Views Bangladesh Logo

এম শাহীনুর রহমানের গবেষণায় লোকসংস্কৃতির বহুমাত্রিকতা

ধ্যাপক ড. এম. শাহিনূর রহমান তার আন্তঃশৃঙ্খলাভিত্তিক গবেষণাকর্মের মাধ্যমে, যা লোককাহিনি, সাহিত্য এবং জাতিগত গবেষণার ক্ষেত্রজুড়ে বিস্তৃত, লোকসংস্কৃতির একজন বিশিষ্ট গবেষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শেকসপিয়রের কাজকে লোকতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্মূল্যায়ন থেকে শুরু করে ফকির লালন শাহ এবং বাংলাদেশের খাসি সম্প্রদায় নিয়ে তার মৌলিক অনুসন্ধানলব্ধ তার গবেষণাকর্ম লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রতি তার গভীর নিবেদন প্রকাশ করে। গবেষণাকর্মগুলিতে একই সঙ্গে লোকগবেষণার বিভিন্ন তত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব ও দক্ষতা অধ্যয়ন, প্রতীকবাদ এবং সংস্কৃতির টিকে থাকার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞানের প্রমাণ মেলে।

শেকসপিয়রীয় সাহিত্যের লোকতাত্ত্বিক পুনর্মূল্যায়ন
ড. এম. সালমা সুলতানার সঙ্গে যৌথভাবে রচিত Reevaluation of Folklore: Folkloric Aspects in the Works of Shakespeare (লোকতত্ত্বের পুনর্মূল্যায়ন: শেকসপিয়রের রচনায় লোকতাত্ত্বিক দিক) গ্রন্থটিতে ড. রহমান মৌখিক ঐতিহ্য, লোকবিশ্বাস ও পুরাণের আলোকে শেকসপিয়রের রচনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা লোকসংস্কৃতির মূলকে তুলে ধরেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি অভিজাত সাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতির মধ্যে প্রচলিত বিভাজনকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যা সমসাময়িক লোকতত্ত্বের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়।

গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লোকসংস্কৃতিকে মানুষের অভিব্যক্তির এক স্পন্দিত উৎস হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেন এই কথাটি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন যে লোকসংস্কৃতি সম্প্রদায়গত চেতনা তৈরি এবং গল্প বলার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার মতে, ‘লোকসংস্কৃতি কোনো স্থির বিষয় নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য।’ এই উক্তিটি দেখায় যে তিনি এমন একটি লোকতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক যেখানে লোকসংস্কৃতি সমাজের সঙ্গে পরিবর্তনশীল এবং একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংকেত স্থানান্তরিত করার মাধ্যমে নিজস্ব সত্তা বজায় রেখে বিবর্তিত হয়।

শেকসপিয়রের আখ্যানগত উৎসের বিষয়ে তার মতবাদও এই ভাবনাকে সমর্থন করে: ‘শেকসপিয়র তার রচনার জন্য লোককথা, ঐতিহাসিক বিবরণ এবং পৌরাণিক কাহিনীসহ বিভিন্ন উৎস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন।’ ম্যাকবেথে ডাইনি, হ্যামলেটে প্রেতাত্মা এবং আ মিডসামার নাইটস ড্রিম-এ পরীদের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শেকসপিয়রীয় নাটকের লোক-উৎসকে প্রকাশের আলায় এনে ড. রহমান সাহিত্যের প্রধান কাজগুলোর ওপর লোকসংস্কৃতির প্রভাব অনুসন্ধানে তার বিদ্যায়তনিক আগ্রহের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

এ ছাড়াও, ড. রহমানের প্রতীক ও দক্ষতা-মূলীয় বিশ্লেষণগুলো একজন লোকতত্ত্ববিদের গভীর উপলব্ধিকে সপ্রকাশ করে। তিনি লিখেছেন, “শেকসপিয়রের নাটকগুলোর আবেগি প্রভাব বাড়াতে... নাট্যকার নিয়মিতভাবে প্রতীকবাদ এবং আচারমূলক উপাদান ব্যবহার করেছেন।” তার এই বিশ্লেষণসমূহে দক্ষতাজনিত আচার এবং প্রতীকী যোগাযোগের মতো প্রাথমিক লোকতাত্ত্বিক আগ্রহের বিষয়গুলো অনুরণিত হয়।

তিনি তার গবেষণাকর্মকে একটি বৈশ্বিক ও আন্তঃসাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেন যখন তিনি লেখেন, “শেকসপিয়রীয় নাটকগুলোতে প্রতীকবাদ এবং আচারিক উপাদানের ব্যবহার... এর আবেগি প্রভাবকে বাড়িয়ে তোলে।” এমন তুলনামূলক বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে একজন লোকতত্ত্ববিদ হিসেবে তার ভূমিকাকে প্রমাণ করে, যদিও তিনি স্থানীয় ঐতিহ্যকেও অবহেলা করেননি।

লালনের বাউল দর্শনে মৌখিক ঐতিহ্য ও সমন্বয়বাদ
ড. রহমান তার Bengali Poet Fakir Lalon Shah: Oral Poetry and Tradition in the Social Context of Contemporary Bangladesh (১৯৯৯, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি) গ্রন্থেও একইভাবে তার লোকতাত্ত্বিক প্রভাব তুলে ধরেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার লোক সাহিত্য নিয়ে এটি অন্যতম অগ্রণী গবেষণা এবং এটি লোকবিশ্বাস ও সমন্বয়বাদী আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে তার গভীর বোঝাপড়াকে তুলে ধরে।

ফকির লালন প্রসঙ্গে ড. রহমান বলেন, “কোন কিছুই লিখিত হতো না। ঐতিহ্যটি মৌখিক, এবং তার সংগীত সাহিত্যের অনেকটাই সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেছে। লালন নিজেও কখনো কিছু লেখেননি।” এই উক্তিটি লোকতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মূল সারমর্মকে প্রকাশ করে, যা মৌখিক সংস্কৃতির উপস্থাপন এবং ব্যাখ্যার ওপর মনোযোগ দেয়, যা ছিল ক্ষণস্থায়ী, পরিবর্তনশীল এবং দক্ষতা-নির্ভর।

তিনি লালনের পরিচয়ের অসম্পূর্ণতাও বর্ণনা করেছেন: “তার পূর্বপুরুষ সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই, এবং তার গ্রামের বাড়ি এবং তিনি মুসলিম না হিন্দু ছিলেন- এসব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।” এই অস্পষ্টতা, যা আমাদের কাছে মৌখিকভাবে সংরক্ষিত ও স্থানান্তরিত হয়েছে, লোকতত্ত্বের গবেষণার মূল বিষয়, যেখানে পরিচয়, মিথ এবং ইতিহাস সম্মিলিত স্মৃতিতে মিশে যায়।

বাউল দর্শনকে ড. রহমান “বাউলিয়ানা” নামে অভিহিত করেছেন, যা মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের সন্ধানকে বোঝায়। তিনি মন্তব্য করেন, “বাউলরা একটি অসাম্প্রদায়িক, অপ্রথাগত ভক্তিমূলক ঐতিহ্যের অংশ... যা হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, বৈষ্ণববাদ এবং ইসলামি সুফিবাদ দ্বারা প্রভাবিত, কিন্তু তা সত্ত্বেও এগুলোর থেকে ভিন্ন।” এই ধরনের ব্যাখ্যা একজন লোকতত্ত্ববিদের কাজকে নির্দেশ করে, যিনি মিশ্র-বিশ্বাসজাত কাঠামোকে উন্মোচন করেন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিকল্প বিশ্বদৃষ্টি তৈরি করার উপায় খুঁজে বের করেন, যা প্রচলিত ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানায়।

“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” এবং “জাত গেলো জাত গেলো বলে” -র মতো গানের মাধ্যমে ড. রহমান আত্মা ও দেহের রূপক এবং জাত প্রথার অপব্যবহারের ব্যাখ্যা করেন। তিনি যোগ করেন, “কেন আপনি আপনার জাত প্রতিষ্ঠার জন্য এত পীড়াপীড়ি করছেন? আপনি যখন মারা যাবেন, তখন এর কী হবে?” গানের এই বিশ্লেষণধর্মী অধ্যয়নটি দেখায় যে কীভাবে তিনি লোক-দক্ষতার মধ্যে নিহিত আর্থ-সামাজিক প্রতিরোধকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন।

এছাড়াও, ড. রহমান লালনের ঐতিহ্যকে সমসাময়িক জ্ঞানী ব্যক্তিদের, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্কিত করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি তুলে ধরেন, যেখানে ঠাকুর বলেছেন: ‘এই মানুষে আছে সে মন,’ ‘মানুষ’ আপনার মধ্যেই রয়েছে, আপনি কোথায় তাঁকে খুঁজছেন? এই উক্তিটি লোকসংস্কৃতির উচ্চমার্গীয় সাহিত্যিক এবং দার্শনিক আলোচনার ওপর প্রভাব বিস্তারের প্রতি তার আগ্রহকে প্রতিফলিত করে, যা লোকতত্ত্বের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।

খাসি সম্প্রদায়ের গবেষণায় জাতিগত প্রতিফলন
প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য নিয়ে তার লোকতাত্ত্বিক গবেষণার পরিধিকে বিস্তৃত করে তার সাম্প্রতিক যৌথরচনা, Khasi Community in Bangladesh (২০২৪), সাংস্কৃতিক দলিলায়ন ও সংরক্ষণে সময় ও অর্থ বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে ড. রহমানের আগ্রহকে নির্দেশ করে। এই গবেষণার ভিত্তি মৌলভীবাজারের মাগুরছড়া পুঞ্জি এলাকার জাতিগত অধ্যয়ন, যেখানে তিনি খাসি জনগোষ্ঠীর মাতৃতান্ত্রিক কাঠামো, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান এবং রূপান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন।

লেখকদের মতে, “খাসি জনগোষ্ঠীর সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে বাইরের উৎস থেকে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন।” এই সংবেদনশীলতার স্বীকৃতি এবং অংশগ্রহণমূলক ও নৈতিক জাতিগত গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দান একজন লোকতত্ত্ববিদের গভীর জ্ঞানকে চিহ্নিত করে।

এই গ্রন্থের লেখকবৃন্দ খাসি মাতৃতন্ত্রের স্বাতন্ত্র্য উল্লেখ করে বলেন, “খাসি উপজাতির একটি উল্লেখযোগ্য মাতৃতান্ত্রিক বংশানুক্রম রয়েছে... যেখানে বংশানুক্রমিক পরিচয় শুধুমাত্র নারী রেখা অনুসরণ করে।” ড. রহমান কর্তৃক নথিবদ্ধ লৈঙ্গিক উত্তরাধিকার এবং আচারিক বিশ্বাসগুলো সংখ্যালঘু সংস্কৃতির আত্মীয়তা, ঐতিহ্য এবং পরিবর্তনের প্রতি একজন লোকতত্ত্ববিদের আগ্রহকে তুলে ধরে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, লেখকরা আধুনিকতার প্রভাবকে উপেক্ষা করেননি: “এই (খাসি) ব্যক্তিবর্গ আধুনিকীকরণ, বাজার শক্তি এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে উল্লেখযোগ্য সামাজিক রূপান্তর অনুভব করছেন।” এভাবে ড. রহমান লোকসংস্কৃতিকে কোনো বস্তুর পরিবর্তে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেন, যা বৃহত্তর ঐতিহাসিক শক্তি দ্বারা প্রভাবিত এবং এর প্রতি সাড়া দেয়, যা আধুনিক লোকতত্ত্বের একটি মূল ধারণা।

তার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট: “আমরা খাসি জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে চাই এবং আশা করি, আমাদের প্রচেষ্টা জাতিগত সংস্কৃতিতে আগ্রহী শিক্ষাবিদদের মধ্যে আলোচনাকে সমৃদ্ধ করবে।” এই উক্তিটি একজন লোকতত্ত্ববিদ হিসেবে তার লক্ষ্যকে নিশ্চিত করে- যা হলো একাডেমিক নির্ভরযোগ্যতার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ, উপলব্ধি এবং এর প্রতি উৎসাহিত করা।

উপসংহার
শেকসপিয়ারের লোক-মোটিফ, বাউল মরমীবাদ এবং খাসি জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত গবেষণার মাধ্যমে অধ্যাপক ড. এম. শাহিনূর রহমান একজন প্রকৃত লোকতত্ত্ববিদের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছেন। তার গবেষণা এই ক্ষেত্রের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করে, যথা: মৌখিকতার উপলব্ধি, মিশ্র সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, প্রতীকী ব্যাখ্যা, দক্ষতার অধ্যয়ন এবং প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে জীবিত রাখার প্রতি আগ্রহ। ড. রহমানের এই কাজগুলো ভৌগোলিক ও শৈল্পিকভাবে স্ট্রাটফোর্ডের শেকসপিয়ার এবং কুষ্টিয়ার লালন ফকিরের মধ্যে, আবার অন্যদিকে মৌলভীবাজারের মাতৃতান্ত্রিক পাহাড়ি জনসংস্কৃতি এবং বিশ্বজুড়ে ঐতিহ্য ও পরিচয় নিয়ে চলমান আলোচনার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। তিনি লোকসংস্কৃতিকে শুধুমাত্র নথিবদ্ধই করেননি, বরং এর মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন, নিজেকে জাতিতত্ত্বের একজন প্রতিষ্ঠিত, নৈতিক এবং অগ্রণী গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।



ড. মো. শহীদুল ইসলাম: সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, লালন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড আর্টস, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ