বাংলাদেশে সৃষ্টির পরিমণ্ডলে স্বাধীন চিন্তাশীলতার কোনো স্থান রাখা হচ্ছে না
বাংলাদেশের চিন্তাজগৎ ও শিল্প-সাহিত্য নিয়ে ভাবতে গেলে এমন অনেক কথা মনে জাগে যেগুলো লিখে প্রকাশ করতে ইচ্ছা হয়; কিন্তু পারি না। চারপাশের দৃশ্যাবলির দিকে তাকিয়ে এ বিষয়ে লেখা খুব কঠিন মনে হয়। কেমন যেন ভীষণ উন্মাদনার মধ্য দিয়ে চলছেন খুব সক্রিয় লোকেরা, বাকি প্রায় সকলে উদাসীন। ব্যতিক্রমী কোনো কিছুর দিকে কেউ তাকাতেই চান না। এই পরিমণ্ডল কি সৃষ্টির অনুকূল? বাংলাদেশে চিন্তার ও সাহিত্যের জগতে এখন সর্বাঙ্গীন সৃষ্টি কোথায়?
ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাও কি এখন সৃষ্টিশীল? পৃথিবীজুড়েই এখন বিরাজ করছে সৃষ্টিবৈরী পরিবেশ। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোতে উত্তরকে অন্ধভাবে অনুসরণ করার প্রবণতা এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে প্রবল। প্রশ্ন হলো, অন্ধ অনুসরণ দ্বারা কি কখনো সৃষ্টি সম্ভব হয়? সৃষ্টির নামে চলছে অনাসৃষ্টি।
ইউরো-মার্কিন আধিপত্যমত্তরা দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের ওপর হীন উদ্দেশ্যে নানা কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাল থেকেই সভ্যতার সংকটে নিমজ্জিত। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীসমূহ এই চাপের মধ্যে পড়ে একেবারেই বিকারপ্রাপ্ত হয়ে আছে। সংকট তারা কাটিয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ অভিহিত হচ্ছে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বলে। এ নিয়ে বাংলাদেশের লেখকসমাজে-কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, রাষ্ট্রচিন্তায়, সমাজচিন্তায়, বিজ্ঞানে, ইতিহাসে, দর্শনে কিংবা সংগঠিত প্রয়াসে বিশেষ কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কিংবা অনুসন্ধিৎসা লক্ষ করা যায় না। কী ভীষণ সময় যাচ্ছে! অক্ষয়কুমার-বিদ্যাসাগর-মধুসূদন-বঙ্কিমের কাল, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-রোকেয়া-নজরুলের কাল, বুদ্ধদেব-জীবনানন্দ-সুধীনদত্তের কাল, বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর-মানিকের কাল, হুমায়ুন আজাদ-তসলিমা নাসরিন-হুমায়ূন আহমেদদের এই কাল কথিত সুশীল সমাজী ও এনজিওপতিদের এই কাল কত বিভিন্ন!
আধুনিকতাবাদীদের সামনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
‘সত্যমূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি,
ভালো নয় ভালো নয় নকল সে শৌখিন মজদুরি।’
আধুনিকতাবাদীদের নৈরাশ্যবাদে রবীন্দ্রনাথ সত্য খুঁজে পেতেন না। আজকের অবস্থা দেখার সুযোগ পেলে কী লিখতেন তিনি? রবীন্দ্রনাথের কথা প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে; সেটা বড় নয়; আমরা আজ কী অনুভব করি, চিন্তা করি, সেটাই বড়।
যখন কোনো লেখক আধুনিকতাবাদী, উত্তরাধুনিকতাবাদী, পরাবাস্তববাদী, কাঠামোবাদী, উত্তর-কাঠামোবাদী, প্রতীকবাদী, অস্তিত্ববাদী, মার্কসবাদী, রেনেসাঁসপন্থি ইত্যাদির কোনোটি বলে নিজের পরিচয় দেন, তখন তিনি নিজের মানসিক অবস্থাই প্রকাশ করেন। এক-একটি মতবাদের অনুসারী হয়ে এক-একজন ব্যক্তি এক-এক রকম মানসিক অবস্থায় থাকেন। দীক্ষা নেয়ার ব্যাপার আজকাল দেখি না, তবে খুব সহজেই লেখকরা কোনো-না কোনো মতবাদের অনুসারী হয়ে পড়েন। যিনি কোনো মতবাদ অনুসরণ করে চলেন, তিনি কি নিজের মানসিক অবস্থার স্বরূপ কখনো বুঝতে চেষ্টা করেন? আত্মজিজ্ঞাসা কোথায়? ‘আত্মা নং বিদ্ধি’, 'know thyself'’- এসব কথা এই বাংলাদেশে ভুলেও এখন কেউ উচ্চারণ করেন না। মতবাদ অনুসরণ করতে গিয়ে এখন প্রত্যেকেই অনুসরণ করেন এক-একটি ছকবাঁধা ধারা। সদর রাস্তা খোঁজ না করে কানাগলি দিয়ে চলতে পছন্দ করেন অনেকে। কেউ কেউ উচ্চকণ্ঠে ‘মুক্তবুদ্ধিচর্চা’র কথা বলেন বটে; কিন্তু তাদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তাশীলতা দুর্লভ- অন্যদের কথা উল্লেখযোগ্য নয়। স্বাধীন চিন্তাশীলতা যার মধ্যে নেই তিনি কী-করে সৃষ্টি করবেন? সৃষ্টি কি কোনো মতবাদ দিয়ে তৈরি চিন্তাকাঠামোর ছাঁচে সম্ভব হয়?
জীবন ও জগৎ, অহং ও ইদং, ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ’, সুন্দর ও কুৎসিত এবং ন্যায়-অন্যায় ও শুভ-অশুভ ইত্যাদির প্রতি পূর্বোক্ত মতবাদসমূহের প্রতিটিরই রয়েছে বিঘোষিত বা অঘোষিত আলাদা আলাদা মনোভঙ্গি, আলাদা আলাদা বক্তব্য, আলাদা আলাদা বিচারপদ্ধতি। প্রতিটি মতবাদ কি তার অনুসারীকে মহৎ সৃষ্টির পথে চালিত করছে?
কোনো কোনো দিক দিয়ে এক মতবাদের সঙ্গে অন্য মতবাদের মিলও থাকে। তবে সেটা বড় কথা নয়, স্বাতন্ত্র্যটাই মূল। সেজন্যই একই দেশ-কালের হয়েও তারা আলাদা। বাস্তবে তারা পরস্পর-প্রতিদ্বন্দ্বী। লেখার জগতে যখন কেউ কোনো ঘরানায় কিংবা দলে যোগ দিয়ে গতানুগতিক চিন্তা-চেতনা, চলমান আবেগ-উত্তেজনা, অন্ধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও জয়-পরাজয়ের উন্মত্ততায় ডুবে নিজের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলেন, তখন তিনি প্রচারমাধ্যমে ও লোকমুখে প্রভূত আলোচনার বিষয় হলেও লেখক হিসেবে আর উল্লেখযোগ্য থাকেন না। সময়ের ব্যবধানে সৃষ্টির ইতিহাসে তিনি বড়জোর নাম উল্লেখের দাক্ষিণ্য মাত্র আশা করতে পারেন তাও সৃষ্টির জন্য নয়, সৃষ্টির পরিমণ্ডলকে উত্তপ্ত রাখার জন্য। অনেকে পুরস্কার পাওয়ার জন্য লেখেন এবং সে উদ্দেশ্যে সিন্ডিকেট তৈরি করেন। সিন্ডিকেটভুক্ত হয়ে তারা পুরস্কার লাভ করে থাকেন।
আমার মনে হয় লেখার জগতে জয়-পরাজয়ের প্রতিযোগিতায় নেমে কেউই নিজের সৃষ্টিশক্তির সদ্ব্যবহার করতে পারেন না। সৃষ্টিশক্তির সদ্ব্যবহারের জন্য মূলত দরকার হয় স্বাধীন সত্যসন্ধ গ্রহিষ্ণু মনোভাব আর নির্ভেজাল সৌন্দর্যবোধ। প্রত্যেক কালে প্রত্যেক ভাষাতেই বহু লেখক থাকেন। প্রত্যেকেই অন্যের অধিকার খর্ব না করে নিজের কর্মের মাধ্যমে নিজের অনুভূতি, উপলব্ধি, চিন্তা ও মতামত প্রকাশ করবেন এটাই স্বাভাবিক। নানা মত প্রকাশের সুযোগ কাম্য। সেখানে একের অন্যকে পরাজিত করার মনোভাব কতটা বাঞ্ছনীয়? নিছক জয়-পরাজয়ের মনোভাব কি আদৌ বাঞ্ছনীয়? লেখক-সমাজে দরকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সত্য ও সুন্দরের অনুসন্ধান। সত্যের সন্ধানে কোনো পর্যায়ে যিনি নিজেকে নির্ভুল প্রমাণ করেন তিনি যেমন অবদান রাখেন, তেমনি যিনি ভুল করেন তিনিও অবদান রাখেন। কেবল একজনের কিংবা একপক্ষের দ্বারা সত্যের পথে অগ্রগতি হয় না। সকলের জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে একটা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি কাজ করে। সত্যসন্ধ হলে উভয়েই কিংবা উভয়পক্ষই সৃষ্টিশীল ও শ্রদ্ধাযোগ্য। জয়-পরাজয় সেখানে তুচ্ছ। সৃষ্টিশীল সত্যনিষ্ঠ প্রয়াসে স্বরূপ-বিরূপ আলোচনা অনিবার্য ও অপরিহার্য। সংগ্রামের যেমন দরকার আছে, তেমনি সমঝোতারও দরকার আছে। কর্মক্ষেত্রে একপক্ষ অন্যপক্ষকে নির্মূল করে দিতে চাইলে তার ফল খারাপ হয়।
সত্য হলো এমন একটা কিছু যার মধ্যে সকলের জন্য পরম ন্যায়, পরম কল্যাণ ও পরম সুন্দর অন্তিমান। সত্য সামাজিক সৃষ্টি। সমাজে প্রত্যেকের মধ্যেই স্বতন্ত্র ন্যায়বোধ, সৌন্দর্যবোধ ও সর্বজনীন কল্যাণবোধ আছে। সত্য হলো সকলের ন্যায়বোধ, সৌন্দর্যবোধ ও কল্যাণবোধের সংশ্লেষিত সারবস্তু। সত্য উপলব্ধির ব্যাপার। সত্য কোনো চূড়ান্ত ব্যাপার নয় সত্য বিকাশশীল। তবে সত্যের বিকাশ ঘটে অতি মন্থর গতিতে। এ পর্যন্ত মানবজাতির গোটা ইতিহাসেই সত্য অধরা। অনন্তকাল কি সত্য অধরাই থাকবে? আমরা জানি না। কেবল এটুকুই বলতে পারি যে, ভালো জীবনের জন্য সত্য অবলম্বন করতে হয়- সত্যের অবলম্বন ও ভবিষ্যতের কল্পনা ছাড়া জীবন অর্থপূর্ণ হয় না। কোনো মতবাদে দীক্ষা নিলেও সত্যনিষ্ঠা রক্ষা করতে হবে। যে মতবাদ নিজের মধ্যে সত্যকে স্থান দেয় না, সে মতবাদ পরিত্যাজ্য। Fact I Truth এক নয়। তবে Fact-কে ভিত্তি করেই Truth-এ পৌঁছুতে হয় এবং Truth অবলম্বন করেই সৃষ্টির পথে চলতে হয়। সত্যের ভিত্তি হিসেবে কোনোক্রমেই তথ্যকে বাদ দেয়া যায় না। তবে কেবল তথ্যই সত্য নয়। রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি স্মরণীয়: ‘ঘটে যা তা সব সত্য নয়। কবি তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ যে যুগে লোক ভাবতে পারে ‘সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী’, সেই যুগই সত্যযুগ।
সত্যকে যিনি এভাবে উপলব্ধি করবেন, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে জয়-পরাজয়ের অন্ধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তিনি মত্ত হতে পারবেন না। সত্যের আকর্ষণে বৈষয়িক লাভ-ক্ষতির, সাফল্য-ব্যর্থতার কিংবা জয়-পরাজয়ের বোধ তার মনে দানা বাঁধবে না। ভুল করতে পারেন তিনি, ভুল শোধরাতেও পারেন। প্রতিপক্ষের কাছ থেকেও গ্রহণীয় কী পাওয়া যায়, তাই তিনি খোঁজ করবেন। দান ও গ্রহণ দুটোই তার কাছে মূল্যবান। সাধারণভাবে তিনি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল থাকবেন, সহজে কাউকে শত্রু মনে করবেন না।
মানবস্বভাব শোধনীয়- একথা তিনি মনে রাখবেন। চারপাশে লেখক-সমাজে দেখতে পাই কেবল দান করার বাসনা, গ্রহিষ্ণুতার নিদারুণ অভাব। Live and let others live. Love and be loved. এসব উক্তি হবে একজন প্রকৃত লেখকের চলার পথে মূল নীতি। প্রতিযোগিতার সঙ্গে তার সহযোগিতাও থাকবে। ঐক্য এবং বিরোধ, বিরোধ এবং ঐক্য দুটোকেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন। বিরোধ হবে প্রতি বিষয়ে সত্যের স্বরূপ ও সত্য প্রতিষ্ঠার উপায় নিয়ে। পরম সত্য হবে ধ্রুব অন্তিম লক্ষ্য। অন্যের ভুল সন্ধান করার সময়ে নিজের ভুলও তিনি সন্ধান করবেন। নিজেকে সবসময় তিনি ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করবেন না। পরিশোধন ও সংশোধন হবে তার কাম্য। পরাজিত করার মনোভাবও তার থাকবে, কেবল অনুশোচনাহীন অপরাধীকেই তিনি পরাজিত করতে চাইবেন, অন্যকে নয়। যাকে-তাকে তিনি অনুশোচনাহীন অপরাধী গণ্য করবেন না, চলতি উত্তেজনায় হারিয়ে যাবেন না, এ ক্ষেত্রে তার থাকবে ব্যাপক ও গভীর অনুসন্ধান। ঐক্য বিরোধ ঐক্য হবে তার মূলনীতি। কেবল অনুশোচনাহীন অপরাধীদের বেলায় হবে ভিন্ননীতি: ঐক্য বিরোধ জয়-পরাজয়। ধনাত্মক, সদর্থক, ইতিবাচক, গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি হবে একজন প্রকৃত শিল্পী কিংবা লেখকের অন্তর্গত চালিকাশক্তি। ভালো-মন্দ ও সুন্দর-কুৎসিত বিচার করে, নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থেকে, ভালো ও সুন্দরের পক্ষ তিনি অবলম্বন করবেন।
অত্যুন্নত প্রযুক্তির এই কালে পুস্তক-পুস্তিকা ও পত্র-পত্রিকা ঝলমলে চেহারা নিয়ে ক্রমাগত বিপুল থেকে বিপুলতর সংখ্যায় প্রকাশিত হচ্ছে মূল্যবিচার নেই, মূল্যবোধও নেই। শিল্পকলাও হচ্ছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রসার প্রিন্ট মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রসারকে খর্ব করছে না। অনলাইন একটিভিটিজ বাড়ছে এবং এসবের মাধ্যমে যে কোনো বিষয়ে মানুষ খুব সহজে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে ও প্রচার করতে পারছে। যে কোনো বিষয়ে কাজ করতে গেলে তার জন্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তথ্যের সুবিশাল ভাণ্ডার গড়ে তোলা যায়। এ অবস্থায় তথ্যের বিপুলতাই কাজকে কঠিন করে তোলে। বাস্তবে দেখা যায়, এসব তথ্য-উপাত্ত যেভাবে থরে থরে সাজানো পাওয়া যায় তা দিয়ে মানুষের অনুভূতি ও চিন্তার ভালো দিকগুলো পরিপুষ্ট হয় না। গবেষণায় ও সাংবাদিকতায় মূল্যনিরপেক্ষ (value free) ও বস্তুনিষ্ঠ (objective, factual) পরিবেশনার নামে যা কিছু উপস্থাপন করা হচ্ছে তাতে ভালো ও মন্দ একাকার হয়ে সামনে আসছে এবং তার মধ্যে মন্দেরই প্রাধান্য। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ ও সুন্দর-কুৎসিতের বিবেচনা স্থান পায় না গবেষণায় ও সংবাদ পরিবেশনে। মনের দিক দিয়ে চিন্তা-চেতনা ও বিচার-বিবেচনার দিক দিয়ে সাধারণভাবে মানুষ এখন পতনশীল।
পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র মূল্যবোধের দিক দিয়ে মানুষের অবস্থা প্রায় এক রকম। গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধিৎসা ও ভালো চিন্তা দানা বেঁধে ওঠার আগেই ভেঙে পড়ছে। অশুভশক্তির মোকাবিলায় শুভশক্তি পরাজিত হচ্ছে, মার খাচ্ছে, ব্যর্থ হচ্ছে। যান্ত্রিক প্রাচুর্যের মধ্যে খুব দ্রুতগতিতে চলছে সবকিছু যা মাত্র একশ বছর আগের মানুষেরা কল্পনাও করতে পারত না। এ অবস্থায় বই ও পত্র-পত্রিকা সম্পর্কে - লেখক ও লেখা সম্পর্কে চিন্তা-চেতনা ও অনুভূতি-উপলব্ধির অগ্রগতি সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণে খোঁজ-খবর রাখা, কোনো বিষয়ে সব দিক বিবেচনা করে সামান্য ধর্ম নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি ও সাংবাদিকতা ইত্যাদির গভীরে যদি বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনাকেও স্থান দেয়া হতো তাহলে সমস্যা এত জটিল হতো না। বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে সত্যনিষ্ঠতা অপরিহার্য।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের ‘ক্যারিয়ার বিল্ড আপ করা’র ও পদোন্নতির জন্য গবেষণার যে ব্যবস্থা চালু আছে তা তরুণ শিক্ষকদের চিন্তাশক্তিকে বিকৃত ও বিনষ্ট করছে, জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসাকে স্বাভাবিক ধারায় বিকশিত হতে দিচ্ছে না- মেধা ধ্বংস করছে। অপবস্থার চাপে বাধ্য হয়ে তাদের গবেষণা করতে হচ্ছে, এতে আনন্দের যোগ নেই। গবেষকের চিন্তার স্বাধীনতা, বিচার-বিবেচনার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা অল্পই স্বীকার করা হচ্ছে। গবেষকের ক্যারিয়ার বিল্ড আপ করা ও চাকরিতে পদোন্নতি ছাড়া অন্য প্রায় কোনো কাজেই ব্যবহৃত হয় না তাদের সন্দর্ভ-অভিসন্দর্ভ। সরকারি ও বেসরকারি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ও সংস্থায় গবেষণার যে ব্যবস্থা চালু আছে তাতে চলছে নানা ধরনের ফরমাইশি তথ্যসংকলন। শাসক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা প্রায় সম্পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হচ্ছেন কথিত দাতা সংস্থাসমূহের ও কথিত উন্নয়নসহযোগীদের দ্বারা, জাতীয় স্বার্থের কথা তারা ভাবেন না।
লেখকদের নানা ঘরানা আছে। ঘরানার বাইরে কারো পক্ষে লেখক হিসেবে অন্তিমান থাকা দুঃসাধ্য। এ সমাজে স্বাধীনভাবে কেউ কোনো ভালো কাজে অগ্রসর হলেই তাকে নানা রকম ব্রান্ড দিয়ে তার অগ্রগতিকে বানচাল করে দেয়া হয়। মহৎ সৃষ্টি সন্ধান করতে গেলে দেখা যায়, প্রতিটি ঘরানাই এখন ব্যর্থ, নিষ্ফল, বন্ধ্যা। হয়তো মহৎ কোনো লক্ষ্যই কোনো ঘরানার নেই। সৃষ্টিশীল কাজের পক্ষে কোনো কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রয়াসও সফল হয় না। এ এক অদ্ভুত বাস্তবতা। ঈর্ষা-বিদ্বেষ আছে, দলাদলি আছে, উত্তেজনাও আছে; কিন্তু ভালো অর্থে লেখকদের কোনো দল নেই সংগঠন নেই।
প্রচলিত রাজনীতির গতানুগতিক উত্তেজনার ধারায় হারিয়ে যাওয়া লেখকদের একটি অংশ অতীতমুখী দৃষ্টি নিয়ে জনসাধারণকে ভাগ করে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি’ বলে এবং অপর একটি অংশ অতীতমুখী দৃষ্টি নিয়ে জনসাধারণকে ভাগ করে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষশক্তি এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষশক্তি’ বলে। দুই পক্ষের বিভক্তির ভাষা দুই রকম হলেও জনগণের মধ্যে ভেদরেখা সম্পূর্ণ এক। দুই পক্ষেরই কর্তাব্যক্তিরা এই বিভেদকে চিরস্থায়ী বন্দোবন্তে রূপ দিয়ে রেখেছেন। এই বিভক্তিতে কোনো পক্ষেরই পর্যাপ্ত কল্যাণবুদ্ধি নেই। বুঝতে হবে যে, এই বিভক্তি বজায় রেখে সমগ্র জনগণের ঐক্য ও উন্নতি অসম্ভব। এনজিও কর্তারা এবং সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোর বুদ্ধিজীবীরা বিদেশি প্রভুদের আর্থিক মদদে বিদেশি প্রভুদের প্রকল্প ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করেন। দেশি-বিদেশি প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া তাদের দখলে আছে। সমালোচনা বলে কোনো জ্ঞানশাখাকে বিকশিত করা হচ্ছে না। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্ম- সবকিছুকেই করে ফেলা হয়েছে অর্থহীন।
এই পরিস্থিতিতে অনেকে খেয়াল-খুশি মতো লিখে চলছেন। গত প্রায় চার দশক ধরে ধর্ম, নারী ও রাজনীতি বিষয়ে উসকানিমূলক লেখা খুব জনপ্রিয় হয়েছে। জনপ্রিয়তার আকর্ষণে এবং ব্যবসায়িক সাফল্যের প্রয়োজনে কিছু লেখক কল্যাণবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে রুচি ও শ্লীলতার সীমা লঙ্ঘন করে এ ধারায় অনেকদূর এগিয়ে গেছেন এবং নিজের জীবনকে পর্যন্ত বিপন্ন করেছেন। তসলিমা নাসরিন নানা দেশে প্রবাসী, হুমায়ুন আজাদ প্রাণ হারিয়েছেন, জাহানারা ইমাম মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লড়তে মামলা নিয়ে প্রাণ ত্যাগ করেছেন, আহমদ শরীফ তেইশটি মামলা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে কোর্টে হাজিরা দিতে দিতে এবং শওকত ওসমান ‘শেখের সম্বরা’ ও ‘রাহনামা’ লিখতে লিখতে মারা গিয়েছেন।
বেতার তরঙ্গে বিবিসি ভীষণভাবে তৎপর ছিল মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলন এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলন পরিচালনায়। দৃশ্যের অন্তরালে থেকে যারা কাজ করছে তাদের বাদ দিলে প্রচারমাধ্যম রূপে বেতার তরঙ্গে বিবিসিই এসব আন্দোলনের উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের কথিত প্রগতিশীল লেখকেরা ভীষণভাবে মত্ত হয়েছিলেন বিবিসি পরিচালিত এসব আন্দোলনে। ফলাফলের কথা, পরিণতির কথা, বিবিসির সাম্রাজ্যবাদী দুরভিসন্ধির কথা তারা ভাবতে চাননি। স্থানীয় প্রচারমাধ্যমগুলো অন্ধভাবে অনুসরণ করেছে বিবিসির প্রচারধারাকে কোনো বিচার-বিবেচনা দেখা যায়নি। গতানুগতির বাইরে বিশ্লেষণমূলক ও বিচারমূলক চিন্তাভাবনাও ছিল; কিন্তু প্রচারমাধ্যম সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়নি, কোনো ঘরানাও সেগুলোর প্রতি সদয় দৃষ্টি প্রসারিত করেনি, পূর্বোক্ত পক্ষ-বিপক্ষ নির্দেশক দুটি শক্তিই প্রগতিশীল নতুন চিন্তাচেতনাকে নির্মূল করতে চেয়েছে।
এই সৃষ্টিবৈরী বাস্তবতায় জ্ঞানের জগতে, সাহিত্য ও শিল্পকলার জগতে অবক্ষয়ক্লিষ্ট পশ্চিমের অনুসরণে ‘আধুনিকতা’ ও ‘উত্তরাধুনিকতা’ কথাদুটো খুব উচ্চারিত হয়। লেখার ও আঁকার জগতে যারা বিশেষভাবে সক্রিয়, তাদের অধিকাংশই হয় ‘আধুনিক’ না হয় ‘উত্তরাধুনিক’। কথা দুটো আসলে হওয়া উচিত ‘আধুনিকতাবাদী’ ও ‘উত্তরাধুনিকতাবাদী’; ইংরেজিতে Ômodernism' I post-modernism. Modern, modernity, modernization, modernism- এসব কথার অর্থে পার্থক্য আছে। আভিধানিক কিংবা ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দিয়ে বুঝতে গেলে প্রকৃত অর্থ পাওয়া যায় না। সংশ্লিষ্ট মতবাদীরা কী-অর্থে কোন কথা ব্যবহার করছেন, সেটাই তলিয়ে দেখতে হবে। উদ্দেশ্য ও ফলাফলও বিচার করতে হবে। আধুনিকতাবাদীরা ও উত্তরাধুনিকতাবাদীরা রেনেসাঁসের প্রতি বিরূপ। রেনেসাঁসের অনুসন্ধিৎসা থেকে তাদের অনুসন্ধিৎসা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী।
সৃষ্টির জগতে মতবাদ ও ঘরানা থাকে, স্বাধীন চিন্তাশীলতাও থাকে। বাংলাদেশের সৃষ্টির পরিমণ্ডলে স্বাধীন চিন্তাশীলতার কোনো স্থান রাখা হচ্ছে না। সৃষ্টিশীলতার শর্ত তৈরি করতে হলে নতুন অনুসন্ধিৎসা যেমন দরকার, তেমনি দরকার প্রচলিত চিন্তা-চেতনার প্রকৃতিকে বোঝা। নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করতে হলে অতীত সম্পর্কে চিন্তাভাবনাকেও পুনর্গঠিত করতে হয়। এজন্য এখন রেনেসাঁস, আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ- এই তিনটি বিষয়কেই একসঙ্গে পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিয়ে বুঝে দেখা দরকার। এখানে খুব সংক্ষেপে আমি বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার কিছু উপলব্ধি ব্যক্ত করব। মূলত আমি চাইব একটি দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতে। বহুজনের আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের চিন্তাভাবনাকে পরিশোধিত, নবায়িত, বিকশিত ও কার্যকর করে তুলতে পারব। তা না হলে প্রগতির বদলে গতানুগতিই চলবে।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: ভাষাবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে