হত্যা মামলা ও মব সন্ত্রাস এখন সাংবাদিক নিপীড়নের নয়া হাতিয়ার
নজরদারি নিয়ে লেখা বিশ্বখ্যাত ডিস্টোপিয়ান বা কাল্পনিক অবিচার ও কর্তৃত্ববাদ নিয়ে লেখা উপন্যাস ১৯৮৪ এর লেখক জর্জ ওরওয়েল সাংবাদিকতা নিয়েও কালোত্তীর্ণ অনেক মত প্রকাশ করেছেন। সেগুলোর একটি হলো ‘সাংবাদিকতা হলো এমন কিছু প্রকাশ করা, যা অন্য কেউ প্রকাশ করতে চাইবে না। আর বাকি সব কিছু জনসংযোগ।’ আসলেই তাই, সাংবাদিকের কাজই চেপে রাখা তথ্য, জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য, গোপণীয় কর্মকাণ্ড প্রকাশ করা। সাংবাদিকের লক্ষ্যই হলো অন্যায়-অসঙ্গতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা, প্রশ্ন করা। একজন সাংবাদিকের ব্রতই হলো পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করে মানুষকে প্রতারিত ও বঞ্চিত হওয়া থেকে রক্ষা করা। কিন্তু ক্ষমতাসীন, উচ্চপদস্থ কর্তা, বিভিন্ন বাহিনীর পদাধিকারী, অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করাটাই কঠিন কাজ। ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজটিই সাংবাদিককে করতে হয়। প্রক্রিয়া মেনে অনুসন্ধান করতে হয়, সূত্র মেলাতে হয়, অনেক নির্ঘুম রাতে পারিশ্রম করতে হয়। তাতেই পাঠকের সামনে আসে এস আলম গ্রুপের টাকা পাচার, আয়নাঘরের আর্তনাদ, মন্ত্রীর ৫০০ শতাধিক বসতঘর, টেলিকম খাতের স্বেচ্ছাচার ও সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির হেলিকপ্টার ভ্রমণবিলাসসহ নানা শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায় ন্যায়-নীতি ও আইনের শাসন।
জনকল্যাণমুখী এই পেশাগত দায়িত্বের বিপরীতে শেখ হাসিনার আমলে আমরা এক শ্রেণির তোষামোদকারী সাংবাদিকদের দেখেছি। যারা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে ম্যাজিক লেডি বলতেন, স্তুতি-বন্দনায় ডুবিয়ে ফেলতেন, সরকারের সমালোচক অন্য সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদকেও হেয় প্রতিপন্ন করতেন যখন-তখন। সরাসরি সম্প্রচারিত সংবাদ সম্মেলনে তাচ্ছিল্য করতেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের। কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্রের সম্পাদককে তো রীতিমতো রাষ্ট্রের এক নম্বর শত্রু হিসেবে গণ্য করা হতো। এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বানও শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন একদল সাংবাদিক। এটা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে কলঙ্ক। একটি কালো অধ্যায়। বিশ্বে কোথাও এর নজির আছে বলে আমার মনে হয় না। যদিও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এই চর্চা বন্ধ হয়েছে বলে মনে হয় না। এখন আমরা দেখি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিকে ম্যাজিক ম্যান, ম্যাজিশিয়ান বলে আখ্যায়িত করার প্রবণতা। যদিও রাষ্ট্রীয় বড় পদে থেকে ক্রমাগত স্বার্থগত দ্বন্দ্বের বিষয়গুলোতে গুরুতর অপরাধমূলক সিদ্ধান্ত নিলেও বর্তমানে গণমাধ্যমে সেখানে নিশ্চুপ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান শেখ হাসিনার প্রতাপশালী শাসন দূর্গ গুঁড়িয়ে দিয়েছে। গণভবনের তোষামুদে সংবাদ সম্মেলন এখন ঘৃণ্য অতীত। সুযোগ ছিল সামনে এগিয়ে যাওয়ার। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকের স্বার্থ রক্ষায় নতুন মাইলফলক স্থাপন করার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা উল্টো পথে হাঁটতে দেখছি। হ্যাঁ, এটা সত্য শেখ হাসিনার অনেক সভাসদ সাংবাদিক অনেক অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন, সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, হয়তো অর্থও পাচার করেছেন। এসব নিঃসন্দেহে বড় অপরাধ। এসব অপরাধের বিচার অবশ্যই করতে হবে; কিন্তু আওয়ামী লীগ সমর্থক সাংবাদিক বা আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী একজন সংবাদকর্মী যাত্রাবাড়ীতে গিয়ে আন্দোলনকারীদের হত্যা করেছেন- এটা নিছকই কল্পনা। এই গালগল্প কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে না; কিন্তু এ রকম গালগল্প ও অবিশ্বাস্য মামলাতেই পেশাদার সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে, জেলে ঢুকানো হয়েছে। ভীতি তৈরি করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে গায়েবি মামলায় সাংবাদিক নিপীড়ন শুধু বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষের অভিযোগ নয়। বিশ্বে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার এর ২০২৫ সালের প্রদিবেদনেও উঠে এসেছে এই নিপীড়নের প্রসঙ্গ। সংস্থাটির প্রদিবেদন অনুযায়ী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৩০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে। যাদের মধ্যে পাঁচজন কারাগারে আছেন। বিষটিকে মুক্ত গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। শুধু এই সংস্থা কেন বাংলাদেশের বিবেকবান সাংবাদিকরাও এই নির্বিচার গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের এক আলোচনায় সম্পাদক পরিষদের সভাপতি এবং দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেছেন 'শেখ হাসিনার সরকার এত জনধিকৃত হয়েছিলেন, তার অন্যতম কারণ ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকা। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অনেক আইনের ভুক্তভোগী হয়েছিলাম।’ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন ‘বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা-সংশ্লিষ্ট কোনো অপরাধের মামলা চলছে। এটা কীভাবে সম্ভব? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ২০০ বা এর কিছু বেশি সাংবাদিকের নামে মামলা হয়েছে। অথচ আজকে ২৬৬ জন সাংবাদিক খুন অথবা সহিংসতা-সংশ্লিষ্ট অপরাধের আসামি। এটা সাংবাদিকতা এবং আমাদের সবার জন্য অসম্মানের।’ নিঃসন্দেহে এই গায়েরি মামলাগুলো রাষ্ট্রের জন্য, সাংবাদিকদের জন্য অসম্মানের। একইসাথে মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন।
হ্যাঁ আওয়ামী সমর্থক বা আওয়ামী লীগের থেকে সুবিধাভোগী সাংবাদিকরা যে কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী হলে অবশ্যই তার বিচার করতে হবে। অবৈধ সম্পদ অর্জন থেকে অন্যান্য অপরাধেরও তদন্ত করতে হবে যথাযথভাবে; কিন্তু বিনা বিচারের মাসের পর মাস তাদের আটকে রাখা অন্যায়। মানবাধিকারের লঙ্ঘন। অন্তর্বর্তী সরকারের উদেষ্টা পরিষদে সংবেদনশীল মানবাধিকার কর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞ থাকার পরও কেন এমন মানবাধিকার লঙ্ঘন তা সত্যিই বিস্ময়কর!
পাঁচ আগস্ট ২০২৪ এর পর থেকে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার পরিবেশ ও স্বাধীনতাকে ভয়াবহভাবে সংকুচিত করেছে মব সন্ত্রাসের শঙ্কা। অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পরপরই বেশ কিছু গণমাধ্যম উন্মত্ত মবের আক্রমণের শিকার হয়েছে। এরপর মব তৈরি করে অনেক সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। মব তৈরি করে সাংবাদিককে তার কর্মস্থল ও রাস্তা-ঘাটে হেনস্তা করা হয়েছে। মব সন্ত্রাসে ভীত হয়ে সংবাদ সম্প্রচার বন্ধ রেখেছিল একটি টেলিভিশন চ্যানেল।
সবশেষ জানা যাচ্ছে মব সন্ত্রাসের এক ভীতিকর প্রেক্ষাপটে দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র দৈনিক জনকণ্ঠে একটি অস্বাভাবিক পালাবদল ঘটেছে। যা রীতিমতো ভীতিকর এক দৃষ্টান্ত। সংবাদমাধ্যম দখল ও সাংবাদিকদের দমনের এই চর্চা বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থগুলোর দৃষ্টিও এড়ায়নি। ২০২৫ সালের আগস্ট মাসে ইউএনডিপি, ইউনেস্কো ও সুইজারল্যান্ডের উন্নয়ন সংস্থা মিলে ‘Bangladesh’s Media Landscape: An Assessment of FREE, INDEPENDENT AND PLURALISTIC MEDIA’ শিরোনামের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। তাতে বাংলাদেশের বর্তমান গণমাধ্যম পরিসর সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘Journalists operated under significant threat, facing legal harassment, physical attacks, and arbitrary detention under broadly framed laws such as the ICT Act and the Digital Security Act (DSA) and its successor the Cyber Security Act (CSA).’
এই গবেষণায় মব সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করা না হলেও ব্যবহার করা হয়েছে significant threat শব্দটি। যা নিশ্চিতভাবেই গণমাধ্যমে মব সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্যকে নির্দেশ করে। এছাড়া সাংবাদিকদের হয়রানি, শারীরিক আঘাত ও জোরপূর্বক স্বেচ্ছাচারি আটক চলছেই। এছাড়া আইনগতভাবেও সাংবাদিকরা যে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন সেই বিষয়টিও উঠে এসেছে এই গবেষণা প্রতিবেদনে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বাজিয়ে যাচ্ছেন একই গান ‘ এই সরকারের সময় সাংবাদিকেরা সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে।’ মনে রাখা প্রয়োজন গত ২০ বছরে বাংলাদেশে যত জন তথ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের প্রেস বিভাগে নিযুক্ত ছিলেন তাঁরাও একই গান শুনিয়েছেন বাংলাদেশের জনগণকে।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের বহু অর্জন হেলায় নষ্ট হয়েছে। দিন শেষে গণমানুষ কোন সুফল পাননি। কোন প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি, মানবাধিকারের মানদণ্ড স্থাপিত হয়নি। বরং প্রতিশোধের হিংস্র উদাহরণ স্থাপিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কলকিঙ্কত হয়েছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি।
মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে সাংবাদিক নিপীড়ন ও দমন দেশবাসী প্রত্যাশা করে না। কারাগারে বন্দি সাংবাদিকদের জামিন পাওয়াও অধিকার আছে। তাদের জামিন দিন। অবিলম্বে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা প্রত্যাহার করুন। এইসব মামলা ও নিপীড়নের জন্য দেশে-বিদেশে এরইমধ্যেই বাংলাদেশের কপালে কলঙ্ক তিলক জুটেছে। আর নয়, প্লিজ।
রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে