মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: শোকের উচ্চারণ ও কিছু পর্যবেক্ষণ
২১ জুলাই ২০২৫, সোমবার ছিল শ্রাবণের একটি রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন; কিন্তু ওই দিন দুপুরে, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমানের মর্মান্তিক ক্র্যাশ বা দুর্ঘটনায় এই দিনটি বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। মুহূর্তেই উত্তরাস্থ দিয়াবাড়ির স্কুলটি যেন পরিণত হলো এক অজানা যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে কেউ কারোর শত্রু ছিল না। প্রাণ গেল অনেক শিশুর, যারা ঘরে ফেরার জন্য ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল। অনেক বাবা-মায়ের ছোট ছোট রাজপুত্র, রাজকন্যারা হারিয়ে গেল চিরতরে। হারিয়ে গেলেন এই বিমানের পাইলট, একজন প্রতিশ্রুতিশীল বিমান বাহিনী কর্মকর্তা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম। এখন পর্যন্ত এই দুর্ঘটনায় ৩৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, যাদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর বয়সী শিক্ষার্থী।
কোনো কোনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী
এই মর্মান্তিক মৃত্যু দেশের সর্বস্তরের মানুষকে বেদনায় স্তব্ধ করে দিয়েছে। সমগ্র জাতি গভীরভাবে শোকাহত। শোক প্রকাশের ভাষা কারও জানা নেই। সেদিন আমি, আমরা কেঁদেছি। বাংলাদেশের আকাশও কেঁদেছে। ‘কোনো কোনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী’ মৃত্যু বিষয়ে মাও সেতুংয়ের কথাটা মনে পড়লো। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি সমগ্র বাংলাদেশকে এক করেছে চোখের জলে। অন্যদিকে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ নিরাপত্তা কাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও এভিয়েশনের অনেক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছে, সেটা অনুধাবন করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। তবে, এখন সময় আহতদের সুচিকিৎসা দেয়া, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, ক্ষমা চাওয়া আর প্রার্থনা...।
ব্যতিক্রমধর্মী এক বিমান দুর্ঘটনা
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে বিমান দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে। গত ২১ বছরে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ২৬টি সামরিক বিমান। অনেক বৈমানিকও নিহত হয়েছেন; কিন্তু চৌকস বৈমানিকদের দক্ষতায় এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনাজনিত বিমানের কারণে ভূমিতে নিহত হবার ঘটনা ঘটেনি। কারণ এ বিষয়টিকে শুরু থেকেই বাংলাদেশের বৈমানিকদের বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যদিও মাইলস্টোনের ঘটনাটি দুর্ভাগ্যক্রমে ব্যতিক্রম। যেখানে ইতোমধ্যে ৩৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, আহত হয়েছেন ১৬৫ জন।
যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটলো
৩৫নং স্কোয়াড্রনের ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম বিমান বাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানের নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে, গত ২১ জুলাই দুপুর ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলাস্থ ‘বিএএফ ঘাঁটি বীর উত্তম এ কে খন্দকার’ থেকে উড্ডয়ন করেন। এই বিমানে এটিই ছিল তার প্রথম ‘সলো ফ্লাইং’। উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে এই বিমান ঘাঁটির পূর্বের নাম পরিবর্তন করে- বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম বিমান বাহিনী প্রধান এবং মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিপ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, বীর উত্তমের নামে নামকরণ করা হয়।
আইএসপিআরের মাধ্যমে জানা যায়, উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর, এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। দুর্ঘটনা মোকাবেলা ও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এই তরুণ পাইলট বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, চীনের নির্মিত ও ২০১২ সালে বিমান বাহিনীতে যুক্ত এফ-৭ বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আলী হায়দার ভবনের (স্কুল সেকশন) ওপর বিধ্বস্ত হয়। তখন সময় দুপুর ১টা ১২ মিনিট। দুর্ঘটনার পর তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত শেষে দুর্ঘটনার বিশদ বিবরণ হয়তো জানা যাবে।
নিজেদের ইউনিফর্মে যারা আবৃত করলেন মা ও সন্তানের মৃতদেহ...
গাজীপুরের শিমুলতলীতে ‘বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা’ (বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি-বিওএফ) অবস্থিত। কারখানাটি ১৯৭০ সালে উৎপাদন শুরু করে। এর ঠিক দক্ষিণে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি বা বিএমটিএফ অবস্থিত। ২০১৬ সালে এরই একটি অংশে ‘৪৩ শোরাড মিসাইল রেজিমেন্ট’ গড়ে ওঠে। এই সমরাস্ত্র কারখানায় কিছু দিন কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। আমাদের অতি নিকটবর্তী ও একমাত্র সেনা ইউনিট বিধায়, বিওএফে কর্মরত অনেক সেনা কর্মকর্তা এই ইউনিটকে অনেকটা ‘নিজেদের ইউনিট’ মনে করতেন। এর অনেক কর্মকর্তা ও সৈনিককে আমরা চিনতাম।
প্রায় ১ বছর আগে উত্তরার দিয়াবাড়িতে ৪৩ শোরাড রেজিমেন্ট একটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। যা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে অবস্থিত। এর অধিনায়ক হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহসিন হক চৌধুরী। এটি ৬ স্বতন্ত্র এয়ার ডিফেন্স ব্রিগেডের আওতাধীন একটি রেজিমেন্ট। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে স্বতন্ত্রভাবে ‘আর্মি এয়ার ডিফেন্স কোর’ যাত্রা শুরু করে।
মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সংবাদ শুনেই এই ক্যাম্প থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে একদল সৈনিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় ও দ্রুত উদ্ধার কাজ শুরু করে। এরপর ঘটনাস্থলে আসে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবি। সেনাবাহিনীর ৬ স্বতন্ত্র এয়ার ডিফেন্স ব্রিগেডের আরও কয়েকটি ইউনিটও পরবর্তীতে এই উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ করে।
এই রেজিমেন্টের মেজর মেহেদী স্কুলের ভেতরে দুর্ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী ওয়াক ওয়েতে একজন নারী ও শিশুর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তাৎক্ষণিকভাবে এই তরুণ মেজরের মনে অনুভূতি জাগে- সেটি হলো একজন মায়ের আব্রু রক্ষা করা। মেজর মেহেদী হাসান তখন নিজের প্রিয় কমবেট রঙের ইউনিফর্ম খুলে নারীর মৃত দেহটি ঢেকে দেন। ব্যাটারি কমান্ডারের সৃষ্ট উদাহরণ দেখে, সৈনিক আশিকুর রহমানও তখন তার ইউনিফর্ম খুলে শিশুটির মৃতদেহ ঢেকে দেন। মেজর মেহেদী ও সৈনিক আশিক হয়ে ওঠেন সত্যিকারের সৈনিকের প্রতিকৃতি।
মাহেরীন চৌধুরী, মাসুকা বেগম ও একদল সাহসী উদ্ধারকারী
বিমান দুর্ঘটনার পর এলাকাটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয় ও দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। নিকটস্থ দিয়াবাড়ি ক্যাম্প থেকে ঘটনাস্থলে আসা সেনাবাহিনীর দলটি সেই আগুনের তাপ, ফিউম, গ্যাস উপেক্ষা করে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এরপর উদ্ধারকাজে যোগদান করে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও বিজিবি।
আগুনের তাপ ও ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মাঁঝে উদ্ধারকাজ পরিচালনা কতটা যে কঠিন দূর থেকে তা কল্পনা করা যায় না। এই সময় সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একদল ছাত্র-শিক্ষকও অসাধারণ সাহসিকতা ও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়াও স্থানীয় জনগণও উদ্ধারকাজে অবদান রাখেন।
শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরী জেট ফুয়েলের উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ডে নিজের শরীর অঙ্গার হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বুকে আগলে রেখেছেন একটা একটা করে ২০টি শিশুকে। জ্বলন্ত আগুনের শিখা যখন সহস্র নাগিনীর বিষবাষ্প হয়ে তাকে ঘিরে ফেলেছিল তখনও বিপদগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। একবারও নিজের জীবনের কথা ভাবেননি। শিক্ষার্থীদের প্রিয় ‘মাহেরীন ম্যাম’ এখন ঘুমিয়ে আছেন নীলফামারীর জলঢাকায়। তিনি অভিভাবকদের বলতেন, ‘কোনো একটা শিশুর কিছু হওয়ার আগে সেটা আমার বুকের ওপর দিয়ে যাবে।’ মাহেরীন চৌধুরী তার কথা রেখেছেন নিজের জীবনের বিনিময়ে। মাহেরীন চৌধুরীকে সম্মানিত করব এমন পদক তো আমাদের নেই। ভোরের শিশির তার কবরে প্রতিদিন পাঠায় ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অনুপম অর্ঘ্য।
বিবেক, সাহস আর মমতার আরেক প্রতীক হলেন শিক্ষক মাসুকা বেগম। ক্লাসে আগুন ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের সাহস দিয়ে একে একে নিরাপদে বের করে আনেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই গুরুতর দগ্ধ হন। পরে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই আত্মত্যাগী শিক্ষক। একইভাবে স্কুলের আয়া মাসুমা বেগম শিশুদের উদ্ধার করতে যেতে নিজেই মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন এবং পরে হাসপাতালে মারা যান। আরমান, নাফি এবং প্রলয়- ওরা সবাই ক্লাস সিক্সের ছাত্র। স্কুলের ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছিল এই তিন বন্ধু। দুর্ঘটনার পর তারাও জীবনবাজি রেখে শিশুদের উদ্ধার করেছে। এমন অনেক শিক্ষার্থী মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে অন্যদের উদ্ধার করেছে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে আসায় সেনাবাহিনীর দলটির প্রয়োজনীয় ইক্যুপমেন্ট ও পোশাক ছিল না। এ পরিস্থিতিতেও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা উদ্ধারকাজ চালিয়েছেন। কেউ কেউ ভ্যান চালিয়ে আহতদের বহনও করেছেন। এদের মধ্যে ১১ জন সৈনিক অসুস্থ হয়ে সিএমএইচে ভর্তি হয়েছিলেন।
একটি ফিউনারেল প্যারেড-২২ জুলাই
২২ জুলাই দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টায় কুর্মিটোলাস্থ ‘বিএএফ বিমান ঘাঁটি, বীর উত্তম একে খন্দকার’-এর টারমাকে ফ্লা. লে. তৌকির ইসলামের সম্মানে ফিউনারেল প্যারেড ও নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। গত কয়েকদিন ধরে লেখক- নাঈম হকের ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা’ নামের বইটি পড়ছিলাম। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ সরকার ঢাকার তেজগাঁও (দাইনোদ্দা) ও কুর্মিটোলায় (বালুরঘাট) ‘এয়ার স্ট্রিপ’ নির্মাণ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চীন-বার্মা ইন্ডিয়া ওরফে সিবিআই থিয়েটার (রণাঙ্গন) গভীরভাবে বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সস্পৃক্ত হয়ে পড়ে। তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বহর সুউচ্চ হিমালয়ের (হাম্প) ওপর দিয়ে চীনে জ্বালানি ও বিবিধ সাপ্লাই সরবরাহ করত।
এমনও হয়েছে, একজন আমেরিকান পাইলট সকালে কুর্মিটোলা থেকে বিমান চালিয়ে চীনের চুংকিংয়ে (তখনকার রাজধানী) জ্বালানি তেল পৌঁছে দিয়েছেন। চীন থেকে ফিরে এসে তিনি সন্ধ্যায় ঢাকা ক্লাবে অন্যান্য আমেরিকানদের সঙ্গে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রদের সঙ্গে সেই বিষয়ে গল্প করতেন। অন্যদিকে, এখান থেকে বিমানগুলো বার্মায় জাপানিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্টের অংশীদার ছিল। ঢাকার অবহেলিত ও বিস্মৃত এই অধ্যায়টি লেখক নাঈম হক তার এই গ্রন্থে অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। বইটি পড়ার পর, কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটিটি সবিস্তারে দেখার ইচ্ছা ছিল। কাকতালীয়ভাবে এর কদিন পরই, ফিউনারেল প্যারেড ও জানাজার জন্য এই বিমান ঘাঁটিতে এলাম; কিন্তু অনেকের মতো, আমার কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি দেখা হলো চোখের জলে...।
এই দুর্ঘটনায় নিহত ফ্লা. লে. তৌকির, কোমলমতি শিশু, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবার জন্য বিমান বাহিনীর সদস্যদের চোখে সেদিন ছিল গভীর শোকের ছায়া। সৈনিকরা দুঃখ, কষ্ট, শোক সহ্য করার দীক্ষা নেয়। সৈনিকদের চোখের জল সাধারণত দেখা যায় না...। তবে অনুভব করা যায়।
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার কয়েকশ গজ পূর্ব দিকেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর (পশ্চিমাংশ)। বিমান বাহিনীর শত শত সদস্যের সঙ্গে পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম: গতকাল এই সময় পাইলট তৌকির ফ্লাইংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল... এই টারমাক থেকেই এফ-৭ বিমানটি ট্যাক্সি করে রানওয়েতে নিয়ে গিয়েছিলেন...। ফুলের মতো শিশুরা ক্লাস করছিল...। আজ তারা কেউ নেই। জীবন এত অনিশ্চিত কেন?
একজন ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল ইসলাম’
ফিউনারেল প্যারেডে দাঁড়িয়ে বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া আমার বন্ধু আর এক ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের’ কথা মনে পড়লো। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে (বিএমএ) ১৯৮৩ সালে আমাদের (১২তম লং কোর্সের) সঙ্গে প্রথমবারের মতো নৌ ও বিমান বাহিনীর ক্যাডেটরাও কিছুদিন ‘যৌথ প্রশিক্ষণে’ অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে আমাদের বিমান বাহিনীর বন্ধু ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল ইসলাম’ যশোরে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। একজন বৈমানিকের জীবনে যেমন রয়েছে বিস্তর অ্যাডভেঞ্চার ও সম্মান। অন্যদিকে রয়েছে ঝুঁকি।
স্যালুট টু আওয়ার ডক্টরস
ফিউনারেল প্যারেড থেকে ঢাকা সেনানিবাসের (প্রতিষ্ঠিত: ১৯৫২) সিএমএইচে এলাম। ‘ইমারজেন্সির’ পর একটা বাগান পেরিয়ে ‘বার্ন অ্যান্ড ট্রমা ইউনিট’। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির বেশ কয়েকজন এখানে ভর্তি আছেন। আহতদের দেখে মন অস্থির হয়ে ওঠে। নিয়তির একি খেলা! কথা হয় কয়েকজন হতভাগ্য বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে। আহতদের জন্য আমাদের দোয়া আর প্রার্থনা। মাইলস্টোনের উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ১১ জন সদস্য অসুস্থ হয়ে বর্তমানে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। আহতদের দ্রুত সেবা দিতে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে ঢাকা সিএমএইচের মেডিকেল টিম।
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির পর আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন (৮টি) হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফরা অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। সিএমএইচ, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, লুবানা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টার ও বিশেষভাবে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা অসাধারণ দক্ষতা, মানবিকতা ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের ভূমিকা জাতি স্মরণে রাখবে। স্যালুট টু আওয়ার ডক্টরস।
মাইলস্টোন কলেজ প্রাঙ্গণে-২৪ জুলাই
এক সময় শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর অভিভাবকদের পদচারণায় মুখর থাকা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে (মূল ক্যাম্পাস) এখন সুনসান নীরবতা। নেই ছোট ছোট ফুলকলিদের ছোটাছুটি আর কোলাহল। আছে শুধু হাহাকার। শিক্ষাঙ্গনজুড়ে নিস্তদ্ধতা। প্রধান গেটটি বন্ধ। দুর্ঘটনার ৩ দিন কেটে যাওয়ার পর স্কুলের প্রবেশমুখে মানুষের জটলা ধীরে ধীরে কমে আসছে। তবে কমছে না কৌতূহল, ভয়। কারও মুখ বিষণ্ন। কেউবা ব্যস্ত রিলস তৈরিতে।
প্রতিদিনের মতো কিছুক্ষণ পর পর উড়ে গেল বিমান। দুপুরবেলা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম... এই ফটক দিয়ে প্রতিদিন স্কুল ড্রেসে আসত তাহিয়া, শায়ান, উক্যচিং মারমা, মাহিয়া, উমায়ের, বাপ্পী, আরিয়ান, রাইসা, মাহিত, তানবির... এর মতো একদল শিশু। আসতেন মমতাময়ী শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরী, মাসুকা বেগম ও আয়া মাসুমা বেগম। ফ্লা. লে. তৌকির ইসলাম সাগর এখন ঘুমিয়ে আছেন রাজশাহীর সপুরায়। ওরা আর কোনো দিন আসবে না...।
উদ্ধার অভিযান ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার দুর্বল কিছু দিক
শুরুতে সম্মিলিত যে উদ্ধার প্রচেষ্টা ও আহতদের রক্ত দিতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসার দৃষ্টান্ত- তা আমাদের সমাজে বহুদিন প্রেরণা হয়ে থাকবে; কিন্তু পরবর্তী সময়ে উদ্ধার কার্যক্রম ও এক্ষেত্রে সরকারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। দুর্ঘটনার পর কিছু ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ জনমনে ক্ষোভ ও বিরক্তি সৃষ্টি করেছে।
এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় বিমান দুর্ঘটনা। মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনা ছিল একটি ‘টেকনোলজিক্যাল ডিজাস্টার’ ও ‘ক্যামিকেল ফায়ার’। বিমান দুর্ঘটনাজনিত আগুন নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। সেনাবাহিনীরও এ ধরনের প্রশিক্ষণ সাধারণত থাকে না। তবে তারা সহজাত স্পিরিট থেকেই উদ্ধার কাজে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
বিমান বিধ্বস্তের পর পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। একসঙ্গে এতো শিশুর মৃত্যু কমই দেখেছে বাংলাদেশ। দুর্ঘটনায় এতো শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনা দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে আবেগ সৃষ্টি করে; কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি সামলাতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নেয় সেগুলো নিয়েই প্রশ্ন ওঠে এবং নানা আলোচনার জন্ম দেয়। এই ঘটনায় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের গড়িমসি, সমন্বয়ের অভাব, দক্ষতার অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বড় কোনো দুর্ঘটনা সামাল দিতে জাতীয় সক্ষমতা, ব্যবস্থাপনা কতটা ভঙ্গুর তা আরেকবার প্রকাশ পেয়েছে। যাই হোক, মাইলস্টোনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ভুলত্রুটিগুলো আত্মসমালোচনা করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
অপ্রীতিকর ঘটনা ও ‘লাশ গুম’-এর গুজব
নিজেদের জানবাজি রেখে উদ্ধারকাজ করলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘লাশ গুমের’ অভিযোগ উঠেছিল। যা ছিল একটি অদ্ভুত বিষয়। দুর্ঘটনার প্রাথমিক পর্যায়ে আলাদা আলাদা সংস্থার তথ্য ঘাটতির কারণে জনগণের মনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এই ট্র্যাজেডি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে অপতথ্য ও গুজব ছড়িয়েছেন।
উদ্ধার অভিযানের একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ছাত্রদের একটি দুঃখজনক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে; কিন্তু কীভাবে এমন হলো? এতগুলো শিশুর মৃত্যুতে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই সাংঘাতিক উত্তেজিত ও আবেগপ্রবণ ছিল। তাদের মাথায় তখন আগুন। সেই সময় ছাত্রদের কেউ কেউ নিজেদের মতো করে মৃত্যুর সংখ্যা মিডিয়ায় বলছিলেন। অন্যদিকে ছাত্র-জনতার ভিড়ে উদ্ধারকাজ বিঘ্ন হচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেয়েছিল শৃঙ্খলাপূর্ণ একটি পরিবেশ।
জনতার মধ্যে টিকটক, আহত-নিহত শিশুদের ভিডিও করা, ভিউ বৃদ্ধি প্রবণতা উদ্ধারকারীদের জন্য বিরক্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। এ সময় ছাত্রদের উত্তেজিত করার প্রয়াসও ছিল একটি মহলের...। এসবের ফলেই সম্ভবত একপর্যায়ে অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে যা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। আশা করি, সংশ্লিষ্ট বাহিনী সেখানে অপেশাদার কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে কর্তৃপক্ষ সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কোনো বাহিনী থেকে, কোনো পরিস্থিতিতেই অপেশাদার কর্মকাণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়।
সরকারের তদন্ত কমিশন
এই বিমান দুর্ঘটনার পরপরই বিমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি ও সিভিল এভিয়েশন অথরিটির ‘বিমান দুর্ঘটনার ঘটনা তদন্ত কমিটি’ কাজ শুরু করেছে। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৯ সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশন বিমান বিধ্বস্তের পরিপ্রেক্ষিত, কারণ দায়দায়িত্ব ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ঘটনা-সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয় চিহ্নিত করবে।
উত্তরা থেকে দেখা- শহর যখন ঘিরে ফেলেছে বিমান বন্দরকে
এখন বিকেল। উত্তরার ৩নং সেক্টরের একটি সুউচ্চ ইমারত থেকে ঢাকার ‘হযরত শাহ্ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর’ দেখছি। অন্যদিন এখানে এলে অদ্ভুত এক রোমান্টিকতায় মন ভরে যেত; কিন্তু আজ শুধুই বিষণ্নতা। বিমান বন্দরের কিছুটা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে একে একে বিমানগুলো ল্যান্ড করছে। ২১ জুলাই দুপুরে এভাবেই এফ-৭ বিমান নিয়ে একই রানওয়েতে ল্যান্ড করার কথা ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের।
এয়াফোর্সের বন্ধুদের কাছ থেকে ‘ফ্লাইং’-এর অ্যাডভেঞ্চারময় গল্প শুনতাম। তাদের ‘ফ্লাইং’- এর বেসিক ট্রেনিং হয় যশোরে। কিছু অ্যাডভান্স ট্রেনিং চট্টগ্রামেও হয়। ঢাকায় এয়ারবেজ হলেও এ অঞ্চলে ডেজিগনেটেড ‘ফ্লাইং’ ট্রেনিং এরিয়া হলো- ঘাটাইল, টাঙ্গাইল, মধুপুর, শ্রীপুর...। অর্থাৎ ঢাকার বাইরে; কিন্তু রানওয়ে একটাই বলে ঢাকা থেকেই সামরিক বিমানগুলোকে টেকঅফ ও ল্যান্ড করতে হয়।
১৯৬৪ সালে নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বাড়ার কারণে তেজগাঁওয়ের বদলে কুর্মিটোলা বিমান বন্দর বড় পরিসরে চালু করার পরিকল্পনা করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮০ সালে এই বিমান বন্দরটি চালু করা হয়। ১৯৮৩ সালে এই এয়ারপোর্ট দেখতে এসেছিলাম। ঢাকায় এলে ‘এয়ারপোর্ট’ দেখার একটা ব্যাপার তখন ছিল। এটি ছিল তখন ঢাকা শহরের প্রায় বাইরে। তখনও উত্তরা মূলত খালি ছিল। আজ চারদিকে শহরের দালানকোঠা বিমান বন্দরকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ফেলেছে। এভাবে এই বিমান বন্দরটি কত দিন আর টেকসই থাকবে?
উত্তর নেই প্রশ্নের পাহাড়- সমাধান তাহলে কোন পথে?
বাংলাদেশে একটা ইস্যু বিশেষত দুর্ঘটনাজনিত ইস্যু সংঘটিত হওয়ার পর সিস্টেম, নিয়মকানুন, ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনার তুমুল ঝড় ওঠে। একইভাবে ভয়াবহ এই মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি জনপরিসরে অনেক প্রশ্ন/বিতর্ক/আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই দুর্ঘটনার দায় কার? ঢাকার কেন্দ্রে যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ কেন? অ্যাপ্রোচ এরিয়া বা গ্লাইড পাথ এর ওপরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কীভাবে গড়ে উঠলো? বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন হচ্ছে না কেন? ঢাকার রানওয়ে প্রশিক্ষণ বিমান উড়ানোর জন্য কতটা নিরাপদ? ঢাকার মধ্যে বিমান বন্দর রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত? জনবহুল এলাকায় সামরিক বিমানের প্রশিক্ষণ হওয়া উচিত কিনা? দেশে যুদ্ধবিমান বা অন্য কোনো বিমান প্রশিক্ষণের পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা কি যথেষ্ট আধুনিক? বিমান বাহিনীতে পুরোনো প্রযুক্তির বিমান এখনো কেন...? যেন উত্তর নেই, শুধু প্রশ্নের পাহাড়...।
এভাবে, এই বিমান দুর্ঘটনা আমাদের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, সমস্যা, দ্বিধা ও নিরাপত্তা উদ্বেগের সম্মুখীন করেছে। এর সমাধান বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় বেশ কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। এর আগেও সরকারের উচ্চপর্যায়ে এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিলেও দৃঢ়তার অভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
সন্ধ্যা নেমেছে উত্তরায়...। উত্তরার ৩নং সেক্টরের সুউচ্চ ইমারত থেকে বিমান বন্দরের দিকে তাকিয়ে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছিলাম...। ঢাকার কৌশলগত অবস্থান, ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে গভীর প্রতিরক্ষার অভাব, রাজধানীর নিরাপত্তা, বাজেট সীমাবদ্ধতা, জনসুরক্ষা, ঢাকার ক্রমবর্ধমান এয়ার ট্রাফিক, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও ঢাকার বাস্তবতা... ইত্যাদি ফ্যাক্টর বিবেচনা করে এসব বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। উন্নত বিশ্বে অত্যাধুনিক যেসব বিমান আছে সেগুলোও দুর্ঘটনায় পতিত হয়। আশা করি, বিমান বাহিনী এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নেবে এবং ভবিষ্যতে এটার প্রতিকার করবে। এমন দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে।
এখনই যা করণীয়
তবে এই মুহূর্তে জরুরি ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: আহতদের চিকিৎসা। অগ্নিদগ্ধ অনেক রোগীর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে সরকারকে ট্রাস্ট গঠন করে আহতদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারে ক্ষতিপূরণ দেয়া আমাদের দায়িত্ব। স্কুলটির শিক্ষার্থীরা যে ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে তা দূর করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ কাউন্সিলিং সেবা চালু করা, যেখানে মনোবিজ্ঞানী ও শিশু মনোবিদরা দুর্ঘটনাগ্রস্ত শিশুদের সুশৃঙ্খলভাবে মানসিক পুনর্বাসন করবেন।
‘আমি দুর্দিনের বন্ধু’- আমরা মানুষের পাশে থাকব
মাইলস্টোনে যে ট্র্যাজেডি আমাদের যে সতর্কবার্তা দিয়েছে সেটা অনুধাবন করতে হবে। এ বিষয়ে গঠিত কমিশন হয়তো তাদের রিপোর্টে করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ করবেন। যা গাইডলাইন্স হিসেবে নেয়া যেতে পারে। কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।
আশা করতে চাই, আহতরা সবাই সুস্থ হয়ে উঠবেন। এ মুহূর্তে প্রয়োজন হলো আহতদের সুচিকিৎসা ও নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। সমাজে এত বিদ্বেষ, বিভক্তির পরও মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের সবাইকে এক করেছে চোখের জলে, শোকের আবহে। আমরা সবাই মিলে এই ট্র্যাজেডি শেয়ার ও মোকাবেলা করব। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াব। আমরা নিজেদের ভুলগুলো সংশোধন করব, আমরা এক হয়ে থাকব।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘দুঃখ যেথা, সেথা আমার করো বাস।’ কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি দুর্দিনের বন্ধু।’ আজ যখন মানুষ বিপদে পড়েছে, দুর্ঘটনায় পড়েছে তখই আমাদের উচিত- এই দুই কবির মানবতার পথ ধরে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক, বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে