Views Bangladesh Logo

একই নম্বরে চলা একাধিক যানবাহন বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনা-অপরাধ

যানবাহনের নম্বরপ্লেট টেম্পারিং করে অপরাধকর্ম চলছে বহুদিন ধরে। বাড়তি লাভের আশায় অভিনব কৌশলে একাধিক গাড়িতে একই নম্বরপ্লেট ব্যবহার করছেন বাসমালিকরা। পরিচয়বিহীন গাড়িগুলো প্রায়শই ফিটনেসবিহীন হয় যা দুর্ঘটনা ও ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রও হারাচ্ছে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব।

প্রযুক্তির অপব্যবহারে এ জালিয়াতিতে রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের কারও কারও যোগসাজশেরও অভিযোগ। এমনকি যানগুলোকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক-মহাসড়কগুলোতে দাঁপিয়ে বেড়াতে সহায়তাও করছেন তারা।

সাভারের আমিনবাজারের কয়েকটি ওয়ার্কশপে ঘুরে অভিযোগ পাওয়া গেছে, পুরোনো গাড়ির নম্বরপ্লেট রহস্যজনকভাবে চলে যাচ্ছে নতুন গাড়িতে। ভাঙাচোড়া গাড়িগুলো নতুন রূপে ফিরছে একই নম্বরপ্লেটে। অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নতুন বডি তৈরি করেও দিচ্ছেন বডি নির্মাতারা। পুরোনো গাড়ির কাঠামো ব্যবহারে সম্পূর্ণ নতুন গাড়ির রূপ দিচ্ছেন তারা। ইঞ্জিন, চেসিসের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ভেতরের সব সরঞ্জামও। কেবল অপরিবর্তিত থাকছে পুরোনো নম্বরপ্লেট, যেটি একই সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে একাধিক গাড়িতে।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই নম্বরপ্লেট টেম্পারিংয়ে যোগসাজশ রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কিছু অসাধু প্রশাসনিক কর্মকর্তারও। তাদের সহযোগিতায়ই নির্বিঘ্নে চলছে অবৈধ কার্যকলাপও।

তথ্য বলছে, গত মে মাস পর্যন্ত দেশজুড়ে ৬৩ লাখ ৯৮ হাজার ৯৯৮টি যানবাহনের নিবন্ধন দিয়েছে ১৯৮৭ সালে কার্যক্রম শুরু করা বিআরটিএ। এর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা মেট্রো নম্বরেই যুক্ত রয়েছে ২২ লাখ ৬০ হাজার ৯২২টি গাড়ি। সবচেয়ে বেশি বাস নিবন্ধিত হয়েছে ২০১৬ সালে তিন হাজার ৮৩২টি, যার তিন হাজার ৪৮৭টিই নিবন্ধন পেয়েছে কেবল ঢাকা মহানগরীতে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে ঢাকা মেট্রো-ব-১২-৩৭৯২ নম্বরের একটি বাসের নিবন্ধন নিয়েছে ইফাদ মোটরস লিমিটেড। তবে নম্বরটি একইসঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে দুটি বাসে। একটি চলছে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ‘জেড এন্ড এল এক্সপ্রেস’ নামে অন্যটি ঢাকা-সৈয়দপুর সড়ক দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘সেন্টমার্টিন সি ভিউ এক্সপ্রেস’ নামে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস দুটির মালিকও একই ব্যক্তি আনোয়ার হোসেন। সেগুলোর খোঁজ মিলেছে সাভারের আমিনবাজারে আনোয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে, যেটির মালিকও তিনি।

পাশের এভারব্রাইট মটরসেও রয়েছে ‘এ কে ট্রাভেলস’ পরিবহনের বেশ কয়েকটি বাস। এ বহরে থাকা ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৬০৭৩, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৬৩৯৭, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৬৩৯৮, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৬৩৯৯, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৬৫২০, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৬৬৯৭, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৬৬৯৮, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৬৬৯৯ ও ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৬৭৯৮ নম্বরের গাড়িগুলোর মালিক কাশেম গ্রুপ। তবে এগুলোর নিবন্ধন ২০১২ সালে নেয়া হলেও বডি তৈরি হয়েছে মাত্র দুই বছর আগে।

বিআরটিএর তথ্য বলছে, নিবন্ধনের সময় যানগুলোর চেসিস ছিল জাপানের হিনো আরএম ২ মডেলের। তবে একই নম্বর ব্যবহার করলেও এখনকার গাড়িগুলোতে পাওয়া গেছে ভারতের অশোক লেল্যান্ডের চেসিস। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এসব নম্বর ছিল পুরোনো অন্য কোনো বাসের। সেগুলোই ব্যবহৃত হচ্ছে দুই বছর আগে এসি পরিবহনে রূপান্তরিত নতুন বাসগুলোতে। বিআরটিএর কাছে যার কোনো তথ্য নেই।

এদিকে ‘প্যালেস্টাইন ট্রাভেলস’ পরিবহনের দুটি স্লিপার বাসও চলছে একই নম্বরপ্লেটে। ঢাকা মেট্রো-ব-১১-১ঌ৮৭ নম্বরের গাড়ি দুটি দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে গাজীপুর-কক্সবাজার মহাসড়ক।

ইফাদ মটরস লিমিটেডের কর্মকর্তা সাইফুর ইসলাম মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমরা গাড়ি ঋণের মাধ্যমে মালিকদের দিয়ে দেই। ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের নামে থাকে। তবে অনেক মালিক সেই সুযোগে তাদের অন্য কোনো গাড়িতে একই নম্বরপ্লেট ব্যবহার করেন। আসলে আমাদের কার্যক্রম সীমিত। তবু খোঁজ পেলে গাড়ি আটকে রাখি। তবে যাদের নজরদারির দায়িত্ব, তারাই গাড়ি ছেড়ে দেন।’

নিরাপদ সড়ক চাই (নিচসা) ধামরাই আঞ্চলিক শাখার সভাপতি নাহিদ মিয়া বলেন, এই প্রবণতা বন্ধ না হলে সড়কপথে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। দুর্ঘটনা বাড়বে, অপরাধীরা আরও সাহসী হবেন। প্রশাসনকে আরও কঠোর হয়ে এই অসাধু চক্রকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

পরিবহন ব্যবসায়ী জিএম মিন্টু বলেন, ‘অধিকাংশ দূরপাল্লার পরিবহনের একাধিক বাসে একই নম্বর ব্যবহার করা হয়। কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে দেখা যায়, একই বাস অন্য স্থানেও আছে। তখন কারও কিছু করার থাকে না। আবার একটি গাড়ির নবায়ন প্রতি বছরই করতে হয়। সে সময় গাড়িটিও নিয়ে যেতে হয়। তারা একটি গাড়ি দেখিয়ে অন্যগুলোতেও একই নম্বরপ্লেট ব্যবহার করছেন। এতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকারও।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের (সড়ক যোগাযোগ) প্রফেসর ড. এম শফিক উর রহমান বলেন, ‘প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে এই অপকর্ম করছেন মালিকরা। বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তারাও এতে জড়িত থাকায়ই সাহস পাচ্ছেন তারা। ঝুঁকিতে ফেলছেন সাধারণ মানুষকে, রাজস্ব বঞ্চিত করছেন সরকারকে। আইনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষও।’

‘তাই, সড়কের এসব বিপদ থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। জনসচেতনতা এবং প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপই পারে এই অরাজকতা দূর করতে’- বলেন তিনি।

‘সেন্টমার্টিন সি ভিউ এক্সপ্রেস’ ও ‘জেড এন্ড এল এক্সপ্রেসওয়ে’র মালিক আনোয়ার হোসেনের বক্তব্য নিতে তার মালিকাধীন আনোয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে গেলেও পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজের পরিচয় না দিয়ে ঢাকার আরামবাগে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানেও এমন গাড়ি অনেক রয়েছে বলে সেসব গাড়ির খোঁজ নিতে বলেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ