মনজুর সাদেক খোশনবীশ চলে গেলেন, রেখে গেলেন অমলিন স্মৃতি
শেয়ারবাজারবিষয়ক দেশের প্রথম জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চা’র সাবেক সম্পাদক ও প্রকাশক, বিশিষ্ট শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ মনজুর সাদেক খোশনবীশ গত ১৫ জুন রাজধানী ঢাকায় ইন্তেকাল করেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে মরণব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। মনজুর সাদেক খোশনবীশ টাঙ্গাইলে এক জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবার নাম ছাইদুর রহমান খোশনবীশ এবং মায়ের নাম খালেদা বেগম। মনজুর কাদের খোশনবীশকে আমরা যারা তার ঘনিষ্ঠ ছিলাম তারা ভাই বলে সংবোধন করতাম। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল এবং উদ্ভাবনী শক্তির একজন মানুষ। যে কোনো লোক তার সংস্পর্শে এলে মুগ্ধ হতেন।
মনজুর সাদেক খোশনবীশ ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো পূর্ব পরিচয় ছিল না। সম্ভবত ২০০৮ সালের দিকে তিনি ‘দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চা’ নামে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই সময় আমার ছোট ভাই তুল্য গোলাম মইনুর আহসান একদিন আমার অফিসে আসে এবং দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চা নামে একটি জাতীয় দৈনিক প্রকাশের কথা জানায়। আমাকে অনুরোধ করে যেন আমি প্রকাশিতব্য পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখি। একদিন আমি সেগুনবাগিচার দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চা অফিসে গিয়ে খোশনবীশ ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করি। তার সঙ্গে প্রথমবারের আলাপেই আমি মুগ্ধ হই। আমি নিয়মিত কলাম লেখার বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করি। তিনি আমাকে অফিস সময়ের পরে পত্রিকায় অফিসে কিছুটা সময় দেবার জন্য অনুরোধ করেন। আমি তার অনুরোধ রক্ষা করে নিয়মিত আমার মূল প্রতিষ্ঠানের কর্মসময় শেষে দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চায় নিয়মিত বসতে থাকি।
একমাস পরে খোশনবীশ ভাই আমাকে উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। এই সময় আমি তাকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে দেখার এবং বুঝার সুযোগ পাই। আমি তাকে অত্যন্ত উদার এবং আন্তরিক একজন মানুষ হিসেবে পেয়েছি। খোশনবীশ ভাইয়ের সঙ্গে মোকাদ্দেশ ভাই নামে একজন ব্যাংকার ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধীরস্থির এবং বুদ্ধিদীপ্ত একজন মানুষ। আমি নিজেও একজন ব্যাংকার তাই মোকাদ্দেশ ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয় খুব তাড়াতাড়িই। সেই সময় দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চা পত্রিকা পরিচালনার বিষয়ে আমরা তিনজন মিলে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতাম। খোশনবীশ ভাই শেয়ার বাজার বিষয়ক এক্সপার্ট হলেও তিনি কিন্তু পত্রিকা লাইনের লোক ছিলেন না। সেই কারণে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আমার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। আমি এবং মোকাদ্দেস ভাই কোনো ইস্যুতে একমত প্রকাশ করলে খোশনবীশ ভাই তা মেনে নিতেন।
পত্রিকা সম্পাদকদের অনেকের মধ্যেই একটি প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যায় কীভাবে তুলনামূলক স্বল্প বেতন-ভাতা দিয়ে সাংবাদিকদের কাজ করানো যায়। কিন্তু খোশনবীশ ভাই এ ব্যাপারে বেশ উদার ছিলেন। তিনি মনে করতেন, একজন সাংবাদিককে যদি উপযুক্ত বেতন-ভাতা না দেয়া হয় তাহলে তার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গুণগত মানসম্পন্ন কাজ কোনোভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চা পত্রিকার সাংবাদিকদের যে বেতন-ভাতা প্রদান করতেন তা ছিল সমগোত্রীয় পত্রিকার তুলনায় বেশ ভালো। ঠিক সময় মতো কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হতো।
একবার একজন সাংবাদিককে অ্যাসাইনমেন্টের জন্য প্রেরণ করেন। তাকে কিছু টাকা দিয়ে বলেন, আপনি ট্যাক্সিতে করে যাবেন। ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমি খোশনবীশ ভাইকে বললাম, আপনি ওনাকে ট্যাক্সিতে যেতে বললেন কেনো? যে দূরত্বে তাকে পাঠালেন তা রিকশায় গেলেও চলতো। তিনি বললেন, ভদ্রলোক যদি রিকশায় যেতেন তাহলে তিনি যতটা কমফোর্ট ফিল করতেন তার চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন ট্যাক্সিতে গেলে। তিনি একটি উদাহরণ দিলেন। তিনি বললেন, বৃষ্টির মধ্যে একজন সাংবাদিককে আমি যদি কোনো অ্যাসাইনমেন্টে পাঠাই তাহলে তার জন্য অন্তত একটি ছাতার ব্যবস্থা করতে হবে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য। আমি যদি ছাতার খরচ সাশ্রয় করার চেষ্টা করি এবং তিনি যদি বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হয়ে পড়েন তাহলে কয়েকদিন কাজ করতে পারবেন না। এতে অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি তার যুক্তি শুনে বুঝতে পারি তিনি কতটা দূরদর্শী চিন্তার একজন মানুষ।
খোশনবীশ ভাই এক সময় অনেক দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তিনি সেখানে শেয়ার ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শেয়ার ব্যবসায়ের খুঁটিনাটি দিনি খুব ভালো বুঝতেন। আমাদের দেশে অনেকেই শেয়ার বাজার বিশ্লেষক বা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু শেয়ার ব্যবসায়ের বাস্তবতা সম্পর্কে তারা কতটা জানেন সে সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়। খোশনবীশ ভাই নিজে যেহেতু শেয়ার ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাই তিনি এই সেক্টর সম্পর্কে বেশ ভালো বুঝতেন। তিনি শেয়ার ব্যবসায় সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। এই বইগুলো যে কোনো শেয়ার ব্যবসায়ীর জন্য গাইড লাইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তিনি বলতেন, কেউ যদি সঠিক নিয়ম নেমে শেয়ার ব্যবসায় করেন তাহলে তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ন্যূনতম আশঙ্কা নেই। তিনি আরো বলতেন, যারা শেয়ার ব্যবসায় করবেন তাদের সব সময় অত্যন্ত ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। হুজুগে বা আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নিলে শেয়ার ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
মনজুর সাদেক আর একটি কৌশলের কথা বলতেন। তিনি বলতেন, যখন কোনো কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বাড়তে থাকে তখন একবারে সব শেয়ার বিক্রি না করে কিছু কিছু করে বিক্রি করা ভালো। আবার কোনো কোম্পানির শেয়ারের মূল্য কমতে থাকলে কিছু কিছু করে শেয়ার ক্রয় করতে হবে। আর কোনো কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের আগে কোম্পানির মৌল ভিত্তি এবং আর্থিক সামর্থ্য দেখে কেনা প্রয়োজন। কারণ সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে যে মূল্যেই শেয়ার ক্রয় করা হোক না কেনো কোম্পানি কিন্তু ভিত্তি মূল্যের উপরই ডিভিডেন্ড প্রদান করবে। যেমন, কোনো কোম্পানির শেয়ারের ভিত্তি মূল্য হয়তো ১০০ টাকা। সেই শেয়ার বাজারে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যারা শেয়ারের চূড়ান্ত ধারক তারা কিন্তু ডিভিডেন্ড পাবেন ১০০ টাকার উপরেই। যদি সেই কোম্পানি শেয়ার প্রতি ২০ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে তাহলে শেয়ার ধারক পাবেন ২০ টাকা। তিনি কিন্তু ৪০০ টাকার ওপর ডিভিডেন্ড পাবেন না। ১৯৯৬ সালে দেশের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির সময় যখন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। যে কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেনি, নির্মাণাধীন পর্যায়ে ছিল তাদের শেয়ারের মূল্যও তিন-চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগযোগ্য তহবিল সংগ্রহের জন্য উদ্যোক্তাগণ সাধারণত ব্যাংকের দ্বারস্থ হন না। তারা শেয়ার বাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে থাকেন। কারণ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করা হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর ব্যাংক পূর্ণমাত্রায় সুদ চার্জ করতে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত নির্মাণকালীন সময় ধরা হয় ৬ মাস। ৬ মাস অতিক্রান্ত হলেই ব্যাংক পূর্ণ মাত্রায় সুদ চার্জ করতে থাকে। এর আগে ৬ মাস তারা নির্মাণকালীন সুদ আরোপ করে তুলনামূলক কম হারে। আমাদের মতো দেশে অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে এক থেকে দেড় বছর সময় প্রয়োজন হয়। ফলে একটি প্রকল্প বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করার আগেই বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা তার মাথায় চেপে বসে; কিন্তু শেয়ার বাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহের সুবিধা হচ্ছে কোনো কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করা হলে সেই কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে লাভজনক পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদানের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা যদি ব্যাংকের পরিবর্তে পুঁজি বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করতেন তাহলে খেলাপি ঋণের সংকট অনেকটাই মিটে যেত।
আমাদের দেশে শুধু শেয়ার বাজার নির্ভর একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করা যেতে পারে তা মনজুর সাদেক খোশনবীশ ভাইয়ের আগে কিউ চিন্তা করেননি। এ ক্ষেত্রে তিনি পাইওনিয়ার বলা যেতে পারে। দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চা প্রকাশের আগে আমাদের দেশে শেয়ারবাজার ভিত্তিক সাংবাদিকতার তেমন কোনো বিকাশ ঘটেনি এবং এ সংক্রান্ত কোনো প্ল্যাটফর্মও ছিল না। তাই যারা দৈনিক শেয়ার বাজার কড়চায় কাজ করার জন্য আসতেন তারা প্রথম দিকে কিছুটা হলেও সমস্যায় পড়তেন। খোশনবীশ ভাই সাংবাদিকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতেন। বর্তমানে যারা বিভিন্ন পত্রিকায় শেয়ারবাজার বিট করেন তাদের বেশির ভাগই শেয়ার বিজ কড়চায় কাজ করেছেন এবং খোশনবীশ ভাইয়ের কাছে থেকে দীক্ষা লাভ করেছেন।
অবশ্য পরবর্তীতে অনেকেই তার প্রতি সামান্য কৃতজ্ঞতা বোধ প্রকাশ করেনি। মানুষ কতটা অকৃতজ্ঞ হতে পারে তার একটি উদাহরণ দিতে চাই,যদিও বিষয়টি একান্তই আমার ব্যক্তিগত। দৈনিক দেশ বাংলা পত্রিকায় এক সময় আমি নিয়মিত কলাম লিখতাম। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফেরদৌস কোরেশি পত্রিকার মালিক-সম্পাদক ছিলেন। সেখানে সম্পাদকীয় বিভাগে এক ভদ্রলোক কাজ করতেন। আমরা লেখাগুলো তিনিই প্রাথমিক সম্পাদনা করতেন। পরবর্তীতে একজন সিনিয়র সহ-সম্পাদক লেখা চূড়ান্ত সম্পাদনা করে প্রকাশের ব্যবস্থা করতেন। এক সময় দৈনিক দেশ বাংলা পত্রিকার বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পত্রিকার সাংবাদিকরা বিপাকে পড়ে যান। খোশনবীশ ভাই আমাকে এক সময় অনুরোধ করেন একজন এবং পেশাদার সহ-সম্পাদক খুঁজে আনার জন্য। আমি দেশ বাংলা পত্রিকার সেই সহকারী সম্পাদককে বলি তিনি কাজ করবেন কিনা? তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সম্মত সম্মত হন। তিনি আমাকে জানান, দৈনিক দেশবাংলা বন্ধ ঘোষিত হওয়ার কারণে তিনি খুবই আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে আছেন। তিনি দুমাসের বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না। আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে খোশনবীশ ভাইয়ের কাছে গমন করি এবং তাকে নিয়োগদানের জন্য অনুরোধ করি।
খোশনবীশ ভাই আমার অনুরোধ রক্ষা করেন। তার মাসিক বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয়। উল্লিখিত সাংবাদিকের আর্থিক দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে তাকে দুমাসের বেতন অগ্রিম প্রদানের অনুরোধ জানাই। খোশনবীশ ভাই আমার অনুরোধ মোতাবেক তাকে দুমাসের বেতন অগ্রিম প্রদান করেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি কাজ করতে থাকেন। মাঝে মাঝে তিনি অফিসের কাজে খোশনবীশ ভাইয়ের বাসায় যেতেন। খোশনবীশ ভাইয়ের এক সম্পর্কীয় ভাই সিরাজুল ইসলাম, যাতে আমি খুব স্নেহ করতাম তিনি আমাকে বলেন, ভাই আপনি কেমন সাংবাদিক আনলেন? ওই সাংবাদিক তো বাসায় গিয়ে খোশনবীশ ভাইয়ের নিকট আপনার বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা করেন। আমি এই কথা শুনে যার পর নাই বিস্মিত হয়। যাকে আমি নিজে এনে সম্পাদককে অনুরোধ করে চাকরির ব্যবস্থা করি এবং দুমসের বেতন অগ্রিম প্রদানের ব্যবস্থা করি সেই ব্যক্তি কীভাবে এতটা অকৃতজ্ঞ হতে পারে?
এক পর্যায়ে দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চার আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে। পত্রিকা ছাপার মতো অর্থও হাতে থাকতো না। সেই সময় আমি এবং মোকাদ্দেস ভাই প্রেসে গিয়ে অনুরোধ করে বাকিতে পত্রিকা ছাপার ব্যবস্থা করতাম। প্রেস মালিকের সঙ্গে আমার পূর্ব থেকেই অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। এক সময় দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চার অফিস সেগুন বাগিচা থেকে মগবাজারে স্থানান্তরিত হয়। আমি সেখানেও বেশ কিছু দিন কাজ করেছি। তবে একজন কর্মীর সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝি হলে আমি দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চা পত্রিকার কাজ করা ছেড়ে দিই। পরবর্তীতে তিনি একটি টিভি চ্যানেল চালু করেন। আমি সেই টিভি চ্যানেলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের কয়েকটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিলাম। তিনি আমাকে নিয়মিত এখানে কাজ করার জন্য অনুরোধ করলেও ব্যক্তিগত ব্যবস্থার কারণে তা করা সম্ভব হয়নি। খোশনবীশ ভাই অত্যন্ত উদার মনের একজন মানুষ ছিলেন; কিন্তু তার চরিত্রের একটি দুর্বলতা ছিল, তা হলো তিনি খুবই আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। ফলে কোনো কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হতো।
আমি মাঝে মাঝে তাকে এই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিতাম। কিন্তু তারপরও তিনি একই কাজ করতেন। হয়ে তা কোনো সাংবাদিকের কথায় তিনি মুগ্ধ হলেন তাকে সঙ্গে সঙ্গে বার্তা সম্পাদক পদে নিয়োগ দিলেন। আবার হয়তো তাকে খারাপ লাগলে চাকরিচ্যুত করলেন। চাকরিচ্যুত করার পর হয়তো কিছুদিন বাদে তাকে আবারো কোনো পদে নিয়োগ দেয়া হলো। আমি তাকে বারবার বলেছি, কারও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর একবার যদি কাউকে চাকরিচ্যুত করেন তাকে আর ফিরিয়ে আনবেন না। আমার এই অনুরোধ তিনি রক্ষা করতেন না।
কয়েক মাস আগে আমি একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে প্রকাশের জন্য খোশনবীশ ভাইয়ের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য তার সঙ্গে দেখা করি। আমরা বনশ্রী এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে বসে আলাপ করি। সেই সময় খোশনবীশ ভাই আমাকে জানান, তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি রোগের কথা একান্ত ঘনিষ্ঠ জন ছাড়া কাউকে জানাচ্ছেন না। উন্নত চিকিৎসার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার কারণে তিনি দীর্ঘ বিমান ভ্রমণে সাহস পাচ্ছেন না। তিনি সেদিন শেয়ারবাজারের দুর্বলতা নিয়ে অনেক কথাই বলেছিলেন। আরো বলেছিলেন, তিনি কিছুটা সুস্থ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাৎকার প্রদান করবেন। তিনি যখন এই কথা বলছিলেন, তখন পশ্চিমাকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। বিদায়ী সূর্যের আলোক রশ্মি খোশনবীশ ভাইয়ের মুখের উপর পড়ছিল।
আমার শুধুই মনে হচ্ছিল, খোশনবীশ ভাইয়ের শেষ সাক্ষাৎকার বোধ হয় আমার আর নেয়া হবে না। সত্যি তিনি চলে গেলেন। দুঃখ লাগে তার মতো একজন ব্যক্তি আমাদের সমাজে সঠিক মূল্যায়ন পেলেন না। শেয়ার বাজার উন্নয়নে তার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতির উপকার হতে পারতো। সত্যি আমরা দুর্ভাগা জাতি। প্রতিভার সঠিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমরা মোটেও উদার নই।
খোশনবীশ ভাইয়ের এই চলে যাওয়া যে কোনো বিচারেই অত্যন্ত দুঃখজনক। মহান আল্লাহ নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন খোশনবীশ ভাইকে বেহেস্ত নসিব করেন।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে