Views Bangladesh Logo

গ্রাম্য আধিপত্যের লড়াইয়ে গুটি হলো মুরাদনগরের সেই নারী

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

কুমিল্লার মুরাদনগরের গত ২৬ জুন রাতে ফজর আলী নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ সময় স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ঘটনাস্থলে গিয়ে ফজর আলীর পাশাপাশি ওই নারীকেও মারধর করেন। একপর্যায়ে ওই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ভিডিওটি ভাইরাল হলে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে, সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান নেটিজেনরা। পরে এ ঘটনায় থানায় দুটি মামলা করেন ভুক্তভোগী। অভিযুক্ত ফজর আলীকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তবে পুরো ব্যাপারটি নিয়েই তৈরি হয় এক ধরনের ধোঁয়াশা।

ঘটনাটিকে ঘিরে স্থানীয় রাজনীতি, গ্রাম্য আধিপত্য, সুদের কারবার, বালুর ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের এক জটিল সমীকরণ উঠে এসেছে ভিউজ বাংলাদেশের অনুসন্ধানে। সরেজমিন জানা যায়, নারী নির্যাতনের এ ঘটনার পেছনে রয়েছে গ্রাম্য আধিপত্য বিস্তারের নীলনকশা আর প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ছক। প্রথমেই ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে কথা হয় বাহেরচর গ্রামের বাসিন্দা সেই ভুক্তভোগী নারীর। তিনি জানান ফজর আলী তাদের পূর্ব পরিচিত এবং তার পরিবার অভিযুক্তের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৪ হাজার টাকা সুদের বিনিময়ে ৫০ হাজার টাকা ধার নেয়।

তিনি বলেন, ‘ফজর আলী পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণের উদ্দেশ্যেই বৃহস্পতিবার রাতে সেই টাকার তাগাদা দেবার কথা বলে আমাদের ঘরে প্রবেশ করে এবং আমাকে ধর্ষণ করে। এ সময় স্থানীয় মোহাম্মদ আলী ওরফে সুমন, রমজান আলী, মো. আরিফ ও মো. অনিকসহ অনেকেই এসে উপস্থিত হয়। তারা ফজর আলীর পাশাপাশি আমাকেও নির্যাতন করে এবং আমার বিবস্ত্র ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়।’

তিনি জানান, তার বিয়ে হয়েছে ১২ বছর এবং তার স্বামী মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কাজ করেন। ঘটনার পর থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিষয়ে তার স্বামীর সঙ্গে তার কোনো আলাপ হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনায় শুক্রবার মামলা করে সোমবার পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনায় বিচার চাইলেও সোমবার বিকেলে মামলা তুলে নিতে চান এই ভুক্তভোগী নারী। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না বুঝেই এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা না বলেই মামলাটি করেছিলাম, তাই এখন ঝামেলা এড়াতে মামলাটি তুলতে চাচ্ছি।’ ঘটনাটি নিয়ে তিনি আর কথা বলতে চাননি।

এই কথোপকথনের কিছুক্ষণ পরেই জানা যায়, পাশবিক নির্যাতনের শিকার সেই নারী বাবার বাড়ি থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোমবার বিকেলে ভুক্তভোগী নারী তার স্বামীর বাড়ি যাবেন বলে বাবার বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। পুলিশের সহযোগিতায় তিনি দুই সন্তানকে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। এরপর তার মা-বাবাসহ পরিবারের লোকজনও অন্যত্র চলে যান। স্থানীয়দের কাছে ঘটনার দিন রাতে ঠিক কী ঘটেছিল, সে ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেন, ভুক্তভোগী নারী এই ঘটনার ১৫ দিন আগে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তার বাবার বাড়িটি নদীর কাছাকাছি কিছুটা নিরিবিলিতে।

বাড়িতে পাশাপাশি দুটি ঘর রয়েছে, একটিতে নারীটির বাবা এবং আরেকটিতে তার চাচারা বসবাস করেন। ঘটনার দিন রাতে পূজা থাকায় বাড়ির অন্যান্য সদস্য কেউ বাড়িতে ছিলেন না, এ সময় ফজর আলী সেখানে প্রবেশ করে এবং একপর্যায়ে মোহাম্মদ আলী ওরফে সুমনের নেতৃত্বে এলাকার ১৫-২০ জন যুবক সেখানে এসে ভুক্তভোগী নারীটিকে নির্যাতন করে এবং তার ভিডিও ধারণ করে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সুমনের নেতৃত্বে যারা এই বাড়িটি ঘিরে ভুক্তভোগীকে নির্যাতন করে, তাদের সঙ্গে ফজর আলীর পূর্ব শত্রুতা ছিল এবং তাদের সবার বাড়িই ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে। এতদূর থেকে ধর্ষণের ঘটনা তারা কীভাবে জানতে পেল, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই বেরিয়ে আসে ফজর আলীর সঙ্গে আবুল কালাম নামের আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তির শত্রুতার কথা। এলাকাবাসীর দাবি, ফজর আর কালামের আধিপত্যের দ্বন্দ্বে গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন ভুক্তভোগী নারী।

স্থানীয়রা জানান, পেশায় কাঠমিস্ত্রি হলেও স্থানীয়ভাবে ফজরের পরিবার প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। এলাকার বালু ব্যবসা তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। তারা বলেন, ফজর সুদের ব্যবসা ও জুয়ার সঙ্গেও যুক্ত। ফজর আলীর বিরুদ্ধে এর আগেও একটি ব্যাংক কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ ছিল, তার বিচার এখনো ঝুলে আছে। অন্যদিকে কালামও দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কালাম বালু এবং মাটির ব্যবসা করে আওয়ামী লীগ আমলে বেশ অর্থ-বিত্তের মালিক হন। এদিকে ২০১৪ সালে নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সুবাদে ফজরও ঢুকে পড়ে বালুর ব্যবসায়।

আধিপত্য বিস্তারের জের ধরেই তাদের মধ্যে ২০১৪ সাল থেকেই চলছে রেষারেষি। এর আগ পর্যন্ত তারা বন্ধু হিসেবেই পরিচিত ছিল এলাকায়। একাধিক ব্যক্তি বলেন, ফজর আলী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ৫ আগস্টের পর এলাকায় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। মূলত গ্রামে তাদের পরিবারের ব্যাপক প্রভাব এবং জনবল বেশি থাকায় খুব সহজে সে দল পরিবর্তন করে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এ ব্যাপারে স্থানীয় বিএনপি একটি যৌথ বিবৃতি দিয়ে জানায় ফজরের সঙ্গে দলটির কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

স্থানীয়দের দাবি, আবুল কালাম তার আধিপত্য ধরে রাখতে প্রতিপক্ষ ফজর আলীর বিরুদ্ধে ফাঁদ পাতে। কালাম জানত, ভুক্তভোগীর বাবার বাড়িতে যাতায়াত ছিল ফজরের। কালামের আদেশেই সুমনরা ওত পেতে বসে থাকে ভুক্তভোগীর বাড়ির পাশে। এক পর্যায়ে তারা ফজর আলীকে ওই নারীর সঙ্গে ধরে এবং ঘটনার ভিডিও ও ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এরপর ভুক্তভোগীকে ধর্ষণের অভিযোগ করতে প্ররোচিত করা হয়।

এ ব্যাপারে একাধিক প্রতিবেশী বলেন, এটি পরিকল্পিত ঘটনা। তা না হলে বিষয়টি প্রথমে পাশের বাড়ির লোকজন টের পেত। পূর্বপরিকল্পিত না হলে গ্রামের অপর প্রান্তের লোকজন কীভাবে বিষয়টি প্রতিবেশীদের আগে টের পেল, এমন প্রশ্ন তাদের। ভুক্তভোগীর বাড়িতে ফজর আলীর নিয়মিত যাতায়াতের বিষয়ে খোঁজ করতে গেলে এলাকাবাসী বলেন, তারা অনেক আগে থেকেই ফজরের এই গতিবিধি সন্দেহের চোখে দেখেন। ভুক্তভোগীর সঙ্গে ফজরের সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগ ওঠে দুই বছর আগেই। তখন সামাজিকভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া।

এ বিষয়ে গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বিচার নিষ্পত্তির বিষয়ে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘ওই নারী ও ফজর আলীর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে দুই বছর আগেই একবার বিচার নিষ্পত্তি করা হয়। এ ছাড়া ওই পরিবারের সঙ্গে ফজর আলীর আর্থিক লেনদেন রয়েছে। সেই সুবাদে ফজর আলী ওই বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করত।’

এদিকে বাহেরচর এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুর রউফ বলেন, ‘ফজর আলী একটা খারাপ লোক। এলাকায় বিভিন্ন নারীদের পেছনে ঘুরে ঘুরে অপকর্ম করাই তার কাজ। এটা এলাকার সবাই জানেন।’ এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী নারীর সঙ্গে পরবর্তীতে কথা বলা সম্ভব হয়নি কারণ তার পরিবারের কাউকেই আর বাড়িতে পাওয়া যায়নি। যোগাযোগ করা হলে ফজর আলীর বাবা শহীদ মিয়া ও ভাবি রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘ফজর আলী কোনো অন্যায় করেনি। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। এলাকার লোক ভালো করেই জানে কী হচ্ছে।’

এদিকে, আবুল কালামের বাবা আবদুল হান্নান ও বোন হ্যাপি আক্তার বলেন, 'ফজর আলী এলাকার সন্ত্রাসী। এ ঘটনার পরে কালামের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। আমরা থানায় জিডি করব।' মুরাদনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাহিদুর রহমান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, 'পুরো বিষয়টি তদন্তাধীন। আমরা উভয় পক্ষের বক্তব্য নিচ্ছি। ঘটনা যেটাই হোক, ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকে যারা ছড়িয়েছে, তারা অন্যায় করেছে। নারীটির প্রতি অত্যাচার হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, 'আমরা নারী নির্যাতন ও পর্নোগ্রাফি আইনের মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছি। আমরা এরই মধ্যে আরও কয়েকজনকে শনাক্ত করেছি। তারা সবাই এলাকা থেকে পালিয়েছেন। তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত।’ এদিকে, গ্রেপ্তার চার যুবককে- সুমন, রমজান আলী, মো. আরিফ ও মো. অনিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছে পুলিশ। কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১১ নম্বর আমলি আদালতের বিচারক মমিনুল হক আজ বৃহস্পতিবার রিমান্ড শুনানির তারিখ ধার্য করেছেন।

ভুক্তভোগী সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় ধর্ষণ মামলা প্রত্যাহার বিষয়ে ভিউজ বাংলাদেশ কথা বলে ইউনিয়ন পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সদস্য বিপ্লব কুমার সাহার সঙ্গে। এটিকে তিনি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, 'আমি মনে করি এই ঘটনায় করা কোনো মামলাই প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। পূজা কমিটি নিরপেক্ষ তদন্তের পক্ষে।’ তবে হিন্দু মহাজোটের পলাশ কান্তি দে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা ভিকটিম পরিবারের পাশে আছি। তবে প্রশাসনকে অনুরোধ করছি, যেন ঘটনাটি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক রূপ না নেয়। তদন্ত নিরপেক্ষ হতে হবে।

সরেজমিন দেখা যায়, বাহেরচর গ্রামটি তুলনামূলকভাবে রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল। এখানকার মানুষের মূল পেশা কৃষি হলেও ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী ২০ শতাংশের বেশি মানুষ মৎস্যজীবী। তুলনামূলকভাবে শিক্ষার হার এ অঞ্চলে কম হওয়ার কারণে ফজর ও আবুলের মতো ব্যবসায়ীদের প্রভাব এখানে অনেক। অভাব-অনটনে জর্জরিত এলাকার মানুষ এনজিও এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত ঋণ নেন।

এই ঋণ আদান-প্রদানকে কেন্দ্র করে নানারকম সামাজিক সংকট দেখা যায়। এলাকার স্থানীয় কিছু যুবক জানান, ভুক্তভোগী নারী ঋণ-সংক্রান্ত এরকম কোনো ঘটনার জালে আটকে যেতে পারেন। তারা ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ