সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে সীমিত আয়ের মানুষকে চাপে ফেলা কেন?
বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের সীমিত আয়ের মানুষের জন্য একটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সঞ্চয়পত্র বিবেচিত। বিশেষ করে চাকরিজীবী, পেনশনভোগী, গৃহিণী এবং প্রবাসীদের পরিবারগুলোর জন্য সঞ্চয়পত্র একটি অর্থনৈতিক সহায়ক হাতিয়ার; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকার যেভাবে ধারাবাহিকভাবে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হ্রাস করে চলেছে তা এসব মানুষের জন্য এক ধরনের আর্থিক অনিশ্চয়তার বার্তা বহন করছে।
বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ১ জুলাই থেকে আগামী ছয় মাসের জন্য সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমানো হয়েছে। ১ জুলাই থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে। নতুন হার অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সুদহার হবে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। ভুক্তভোগীরা মনে করেন অর্থবছরের পয়লা দিন প্রবীণ, অবসরভোগী ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমে যাওয়া একটি দুঃসংবাদ।
পৃথিবীর সব কল্যাণকামী রাষ্ট্রেই প্রবীণ, অসমর্থ ও অবসরভোগী মানুষের জন্য আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে। সেটি কোথাও নগদ অর্থ বা কম দামে পণ্য কেনার সুযোগের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এতটাই ভঙ্গুর যে খুব কম মানুষ এর থেকে সুবিধা পান। বিগত সরকারের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে সেই নিরাপত্তা কর্মসূচির সুফল যাদের পাওয়ার কথা, তারা পাননি। সে ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের একাংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের লভ্যাংশের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং এখনো আছেন। ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোয় তারা বিপদে পড়বেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে দেখা গেছে।
বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বেড়ে চলেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দেয়া সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলবে। যারা মূলত ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা ভেবে মাসের অল্প কিছু টাকা সঞ্চয় করতেন তাদের সেই উৎসাহ ও ক্ষমতা দুটিই এখন সংকুচিত হবে। অন্যদিকে, বাণিজ্যিক ব্যাংকে আমানতের সুদের হার অনেক নিচে। সেখানে সাধারণ মানুষের টাকা রাখলে প্রকৃত অর্থে তারা মূল্যস্ফীতির কারণে লোকসানের মুখে পড়ে। ফলে সঞ্চয়পত্র ছিল তাদের একমাত্র কিছুটা লাভজনক ও নিরাপদ বিকল্প। এই হার কমিয়ে দেয়ার অর্থ হলো, সীমিত আয়ের মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনির্ভরযোগ্য বিনিয়োগের দিকে ঠেলে দেয়া।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে এবং বাজেট ভারসাম্য বজায় রাখতে এই পদক্ষেপ প্রয়োজনীয়; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- কেন প্রতিবারই সেই ভারসাম্য আনতে গিয়ে বলির পাঁঠা হন সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও সাধারণ মানুষ? যেখানে ব্যাংক ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া হচ্ছে, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, সেখানে সাধারণ মানুষকে শাস্তি দেয়াটা কি ন্যায্য? এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার এমন পর্যায়ে রাখা প্রয়োজন যা একদিকে সরকারের দায়ভার সামাল দেবে অন্যদিকে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য নিরাপত্তার একটি স্তর বজায় রাখবে। সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়িয়ে কোনো রাষ্ট্রই টেকসই সমৃদ্ধির পথে এগোতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে সীমিত আয়ের মানুষকে চাপে ফেলা কেন? এমনিতেই তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কম। আমরা সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে