অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নারীর মৃত্যুনিবন্ধন নিশ্চিত হোক
যারা বেঁচে থাকে তাদের জন্য প্রিয়জনের মৃত্যুনিবন্ধনও যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল তা বাংলাদেশের অনেকেই জানেন না, ফলে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুনিবন্ধন কম হয়। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে মৃত্যুনিবন্ধন প্রয়োজন হয়, তা ছাড়া অন্যান্য সরকারি কাজেও মৃত্যুনিবন্ধন দরকার হয় বলে মৃত্যুনিবন্ধনের গুরুত্ব কিছুটা বেড়েছে; কিন্তু সেখানেও আছে বৈষম্য।
গতকাল রোববার (২০ জুলাই) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পুরুষের তুলনায় নারীর মৃত্যুনিবন্ধনের হার অনেক কম। নারী সম্পত্তির মালিক হলেই কেবল তার মৃত্যুনিবন্ধন হয়। এতে অনেকগুলো বিষয়ই বোঝা যায়। এক. সম্পত্তির অধিকারে নারী এখনো বৈষম্যের শিকার; দুই. নারীর সামাজিক মূল্যায়ন এখনো অনেক কম।
গত শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে নারীর মৃত্যুনিবন্ধন বিষয়ে একটি গবেষণা ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে গবেষক ও নারী অধিকারকর্মীরা এসব কথা বলেন। নারীর মৃত্যুনিবন্ধন বিষয়ে যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাটা ফর হেলথ ইনিশিয়েটিভ। অনুষ্ঠানে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও কর্মকর্তারা অংশ নেন।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন, ২০০৪-এর উদ্ধৃতি দিয়ে অনুষ্ঠানে বলা হয়, মৃত ব্যক্তির তথ্য (নাম, বয়স, মৃত্যুস্থান, তারিখ) মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। আইনটি নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নারীর মৃত্যুনিবন্ধনের হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব বলছে, পুরুষের মৃত্যুনিবন্ধন হচ্ছে ২৬ শতাংশ, নারীর ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশ।
স্বাগত বক্তব্যে ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন ও পরিচালক লরা রিচেনবেচ বলেন, নারীর মৃত্যুনিবন্ধন শুধু পরিসংখ্যানগত কোনো বিষয় নয়, এটি অধিকারের বিষয়। নারীর মৃত্যুনিবন্ধন কম, এর অর্থ তাদের অধিকার অবনমিত। তিনি আরও বলেন, আর্থসামাজিক কিছু কারণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জনবল ও সামগ্রীর ঘাটতির কারণে নারীর মৃত্যুনিবন্ধন কম হয়।
মৃত্যুনিবন্ধন শুধু সম্পত্তির ভাগাভাগীর ক্ষেত্রেই যে প্রয়োজন তা নয়, এর সঙ্গে আরও অনেক সাংস্কৃতিক বিষয়ও যুক্ত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশেষ করে দু-তিন দশক আগেও এটা খুবই দেখা যেত যে, অনেক সন্তান তার পিতা-মাতার মৃত্যুর তারিখটিও ঠিক মতো মনে রাখতে পারতেন না। জন্মনিবন্ধন ও মৃত্যুনিবন্ধনের সাংস্কৃতিকচর্চাটি এ দেশে প্রাচীনকাল থেকেই তেমন প্রচলিত না। অথচ পশ্চিমা দেশগুলোতে দেখা যায় তিন-চারশ বছর আগে থেকেই তা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এর সঙ্গে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস যেমন জড়িত, তার সঙ্গে পারিবারিক স্মৃতিরক্ষা ও শিক্ষাদীক্ষার বিষয়টিও জড়িত।
গবেষকরা বলছেন, নারীর মৃত্যুনিবন্ধনে অন্তত পাঁচটি বাধা আছে। নিবন্ধন বিষয়ে মানুষের ধারণা বা সচেতনতা কম। নারীর জমি ও সম্পদ না থাকায় তার মৃত্যুনিবন্ধনের প্রয়োজনবোধ করেন না পরিবারের সদস্যরা। প্রতিক্রিয়া হিসেবে বা বিলম্বে নিবন্ধন করা হয়, যখন আইনি জটিলতা বা আর্থিক প্রয়োজন পড়ে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে অনেক সময় নিবন্ধন হয় না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের নারীদের ক্ষেত্রে। সরকারি দপ্তরগুলোর অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে নিবন্ধন হয় না।
আমরা চাই আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। তার সামাজিক মূল্যায়ন নিশ্চিত হোক। বৈশ্বিক প্রয়োজন না থাকলেও মৃত্যুর পর তার মৃত্যুনিবন্ধন নিশ্চিত হোক। সন্তানরা এটা করতে পারেন কেবল সাংস্কৃতিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠলেই। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারেরও উচিত কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ। নারীর মৃত্যুনিবন্ধন বাড়ার মধ্য দিয়েও তাহলে আমরা বুঝতে পারব পরিবারে-সমাজে-রাষ্ট্রে নারীর কতখানি অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে