Views Bangladesh Logo

ব্যর্থ হতে চলছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন

Rahat  Minhaz

রাহাত মিনহাজ

বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংস্কার প্রক্রিয়ার সঙ্গে গণতন্ত্রহীন সরকার কাঠামোর একটি অদ্ভুত যোগসূত্র রয়েছে। অবিভক্ত পাকিস্তানে সার্বজনীন ভোটাধিকারে সরকার গঠিত হওয়ার আগে প্রথম গণমাধ্যম কমিশন (পিপিসি: পাকিস্তান প্রেস কমিশন) গঠিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে। সিন্ধু প্রদেশের বিচারপতি তায়েবজির নেতৃত্বে গঠিত সেই কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয় ১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে। বাংলাদেশসহ গোটা পাকিস্তানে তখন জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেস কমিশন (দ্য বাংলাদেশ প্রেস কমিশন) গঠিত হয় ১৯৮২ সালের ২৬ এপ্রিল। তখন বাংলাদেশে চলছে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন।

রাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের (বাংলাদেশের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী, ৩০ মার্চ ১৯৮৪ - ৯ জুলাই ১৯৮৬) নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের এই কমিশন ১০২টি সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল ১৯৮৪ সালের মার্চে। ঔই প্রতিবেদনের ৪০ বছর পর ২০২৪ সালে বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে আরেকটি গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। সেটাও এক অস্বাভাবিক সময়। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কামাল আহমদের নেতৃত্বাধীন ১২ সদস্যের কমশিন। যা এখনো বিবেচনাধীন। ১৯৮২ সালের প্রেস কমিশন ও ২০২৪ সালের গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের গঠন প্রক্রিয়ায় একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রণিধানযোগ্য। ১৯৮২ সালের কমিশনে কর্মকর্তাদের (অফিসিয়ালস) তালিকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ও এর উপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

২০২৪ সালে কমিশনে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আরও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ১৯৮২ সালের কমিশনে স্বরাষ্ট্র, আইন, অর্থ ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবকেও যুক্ত করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের কমিশনে তারা ব্রাত্য। সংস্কার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে যুক্ত না করার সিদ্ধান্ত ভালো না মন্দ, এতে সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে কোনো বিঘ্ন বা প্রতিরোধ তৈরি হয় কি না- তা দেখতে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। তবে একান্ত ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ২০২৫ সালের এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তত স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করা যেত।

চলতি বছরের মার্চে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ১৮০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের মালিকানা, বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন প্রতিষ্ঠা, সাংবাদিকদের সুরক্ষা আইন, সাংবাদিকের স্বাধীনতা, মানহানি, সাইবার নিরাপত্তা আইন, আদালত অবমাননা, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, তথ্য অধিকার আইন, তথ্য-উপাত্ত অপসারণ, জাতীয় সম্প্রচার ও অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা, বেসরকারি টেলিভিশন, এফএম রেডিও, অনলাইন পোর্টাল, বিটিভি-বেতার-বাসস সম্পর্কে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। সুপারিশ আছে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও ভুয়া তথ্য মোকাবিলা নিয়েও। এছাড়া গণমাধ্যমে জেন্ডার সমতা, আদিবাসীদের জন্য সমসুযোগ তৈরি এমনকি প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন গোষ্ঠীর জন্য বিশেষায়িত আধেয় (কনটেন্ট) তৈরির প্রস্তাবও আছে এই কমিশনের সুপারিশে। সবশেষ সংস্কার প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ অংশ হিসেবে এই প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন অধ্যাদেশ: ২০২৫ এবং সাংবাদিকতা সুরক্ষা অধ্যাদেশ: ২০২৫-এর খসড়া। যেহেতু পুরো প্রতিবেদনে বিভিন্ন সুপারিশ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশনের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাই নাগরিকদের প্রত্যাশা ছিল সরকার হয়তো দ্রুত এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি গণমাধ্যম কমিশন অধ্যাদেশ: ২০২৫ প্রণয়নে তৎপর হবে।

কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম সেই পথে না হেঁটে বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতে গত ২০ জুন পাঁচ উপদেষ্টার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিক্ষা উপদেষ্টা সিআর আবরার। শিক্ষা উপদেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসন কমিটির! বিষয়টি আমার কাছে বিস্ময়কর ও প্রবল হতাশাজনক বলে মনে হয়েছে। উপদেষ্টা সিআর আবরার ও অন্য উপদেষ্টাদের যোগ্যতা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলছি না; কিন্তু গণমাধ্যম সম্পর্কে বিশেষায়িত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় তারা যে অগ্রগামী নন তা বলাইবাহুল্য। আর গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুস্পষ্ট সুপারিশ ছিল দ্রুত নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন গঠন করা।

যার সদস্য সংখ্যা, সদস্যদের যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা ও দায়িত্বের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা আছে সংস্কার প্রতিবেদনের সুপারিশমালায়। তাই বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন অধ্যাদেশ: ২০২৫ এবং সাংবাদিকতা সুরক্ষা অধ্যাদেশ: ২০২৫ জারির বিপরীতে নতুন করে স্বায়ত্তশাসন কমিটি গঠন নিতান্তই কালক্ষেপণ বলে মনে হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা ভালো বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতে ১৯৯৬ সালে সাবেক সচিব আসাফউদ্দৌলাহর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সরকারের বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী ইউএনডিপি এই প্রকল্পে ৮০ লাখ টাকা তহবিল দিয়েছিল। ১৯৯৬ সালের বাস্তবতায় এটি অনেক বড় অঙ্কের টাকা। ঔই কমিশনের প্রধান প্রস্তাব ছিল স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করার; কিন্তু তখনকার রাজনৈতিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়ীদের সন্দেহ, অনাগ্রহ ও প্রশাসনিক জটিলতায় সেই সুপারিশ মাঠে মারা যায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছা ও উদারতা ছাড়া বিটিভি-বেতারের স্বায়ত্তশাসন বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখনো এক অলীক কল্পনা। বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা বাদ দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কেন অতি কঠিন, অলীক কল্পনার পিছু নিল - তা পরিষ্কার হতে আরও সময় লাগবে।

নানা দিক পর্যালোচনা করে বুঝতে পারা যায় যে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের বাইরে আলাদা করে বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন বা বাংলাদেশ সম্প্রচার সংস্থা পরিচালনা পর্ষদ গঠনে আমলাতন্ত্র ও ভবিষ্যৎ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রবল অনীহা আছে। হয়তো ভেতরে ভেতরে মারাত্মক পর্যায়ের বিরোধিতাও আছে। তাই বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বর্তমানে অনেকটা অসম্ভব বলে মনে হয়; কিন্তু এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেতার-টিভি-বাসসকে এক ছাতার নিচে আনা সম্ভব ছিল। যে বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ তুলে ধরেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। কমিশনের সুপারিশে সরকারি অর্থ সাশ্রয় ও পেশাদার কাঠামো তৈরিতে যুক্তরাজ্যের বিবিসি ও জার্মানির ডয়েচে ভেলের আদলে একটি সমন্বিত কাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাব আছে। এই প্রস্তাবটি দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য। এতে সরকারি সম্পদের অপচয় রোধও সম্ভব; কিন্তু সরকার এদিকে নজর না দিয়ে কেন স্বায়ত্তশাসনের মতো কঠিন ও জটিল প্রক্রিয়ায় মনোযোগ দিল- তা বোঝা কঠিন। এটা কালক্ষেপণ নয়তো! পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা নয়তো! যতদূর জানা গেছে, এই একত্রীকরণের প্রস্তাবে প্রশাসনের অনীহা আছে। অর্থাৎ আমলাতন্ত্র কোনো অবস্থাতেই বেতার-বিটিভি-বাসসের একত্রীকরণের পক্ষে নয়।


গত ২৬ জুন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ দৈনিক প্রথম আলোতে জুলাই সনদে কী থাকছে, কী থাকা উচিত শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এতে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সরকারের আগ্রহ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি প্রায় প্রকাশ্যেই হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, গণমাধ্যম কমিশন সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের মতো সাংবাদিকের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও সূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা এবং সাংবাদিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন না করার অধিকার নিশ্চিত করার বিধান সংবিধানে যুক্ত করার যে প্রস্তাব করেছে তা আলোচনায় আসছে না।

এছাড়া ঐকমত্য কমিশনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আদালতের সমালোচনা নিয়ে যেসব বিষয়, যেসব প্রেক্ষিত আলোচনা হচ্ছে তাতেও মোটামুটি হতাশ গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান। বিশেষ করে ভবিষ্যৎ কর্তৃত্বপরায়ণ স্বৈরাচারের উৎসাহী সহযোগী হওয়া বন্ধ করতে গণমাধ্যম সংক্রান্ত যে প্রস্তাবিত সংস্কার সেসব বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের গতি-প্রকৃতি ও আলোচনার ধরন নিয়েও তিনি হতাশ- তা মোটামুটি স্পষ্ট। তিনি উল্লেখ করেছেন গণমাধ্যম সংস্কারের বিষয়টিকে তাই অগ্রাধিকার তালিকায় পেছনে ফেলে রাখা ভুল হবে। কামাল আহমেদ অন্তর্বর্তী সরকারের খুব কাছের লোক বলেই আমার ধারণা। সংস্কার নিয়ে তার এই শঙ্কা সত্যিই হতাশার। শুধু কামাল আহমদই নন, কমিশনের অন্য একজন সদস্য জিমি আমির গত ১০ আগস্ট সিপিডি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উষ্মার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, আমলারা চায়নি, তাই গণমাধ্যম সংস্কার হয়নি। এছাড়া ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় গণমাধ্যম কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা না হওয়াতেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জিমি আমির।

আমার ধারণা গণমাধ্যম সংস্কারের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের প্রধান বাধা আমলাতন্ত্র ও ক্ষমতাসীন হতে যাওয়া দলের অনীহা। বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কাঠামো হয়তো কোনো অবস্থাতেই চাইবে না আলাদা করে বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন বা বাংলাদেশ সম্প্রচার সংস্থা পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হোক। যাতে আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব খর্ব হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই সংস্কার বাস্তবায়ন বিশেষ করে বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে কামাল আহমেদ ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিন জোটের যে যৌথ অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করেছেন তার ওপর আস্থা রাখা কঠিন। কারণ, ক্ষমতাহীন দলের সাম্যের অঙ্গীকার আর ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মধ্যে রাতদিন ফারাক। মনে করিয়ে দেই, প্রবল কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার আগে শেখ হাসিনাও ঘোষণা দিয়েছিলেন- সপ্তাহে এক দিনের বেশি টেলিভিশনে আমার চেহারা দেখবেন না। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার এমনকি বেসরকারি গণমাধ্যমে কি ঘটেছিল সেই আলোচনায় না যাওয়াই ভালো।

উল্লেখ করা প্রয়োজন চলতি বছরের ২৯ জুলাই প্রেস কাউন্সিল পুনর্গঠন করেছে সরকার। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিসরে কাগুজে বাঘ নামে পরিচিত। যার কোনো কাজ নেই, কোনো কিছু বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা বা কাউকে শাস্তি দেয়ার সামর্থ্যও নেই। গণমাধ্যম সংস্কারের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ রেখে অন্তর্বর্তী সরকার এই কাজে কেন এত তৎপর হলো তা এক কথায় বিস্ময়কর।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ