Views Bangladesh Logo

শিক্ষার উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই

বাংলাদেশে যে সরকারই ক্ষমতায় আসে সে সরকারই উন্নয়নে জোয়ার বইয়ে দেয়। বিগত আওয়ামী লীগ আমলে এমন জোয়ার আমরা অনেক দেখলাম। অবকাঠামো কিছু উন্নয়নই হলো শুধু; কিন্তু একটা জাতি গঠনের যে মূল ভিত্তি, শিক্ষা- সেখানে কোনো কাজ হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সেখানে ব্যর্থ হলো। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অনেক কমিশন হলো, কোনো শিক্ষা কমিশন হলো না। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই শোরগোল শুরু হয়েছে। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো বড় বড় আশ্বাসবাণী শোনাচ্ছেন। তারা ক্ষমতায় এলে এটা করবেন, ওটা করবেন- কিন্তু শিক্ষা নিয়ে তেমন কিছু বলছেন না। অর্থাৎ শিক্ষা নিয়ে আমাদের সব সরকার ও রাজনীতিবিদদেরই মনোভাব এক- এ ব্যাপারে তারা অন্ধ।

এদিকে দেশের শিক্ষার মান দিন দিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে যেসব তথ্য উঠে আসছে তা খুবই উদ্বিগ্নজনক। যেমন কিছুদিন আগেই বিশ্বব্যাংকের তথ্যে জানা গেল, বাংলাদেশের একাদশ শিক্ষার্থীদের মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সপ্তম শ্রেণির সমান। সিঙ্গাপুরভিত্তিক এক গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশের স্নাতক সনদ ফাউন্ডেশন কোর্সের সমান।

আরো উদ্বিগ্নজনক তথ্য হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি বাংলাদেশের এমবিবিএস। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি ও গণিতে দুর্বল শিক্ষার্থীর হার আরও বেড়েছে। আগে থেকেই মাধ্যমিকে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। নতুন করে অবনতি উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ২০১৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে গণিত বিষয়ে ‘খারাপ’ শিক্ষার্থীর হার ছিল ২২ শতাংশের কিছু বেশি। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ শতাংশ।

ইংরেজি ও গণিত নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের ভীতি ও দুর্বলতা বহু বছরের। অথচ এ দুটি বিষয় জ্ঞানচর্চার মৌলিক দুটো বিষয়। এর সাথে বিজ্ঞান বিষয়টিও যুক্ত। আধুনিক এ সময়ে অঙ্ক, ইংরেজি ও বিজ্ঞানে দুর্বল হলে তথ্য-প্রযুক্তির কর্মবাজারে যেমন পিছিয়ে পড়তে হয়, তেমনি মানুষের যে সাধারণ-স্বাভাবিক কিছু যুক্তিবোধ থাকা দরকার, তাতেও পিছিয়ে থাকতে হয়। পড়াশোনা শুধু কর্মজীবনের সঙ্গেই সম্পর্কিত না, তা ব্যক্তির প্রতিট কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনার সঙ্গেই সম্পর্কিত। আর সামগ্রিকভাবে ব্যক্তির ব্যর্থতাই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, কিংবা রাষ্ট্রের ব্যর্থতাই ব্যক্তির ব্যর্থতা। যেদিক থেকেই বিচার করা হোক, অঙ্ক-গণিত-বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে জ্ঞানচর্চার অভাব হলে আধুনিক পৃথিবীতে দক্ষযোগ্য নাগরিক হওয়া কঠিন।

এত বড় জায়গায় না গিয়েও বলা যায় শ্রমবাজারে টিকে থাকাই কঠিন। ১৯৭৪ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে দেশের শ্রমবাজারের জন্য দক্ষ কর্মী সরবরাহ করা এবং মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত করাকে উল্লেখ করা হয়েছিল; কিন্তু এ পর্যায়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করতে না পারায় তরুণদের স্বল্প বেতনে চাকরি করতে হয় অথবা পেশাজীবনে পিছিয়ে থাকতে হয়।

আজকে আমাদের দেশে শিক্ষা হয়ে গেছে বেকারত্ব সৃষ্টির আরেক নাম। এসব নিয়ে অনেক কথা বলেও কোনো ফল হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা সচেতন হচ্ছেন না, অভিভাবকরা সচেতন হচ্ছেন না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সচেতনতা নেই। ফলে যে সরকার ক্ষমতায় আসে সে-সরকারও শিক্ষা বিষয়ে কোনো জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করে না; কিন্তু আজ জাতি এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত হয়েছে, এখনই, যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার মান উন্নয়নে আমাদের সচেতন হতে হবে।

এ কথা স্পষ্টভাবে আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার মান উন্নয়ন ছাড়া জাতির উন্নতি নেই। আর এখন, এর জন্য একে অপরকে দায়ী করেও লাভ নেই। কারণ দায়ী আমরা সবাই। দায়িত্বভারও আমাদের সবার কাঁধে তুলে নিতে হবে। তবে, এ কথাও তো সত্য যে, সরকারের সঠিক উদ্যোগ ছাড়া এ থেকে মুক্তির উপায় নেই। আর সরকার যেন সঠিক কর্মপদ্ধতি হাতে নেয় তার জন্য আমাদের সবাইকেই সরকারকে চাপে রাখতে হবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ