাচীন স্থাপনা। দেয়ালে ফাটল, ছাদে গাছের শেকড়, গম্বুজের বেশিরভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত, আর তার নিচে চাপা পড়ে আছে একজন নারীর প্রতি তৎকালীন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বেদনাদায়ক ইতিহাস।
কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার মাঝিগাছায় অবস্থিত এই নূরজাহান মসজিদ। নূরজাহান মসজিদকে ঘিরে রয়েছে বহু কল্পকাহিনি ও লোককথা। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৭১৪ থেকে ১৭৩৪ সালের মধ্যে কোনো একসময়। স্থানীয়দের মধ্যে মুখে মুখে প্রচলিত গল্পটি হলো: মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নূরজাহান নামে এক নারী, যিনি ছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা দ্বিতীয় ধর্ম-মানিক্যের রাজদরবারের নর্তকী। গোমতীর উত্তরপাড়ে মাঝিগাছা গ্রামে তিন বোন নূরজাহান, মোগরজান ও ফুলজান বাস করতেন। একদিন কিশোরী নূরজাহানকে সাপে কামড়ালে ভেলায় তাকে গোমতী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ত্রিপুরা মহারাজার রাজদরবারের ব্যক্তিরা তাকে দেখে রাজপ্রাসাদে নিয়ে সুস্থ করে তোলেন। পরবর্তীতে রাজদরবারের প্রধান নর্তকী মেনেকা তাকে নাচ-গান শিখিয়ে সেরা নর্তকীতে পরিণত করেন।
প্রায় ৩৫ বছর রাজদরবারে নৃত্য পরিবেশনের পর, নূরজাহান ফেরেন নিজের গ্রামে। প্রাসাদ ছেড়ে আসার সময় ত্রিপুরার মহারাজা নূরজাহানকে মাঝিগাছায় কয়েক একর জমি, প্রচুর অর্থ ও স্বর্ণালংকার দান করেন। তিনি গ্রামের মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তখন তিনি জমিদারের বিধবা স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস শুরু করেন। মুসলিম পরিবারের জন্ম নেয়া নূরজাহান ধর্মীয় অনুভূতিসম্পন্ন হওয়ায় তিনি নির্মাণ করেন একটি মসজিদ। ইতোমধ্যে গ্রামে অনেকেই তার নর্তকী হওয়ার বিষয়টি জেনে যায়। এ নিয়ে গ্রামে এক সভা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয়- একজন নর্তকীর অর্থে নির্মিত মসজিদে কেউ নামাজ পড়বে না। সেই সিদ্ধান্ত আজ অবধি বহাল। ধর্মীয় কার্যক্রম না থাকার ফলে অনিন্দ্য সুন্দর এই স্থাপনাটি কালক্রমে হয়ে গেছে পরিত্যক্ত নিদর্শন।
এদিকে মসজিদের নির্মাতা নূরজাহান পরবর্তী জীবন অপমানে, অবহেলায় একাকীত্বে কাটিয়েছেন। কেউ বলেন তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অন্যত্র চলে যান, আবার কেউ বলেন তিনি অপমানে আত্মহত্যা করেন। মসজিদের পাশেই তার কবর বলে স্থানীয়রা চিহ্নিত একটি স্থান দেখিয়ে থাকেন।
প্রাচীন এই মসজিদটি গোমতী নদীর উত্তর পাড়ে একটি বটগাছের শেকড়ে ধরে এখনো টিকে আছে। মসজিদের পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে রয়েছে স’মিল ও দোকানপাট যা স্থাপনাটিকে আড়াল করে রেখেছে। গম্বুজের একাংশ ইতোমধ্যেই ভেঙে পড়েছে, দেয়ালজুড়ে ফাটল, ছাদে জন্ম নিয়েছে আগাছা ও বৃক্ষ। স্থানীয়দের মতে, একটি ঠেলা দিলে হয়তো সব ধসে পড়বে।
কুমিল্লা নগরীর চাঁনপুর গোমতী ব্রিজ পার হয়ে নদীর উত্তরপাড় ঘেঁষা মাঝিগাছা নন্দীর বাজার সড়কের বামপাশে এই মসজিদের অবস্থান। এটি দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে মানুষ আসে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মসজিদটি এখন ধ্বংসস্তূপ। ভিউজ বাংলাদেশ-এর অনুসন্ধানে সামনে আসেন ঈমান আলী হাজি বাড়ির বাসিন্দা মাসুদ (৬০)। নূরজাহান বিবিও ছিলেন এই একই বংশের। মাসুদ মিয়া ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, বংশপরম্পরায় আমরা ধর্মপ্রাণ। নূরজাহান মসজিদটি পরিত্যক্ত হলে আমাদের বংশের পূর্বসূরিরা পাশেই আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সেখানে শুরু হয় নামাজ পড়া। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নূরজাহান মসজিদটি ধীরে ধীরে জরাজীর্ণ রূপ ধারণ করে। কোনো অলৌকিক কারণেই হয়তো মসজিদটি এখনো টিকে আছে।
গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ অশীতিপর মোহন মিয়া বলেন, ‘আমাদের ছোটবেলায় এই মসজিদটি ছিল নদীর কোলঘেঁষে। ভয়ে আমরা এখানে আসতাম না। এখানটায় অনেক অলৌকিক বিষয় ঘটতো বলে এ দিকটায় কারও আসা হতো না।’
এই মসজিদের আশপাশের দোকানপাট এবং স্থাপনার বর্তমান মালিক ফজলু মিয়া এবং তার ভাইয়েরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফজলু মিয়ার বাবা সরু মিয়া পাকিস্তান আমলের মেম্বার ছিলেন। তখন থেকেই এসব স্থাপনা তাদের দখলে।
স্থানীয় ভূমি অফিসে খোঁজ করতে গেলে তারাও এই সম্পত্তির পূর্ব ইতিহাস বলতে পারেন না। তারা জানান, এই মুহূর্তে খাজনা পরিশোধ এবং দখল সূত্রে সরু মিয়ার পরিবারই স্থানটির মালিক।
সরু মিয়ার ছেলে, কুমিল্লা শহরের ডিস ব্যবসায়ী শাহ আলম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই সম্পত্তির প্রকৃত ইতিহাস আমি জানি না। যতটুকু জানি, এটি খাস জমিন। বন্দোবন্তের মাধ্যমে আমাদের দখলে আছে। প্রকৃত ইতিহাস বড় ভাই ফজলু মিয়া জানেন।’
ফজলু মিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকায় তার সঙ্গে পরে আর কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ভূমি অফিসে কথা বলে জানা যায়, এই সম্পত্তি একসময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ছিল, পরবর্তিতে নদীর গতি অন্যদিকে চলে যাওয়ায় এখানে গণবসতি তৈরি হলে তা খাস জমি হিসেবে অনেকেই বন্দবস্ত নেন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান বলেন, ‘এটি বিভিন্ন সময় পরিদর্শন করেছি। কুমিল্লা নগরীর নিকটবর্তী গোমতীর পাড়ের মসজিদটি সংরক্ষণ করা যেতে পারে।’
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিল্লা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ফিল্ড অফিসার মো. আবু সাইদ ইনাম তানভিরুল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘মসজিদটি পরিদর্শন করেছি। মসজিদের অবস্থা অত্যন্ত জরাজীর্ণ। প্রস্তাব পাঠানো হবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যাচাই করে দেখলে এটি সংরক্ষণের আওতায় আসতে পারে।’
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা জানান, এটি সংরক্ষণের জন্য তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের টিম একাধিকবার এটি পরিদর্শন করেছে। দেখা গিয়েছে, মসজিদের ওপর যেভাবে গাছ এবং গাছের শিকড় রয়েছে তাতে করে মূল মসজিদের বেশিরভাগ অংশেই ফাটল ধরেছে।’
বর্তমান অবস্থায় সংরক্ষণ করলে ভালো কোনো ফল আসবে না বলে মন্তব্য করেন ড. নাহিদ। তিনি বলেন, ‘তারপরও রিপোর্ট হেড অফিসে পাঠাব। আশা করছি এটি সংরক্ষণের জন্য হেড অফিস হয়তো এটি উচ্চপর্যায়ের টিম গঠন করবে।’
মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিষয়ে কথা হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দিনের সঙ্গে।
তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই মসজিদটি নির্মাণের সময়কাল এখনো সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। আমি ও আমার টিম একাধিকবার এটি সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। স্থাপনাটির কারুকাজ, নকশা এবং নির্মাণশৈলী এটিকে একটি লেট-মোগল স্থাপত্য হিসেবে চিহ্নিত করে। মসজিদটি নির্মাণকারী নারী নিঃসন্দেহে ধর্মপ্রাণ ছিলেন- নইলে একাকী এমন একটি মসজিদ নির্মাণ করা সম্ভব হতো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি কেবল একটি প্রাচীন মসজিদ নয়, এটি আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের অমূল্য দলিল। অতএব এই স্থাপনাটি সংরক্ষণে অবিলম্বে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।’
নূরজাহান বিবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আজকাল আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নৃত্যশিল্পীদের সসম্মানে আমন্ত্রণ জানাই; কিন্তু অতীতে একজন শিল্পীকে রাজদরবারে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। সে সময় সমাজের একটি অংশ তাদের মূল্যায়ন করলেও আরেকটি অংশ তাদের হীন দৃষ্টিতে দেখত। সমাজের এই দ্বিচারিতাই নূরজাহানের জীবনের সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা।’
তিনি বলেন, ‘এই স্থাপনাটি আমাদের সামনে দুটি বার্তা উপস্থাপন করে, প্রথমত, ৩শ বছর আগে একজন নারী নিজ শ্রম ও দক্ষতায় এত অর্থ উপার্জন করেছিলেন যে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ মসজিদ নির্মাণে সক্ষম হন যা নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান তুলে ধরে। দ্বিতীয়ত, একই সঙ্গে সমাজ ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের যে জাল বিছিয়ে রেখেছিল তা-ও এই মসজিদের অদ্যাবধি নামাজবিহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়।’
ড. সোহরাব উদ্দিন মনে করেন, এই মসজিদটি একটি “ইতিহাসের নিঃশব্দ প্রতিবাদ”। এটিকে শুধু স্থাপত্য হিসেবে নয়, বরং সমাজচিত্রের প্রতীক হিসেবেও সংরক্ষণ করা জরুরি।
কুমিল্লার তরুণ প্রজন্মের কাছে নূরজাহান মসজিদ শুধু একটি পরিত্যক্ত গম্বুজ নয়; ‘এটি ইতিহাসের এক নারীর আত্মত্যাগ, সমাজের মূল্যবোধ এবং ধর্ম ও মানবতার দ্বন্দ্বের জীবন্ত দলিল।’
তারা মনে করেন, যথাযথভাবে সংরক্ষণ কাজ শুরু করতে পারলে মসজিদটিকে ঘিরে সাহিত্য, ইতিহাস ও পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে