ইরান-ইসায়েলের পাল্টাপাল্টি আক্রমণ
মিশাইল নয়, আকাশে উড়ুক শান্তির পায়রা
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব-অর্থনীতি যখন টলমান, বিশ্ব-রাজনীতিতে অস্থিরতা বিরাজমান, ঠিক তখনই আরো এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের আলামত দেখা যাচ্ছে ইরান-ইসায়েলের পাল্টাপাল্টি আক্রমণে। ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ বাঁধলে শুধু এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য নয়; সমগ্র বিশ্বেই তার বিরোপ প্রভাব পড়বে। এখনই এ নিয়ে বিশ্বনেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক-বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদ, সাধারণ মানুষ ও আন্তর্জাতিক ব্যবাসায়ীরা প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা প্রক্রাশ করছেন। বিশ্বনেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যে দুপক্ষকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু যে চরম সংকট শুরু হয়েছে দুপক্ষের মধ্যে, তা কি কারও কথায় শান্ত হবে?
ইরান-ইসরায়েলের আজকের সংকট অনেকটাই ঐতিহাসিক। বিশ্ববিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েডের একটা কথা আছে, যে, এ-ধরনের যুদ্ধে একপক্ষ আরেকপক্ষকে সম্পূর্ণ বিনাশ করার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ চলতেই থাকে। তাহলে কি একপক্ষ আরেকপক্ষকে পুরোপুরি ধ্বংস করার আগ পর্যন্ত তারা খ্যান্ত হবে না!
ইরান-ইসরায়েল দুপক্ষই মোটামুটি কাছাকাছি শক্তি, এ-ক্ষেত্রে একপক্ষ আরকপক্ষকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করাও সহজ হবে না। তার মানে যুদ্ধ চলতে থাকবে বছরের পর বছর ধরে, আর তাতে সাধারণ মানুষের জীবন পরিণত হবে জাহান্নামে। ইরান ও ইসরায়েল কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকলেও দু’দেশের সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের অর্থনীতিও। লন্ডভন্ড করে দেবে তেল, গ্যাস ও জাহাজ চলাচলের নেটওয়ার্ক। সংঘাত যুদ্ধে রূপ নিলে চট্টগ্রাম বন্দরে এখন যেসব জাহাজ আসা-যাওয়া করছে, সেগুলোর পণ্য পরিবহন খরচ বাড়বে বহু গুণ। বেড়ে যাবে জ্বালানি তেলের দামও। কারণ, বাংলাদেশ এখন যে জ্বালানি তেল আমদানি করছে, এর বেশির ভাগই আসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ইরান-ইসরায়ের যুদ্ধের সূত্রপাতে হুমকিতে তেল, গ্যাস ও জাহাজ চলাচলের পথ। বাড়বে জাহাজের পরিচালন খরচ, কমবে আমদানি-রপ্তানি। এরই মধ্যে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। হরমুজ প্রণালী নিয়ে উদ্বিগ্ন শিপিং ব্যবসায়ীরা।
হরমুজ প্রণালি হচ্ছে পারস্য উপসাগরের একটি জলপথ। ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের মাঝখানে অবস্থিত এই সংকীর্ণ জলপথটি বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকার জ্বালানি তথ্য সংস্থা (ইআইএ) জানায়, প্রতিদিন বিশ্বে যে পরিমাণ তেল ব্যবহার হয়, এর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ, অর্থাৎ ১ কোটি ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি ৯০ লাখ ব্যারেল তেল হরমুজ প্রণালি দিয়ে পরিবহন হয়। দু’দেশের চলমান উত্তেজনা দীর্ঘায়িত হলে অনেক তেলবাহী ট্যাঙ্কার আটকা পড়বে। তেলের দাম তখন আকাশ ছুঁতে পারে। অপরিশোধিত তেলের দাম এরই মধ্যে এক ঝটকায় ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অপরিশোধিত তেলের অন্যতম মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭৫ দশমিক ১৫ ডলারে দাঁড়ায়, গত পাঁচ মাসে যা সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্পকারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। দেশে জ্বালানি তেল মজুতের সক্ষমতাও পর্যাপ্ত নেই। মাত্র ৪৫ দিনের জ্বালানি মজুত রাখতে পারে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মতো নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই। জ্বালানি তেলের অভাবে অনেক কল-করখানা বন্ধ হয়ে যাবে, পরিবহনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। তার মানে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে। দেখা দিবে খাদ্য-সংকট। তারপর আর কী কী সংকট দেখা দিতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
তাই যুদ্ধ কারোই কাম্য না। তাও এক যুদ্ধাক্রান্ত বিশ্বেই আমাদের বসবাস। প্রতিটা যুদ্ধই মানবসভ্যতার সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-নীতি-নৈতিকতার দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করে, আমরা কি সত্যিই আগ্রসর হলাম, না কি এক ধ্বংসযজ্ঞের পৃথিবী গড়াই আমাদের নিয়তি! পৃথিবী কি এখনো কেবল কতিপয় রাজনীতিবিদের হাতিয়ার হয়ে থাকবে? না কি সাধারণ মানুষ জেগে উঠবে তীব্র প্রতিবাদ নিয়ে? পৃথিবীর সমস্ত মানুষের এখন একযোগে ঘোষণা করার সময়, মিশাইল নয়, আকাশে উড়ুক শান্তির পায়রা!
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে