Views Bangladesh Logo

মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির স্বরূপ

হিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেছেন, বিগত সরকারের সময় দুর্নীতি আমাদের সকল অগ্রযাত্রাকে উইপোকার মতো খেয়ে ফেলেছে; সেই সময়ে প্রত্যেক প্রকল্পেই দুর্নীতি হয়েছে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুর্নীতি রোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে। বিগত সময়ে সরকারগুলো ব্যয়ের মহোৎসব করেছে বলে মন্তব্য করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। আওয়ামী সরকারের আমলের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে ‘চুরির প্রশান্ত মহাসাগর’ বলে উল্লেখ করেছেন একই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ ছিল, মেগা মেগা প্রকল্পে মেগা মেগা দুর্নীতি হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন বেশি ধরা হলে দুর্নীতি করা সহজ।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী পক্ষ থেকে একটি কথা প্রায় উচ্চারিত হতো, বাংলাদেশে যে কোনো প্রকল্পের ব্যয় ভারত কিংবা আশপাশের দেশের তুলনায় বেশি; কিন্তু দুর্নীতি কই? বেনজির আহমেদ এবং মতিউর রহমানসহ দুর্নীতির যেসব কাহিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আলোড়ন তুলেছিল, তার বাইরে আর কোন দুর্নীতির হদিশ কি অদ্যাবধি জনগণ পেয়েছে?

দেশের সবচেয়ে বড় দুটি প্রকল্প ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প’ এবং ‘পদ্মা সেতু প্রকল্প’। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের খরচ ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা এবং পদ্মা সেতুর ৩২ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করার কথা ছিল বিশ্ব ব্যাংকের; কিন্তু কাজ পেতে কানাডার এসএনসি-লাভালিনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগ দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করতে তারা পরবর্তীকালে অস্বীকার করে। এই ঘুষের ফয়সালা হয় কানাডার আদালতে; দীর্ঘ তদন্তের পর ঘুষের অভিযোগ অনুমানভিত্তিক ও গুজব বলে আদালত তা খারিজ করে দেয়।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, যখন দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয় তখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণের কোনো ঠিকাদার নিয়োগই দেওয়া হয়নি, কোনো চুক্তি সই হয়নি, কোনো অর্থও ছাড় করা হয়নি। উল্লেখ্য যে, সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কারিগরি কমিটি পদ্মা সেতুর টেন্ডার মূল্যায়ন করায় দুর্নীতি নিয়ে সন্দেহ জাগার কথা নয়। তারপরও বিশ্ব ব্যাংকের উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগের কথা শুনেই বদিউল আলম মজুমদার, ড. আকবর আলী খান, ড. ইফতেখারুজ্জামান, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ অনেক বুদ্ধিজীবী সমস্বরে বলতে থাকলেন, ‘সব শেষ, দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে’।

পদ্মা সেতু নির্মাণের পর বুদ্ধিজীবীদের মুখে এবার ভিন্ন সুরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল। পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় নাকি ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতুর চেয়ে অনেক বেশি। সত্যিই বেশি ছিল, কারণ পদ্মা সেতু দ্বিতল বিশিষ্ট, খরচ বেশি হবেই। বহুতল ভবনের ভিত তৈরির খরচও বেশি। দ্বিতল বিশিষ্ট পদ্মা সেতুতে সড়ক ও রেলপথ ছাড়াও গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন বসানো হয়েছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি স্রোত দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীতে, তারপরই পদ্মা। স্রোত যত তীব্র হবে, নদী শাসন ও নির্মাণ কাজের ব্যয় তত বৃদ্ধি পাবে। পদ্মা এবং ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতুর দৈর্ঘ্য সমান হলেও পদ্মা সেতুর প্রস্থ প্রায় দেড়গুণ বেশি। ভূপেন হাজারিকা সেতুর পাইল লোড নেওয়ার ক্ষমতা মাত্র ৬০ টন, আর পদ্মা সেতুর পাইল লোড ৮২১০ টন।

ভূপেন হাজারিকা সেতুর একটি পিলারের ওজন ১২০ টন, অন্যদিকে পদ্মা সেতুর পিলারের ওজন ৫০ হাজার টন। পদ্মা সেতুর ৪০ তলা ভবনের সমান পাইলিং এবং তার জন্য ব্যবহৃত শক্তিশালী হাতুড়ি, যা পৃথিবীর অন্য কোন সেতু নির্মাণে ব্যবহৃত হয়নি। ভূপেন হাজারিকা সেতুর নদী শাসনে কোনো খরচ হয়নি; কিন্তু পদ্মা সেতুতে ১৬ কিলোমিটারজুড়ে নদী শাসনে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তারপরও মূল সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের খরচ ছিল অনেক। বিশ্ব ব্যাংক অর্থ না দিলেও ২০১১ সনে তারা পদ্মা সেতুর নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরেছিল ৩০০ কোটি ডলার। পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি খরচ হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ২০১ কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর সংযোগ সড়ক প্রকল্পে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের দ্বিগুণের বেশি, অর্থাৎ ৪৭৬ কোটি টাকা। কিলোমিটার প্রতি বেশি ব্যয় হলেই দুর্নীতি হয় না, এই ব্যয়ের সঙ্গে গৃহীত ঋণ ও ঋণের শর্ত বিবেচ্য। আওয়ামী লীগ আমলের ভারতে আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্পটির দুর্নীতির নিয়ে শোরগোল উঠেছিল সবচেয়ে বেশি; এখন শোনা যাচ্ছে এই প্রকল্পে কোন অনিয়ম হয়নি।

মাত্র কিছুদিন আগে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির রেলের ইঞ্জিনিয়ার এবং রেলের প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সেনাবাহিনীকে প্রকল্পের খরচ কমাতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু অনুরোধ কেন? এখন স্বৈরশাসন নেই, দুর্নীতি নেই, তাহলে যথাযথ ব্যয় প্রাকল্লন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলের ১০টি প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে ৪৬ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা হ্রাস করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু এই ব্যয় সাশ্রয় অতিরিক্ত প্রাক্কলন থেকে, না প্রকল্প থেকে অপ্রয়োজনীয় কাজ বাদ দেওয়ার কারণে এসেছে তার উল্লেখ দেখিনি। দুটির তাৎপর্য দুরকম। প্রকল্পের কোনো অংশ বাদ দেওয়া হলে তা শুধু গুরুত্ব বিবেচনায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত। আর যদি দুর্নীতির উদ্দেশ্যে ব্যয় প্রাক্কলন বেশি করা হয় সেজন্য এখনো সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়। না আনা হলে বুঝতে হবে, ওই ১০টি প্রকল্পে বেশি ব্যয় প্রাক্কলনে দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা ছিল না।

পদ্মা সেতুর মতো একই অভিযোগ উঠেছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে, এর নির্মাণ ব্যয় থেকে ভারতের কুদানকুলামের তৃতীয় ও চতুর্থ ইউনিট পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় নাকি কম। কম তো হবেই, কারণ কুদানকুলামে প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণকালীন তৃতীয় ও চতুর্থ ইউনিটের অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করায় পরবর্তীতে অবকাঠামো নির্মাণে আর কোন খরচ হয়নি; কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে নদীর তীরে একটি ‘গ্রিনফিল্ড প্রকল্প’ যার পুরো অবকাঠামো শূন্য থেকে নির্মাণ করতে হয়েছে। রূপপুর প্রকল্পের নির্মাণ, ইন্সটলেশন ও কমিশনিং ব্যয় করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসাটম; অন্যদিকে ভারতীয় প্রকল্পে নির্মাণ ও কমিশনিং ব্যয়ের দায়িত্ব ছিল ভারতের।নির্মাণে অধিক ব্যয়ের অভিযোগ ছাড়াও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। ‘গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প’ নামের ওয়েবসাইটে গত ১৭ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এই অভিযোগ আদালতেও উত্থাপিত হয়েছে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার; এর মধ্য থেকে ৫০০ কোটি ডলার দুর্নীতি হয়ে গেলে ধরে নিতে হবে যে, অবশিষ্ট মাত্র ৭৬৫ কোটি ডলার দিয়ে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সারসংক্ষেপ থেকে ধারণা করা যায় যে, এই অর্থ পাচার হয়েছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। লন্ডনে ৭ লাখ পাউন্ড মূল্যের যে ফ্ল্যাট টিউলিপ সিদ্দিক পেয়েছেন সেটি নাকি ক্রয় করা হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে গৃহীত দুর্নীতির টাকা দিয়ে; কিন্তু ফ্ল্যাট নাকি কেনা হয়েছে ২০০৪ সনে, আর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৩ সনে।

এই দুর্নীতি নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য হচ্ছে- ‘গুজব’ ও ‘মিথ্যা’। অর্থায়নসহ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা রোসাটম। রোসাটমের বক্তব্য হচ্ছে, প্রকল্পের জন্য এলসির মাধ্যমে যে সকল পণ্য, সেবা বা পরিষেবা আমদানি করা হয়েছে তার মূল্য অনুমোদিত ঋণ থেকে পণ্য ও সেবা সরবরাহকারীকে সরাসরি পরিশোধ করেছে রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়।এই প্রকল্পের কোন অর্থ বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া হয়নি এবং এজন্য এই প্রকল্প থেকে তৃতীয় পক্ষের অর্থ আত্মসাতের কোনো সুযোগও নেই।

রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত এবং রোসাটমের বক্তব্যের পরও দুদকের অনুসন্ধান চলছে। এ ছাড়াও রাজধানীতে প্লট থাকার পরও রাজউক থেকে পূর্বাচলে প্লট গ্রহণ করায় গত মার্চে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তাদের সন্তানসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। অন্যদিকে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রাজউক প্লট বরাদ্দ দেয় সংস্থাটির অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ড রুলস, ১৯৬৯ অনুসারে। কিন্তু ১৯৮৬ সনে বিধিটি সংশোধন করে নতুন একটি উপবিধি বলে সংরক্ষিত কোটায় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া শুরু করে। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদেরও সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই কোটা প্রথা সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাতিল করেছে। বাতিল করলেও ১৯৮৬ সন থেকে এই সংরক্ষিত কোটায় অসংখ্য ব্যক্তি প্লট পেয়েছেন; কিন্তু সরকার শুধু বিগত ১৫ বছরে যারা প্লট-ফ্ল্যাট পেয়েছেন তাদের তালিকা করছে। রাজধানীতে নিজের বাড়ি ফ্ল্যাট বা প্লট থাকা সত্ত্বেও ১৯৮৬ সন থেকে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি প্লট পেয়েছেন তার তালিকা প্রকাশ করলে বিষয়টির স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হতো।

দুর্নীতির সঙ্গে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট হলে দুর্নীতির উচ্ছেদ কখনোই হবে না। দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে দুর্নীতির অনুসন্ধান হবে একতরফা, নিরপেক্ষভাবে দলমত নির্বিশেষে দুর্নীতির অনুসন্ধান করা একমাত্র অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদের প্রারম্ভিক সূচনা হোক- এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ