বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ মাইলস্টোন স্কুলের বিমান দুর্ঘটনা
যে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলেই রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলাগুলো বড় করে চোখে পড়ে। সে লঞ্চডুবি হোক, পোশাক কারখানায় আগুন লাগা হোক আর বিমান দুর্ঘটনাই হোক। কত দ্রুত রাষ্ট্র এসব দুর্ঘটনা সামাল দিতে পারে তার ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের দক্ষতা। আমাদের রাষ্ট্র যে অত্যন্ত দুর্বল, বিশৃঙ্খল তার সর্বশেষ উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো গতকাল রাজধানীর দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনা। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩১ জন নিহত ও আহত ১৬৮ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। আহতদের অনেকের অবস্থাই বেশ আশঙ্কাজনক, অনেকের শরীর ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে।
এর মধ্যেই এ ঘটনাকে ঘিরে শুরু হয়েছে নানারকম রাজনীতি। কতিপয় রাজনীতিবিদ হাসপাতালে গিয়ে ভিড় বাড়িয়েছেন, তাতে আহতদের নিয়ে যাতায়াত কঠিন হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার পরদিন ছিল এইচএসসি পরীক্ষা, পরীক্ষা হবে কি না তা সিদ্ধান্ত নিতে প্রশাসনের রাত তিনটা পর্যন্ত সময় লেগেছে। এ নিয়েও নানা বিশৃঙ্খল খবর ছড়াল, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার নাকি শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে আগেই বলেছিলেন পরীক্ষা স্থগিত করার জন্য; কিন্তু শিক্ষা সচিব রাজি হননি। এ কেমন সচিব যিনি উপদেষ্টার কথা শুনেন না? এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন ব্যাপক সমালোচনার জন্ম হয় তখন রাত দুপুরে তথ্য উপদেষ্টা মাফফুজ আলম শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরীক্ষা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেন। বলতেই হয়, কার কাজ কে করে! পরদিন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার করা হয়।
শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে দিনভর বিক্ষোভ চলে সচিবালয়ে। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলেছে। দাবি উঠেছে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগেরও। বাংলায় এমএ করা একজন নারী কী করে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হন তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন। এই এক বছরে তিনি কী করেছেন সে নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সবচেয়ে ন্যক্কারজনক বিষয়, একদিন পার হয়ে গেলেও আহত ও নিহতদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। প্রশ্ন উঠেছে, লাশ গুম করা নিয়ে। পাল্টা প্রশ্ন উঠেছে, এরকম একটি ঘটনায় লাশ গুম করার ঘটনা কেন ঘটবে? এর মধ্যে প্রথম থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, জনবসতি এলাকায় কেন প্রশিক্ষণ বিমান উড়বে? এর জন্য বিমান বাহিনীকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে বলে দাবি তুলেছেন শিক্ষার্থীরা; কিন্তু এখন পর্যন্ত বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়নি। বিমান বিধ্বংসের পর, রাষ্ট্রে যে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা শুরু হলো তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। যখন প্রয়োজন ছিল সবার একযোগে সহায়তার, মিলেমিশে কাজ করার- তখনই শুরু হলো বিভেদের রাজনীতি।
আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দাবি, এ সুযোগে আওয়ামী লীগ মাঠে নামার চেষ্টা করছে; কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন করাই যায়, এরকম একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনাকে ঘিরে বিতাড়িত আওয়ামী লীগ মাঠে নামার সুযোগ পেল কী করে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলছেন, বিগত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তার কারণেই এখন আওয়ামী লীগ ফিরে আসার সুযোগ পাচ্ছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে গেলে তাকে ৬ ঘণ্টা আটকে রেখেছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পুলিশের সহায়তায় অবশেষে তাকে বের করে নিয়ে আসা হয়।
উপদেষ্টাদের আটকে রেখে ৬ দফা দাবিতে স্লোগান দিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। তাদের ৬ দফা দাবি হলো-
১. নিহতদের সঠিক নাম ও তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
২. আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
৩. শিক্ষকদের গায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাত তোলার ঘটনায় জনসমক্ষে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।
৪. নিহত প্রতিটি শিক্ষার্থীর পরিবারকে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৫. বিমান বাহিনীর ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো প্লেনগুলো বাতিল করে আধুনিক প্লেন চালু করতে হবে।
৬. বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিবর্তন করে আরও মানবিক ও নিরাপদ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
একটু ভালো করে ভাবলেই দেখা যাবে, এসব আদতে দফা হিসেবে দাবি তোলার বিষয়ই না। এগুলো তো আগে থেকেই সরকারেরই পালন করার কথা। সরকার কেন অনিবার্য পালনীয় বিষয়গুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না?
রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলা নিয়ে এত প্রশ্ন জনমনে যে কোনটা আগে কোনটা পরে আসবে তাও নির্ধারণ করা কঠিন। প্রথম প্রশ্নটাই সবশেষে করা যাক। দুর্ঘটনার পরদিন রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার; কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল খোলা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে এ কেমন ধরনের শোক দিবস পালন করা হলো তা নিয়েও রয়েছে অনেকের প্রশ্ন।
প্রশ্ন যতই থাক, তার উত্তরও নিশ্চয়ই আছে। সেই উত্তরগুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে এই বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রকে আমরা সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারব না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে