Views Bangladesh Logo

জহির রায়হান হত্যাকাণ্ড নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অবসান হোক

Rahat  Minhaz

রাহাত মিনহাজ

যুদ্ধের অন্যতম অপরিহার্য অনুষঙ্গ প্রচারণা। যুদ্ধ মানেই তথ্য সন্ত্রাস, তথ্য বিকৃতি। যুদ্ধ মানেই বিকৃত ও মিথ্যা তথ্যে মনোজগৎ দখলের নিরন্তর চেষ্টা। যুদ্ধ মানেই স্মৃতির বিরুদ্ধের বিস্মৃতির লড়াই। বিংশ শতাব্দীতে যুদ্ধ নিয়ে প্রচার-প্রচারণার অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন হিটলারের প্রোপাগান্ডা মিনিস্ট্রির (Reich Ministry of Public Enlightenment and Propaganda) প্রধান জোসেফ গোয়েবেলস, যার মূল দর্শন ছিল If you tell a lie big enough and keep repeating it, people will eventually come to believe it.

ডাহা মিথ্যা তথ্য প্রচার ও জনগণের ভাবজগৎ দখলের সেই মডেল ১৯৭১ সালে অনুসরণ করেছিল ইয়াহিয়ার পাকিস্তান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ক্র্যাকডাউনের পর পাকিস্তানিরা তাদের গণহত্যা জায়েজ করার চেষ্টা শুরু করে। তারা দেখাতে চায় ভারতের মদদপুষ্ট দুষ্কৃতকারীরা! ঢাকা তথা পূর্ব পাকিস্তানে বর্বর আক্রমণ পরিচালনা করছে। যার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিচ্ছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

পাকিস্তানি সেনা জান্তার এই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করেছিল এক শ্রেণির ভাড়াটে সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরাও। তবে এই প্রচারণার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন একজন বাঙালি। যার নাম জহির রায়হান। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম উজ্জ্বল চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাহিত্যিক। ভিনদেশি এক বহুল প্রচলিত গণমাধ্যমকে জহির রায়হান এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, যা এখনো ভিডিও শেয়ারিংয়ের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইউটিউব এ পাওয়া যায়।

সেই সাক্ষাৎকারে জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘In Bangladesh the most surprising aspect that was when a military unit was moving for an operation, they were (Pakistani army) destroying and killing people, they were taking shots by a movie camera of the dead body, after burning a house they were taking shots of the burnt house by a movie camera, after unveiling the people to loot a shop they were taking shots of those looters by a movie camera and later on when I heard and when I saw they edited those portion and release it to our people telling and showing that the Bangalis killing Non-Bangalis and because of this chaos and confusions, they had to intervene, It was an utter lie’


বিশ্ব গণমাধ্যমে জহির রায়হানের এই বক্তব্য বিশেষ প্রভাব রেখেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে যে গণহত্যা চলছে তা সায়মন জন ড্রিং (দ্য টেলিগ্রাফ) ও এ্যান্থনী মাসকারেনহাসের (দ্য সানডে টাইমস) মাধ্যমে বিশ্ববাসী আগে থেকেই জানতো। পরে পাকিস্তানিদের বর্বরতা সবাই আরও নানাভাবে জেনেছে। যাতে জাহির রায়হানের এই বক্তব্য মিলে যাওয়ায় পাকিস্তানিদের নৃশংসতা উপলব্ধি করা সহজ হয় বিশ্ববাসীর জন্য।

যুদ্ধ দিনে জাহির রায়হানের আরও এক অনন্য অবদান ‘স্টপ জেনোসাইড’। যা পূর্ব বাংলায় সংঘটিত গণহত্যার অন্যতম প্রাধান প্রামাণ্য দলিল। মাত্র ১৮ মিনিটের এই তথ্যচিত্রে জহির রায়হান বাংলার বুকে পাকিস্তানিদের বর্বরতাকে তুলে ধরেছেন। যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ তুলনা করা হয়েছে হালাকু খান ও অ্যাডলফ হিটলারের গণহত্যার সঙ্গে।

এই তথ্যচিত্রে ভারতে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ শরণার্থীর চরম দুঃখ, দুর্দশার উঠে এসেছে। মানুষ কীভাবে প্রতিকূল পরিবেশে বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে প্রাণভয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে তার জীবন্ত বর্ণনা রয়েছে স্টপ জেনোসাইডে। তথ্যচিত্রে তুলে ধরা কাদা মাখা প্রতিকূল পথের যে বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ। এই তথ্যচিত্র নির্মাণে জহির রায়হানকে একান্তভাবে সহযোগিতা করেছিলেন আরেক গুণী চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবীর। আর এতে স্পষ্ট প্রভাব ছিল কিউবান চলচ্চিত্র নির্মাতা সান্টিয়াগো আলভারেজের (Santiago Álvarez)। ৩৫ মিলিমিটার ফরমেটে সাদা-কালো এই তথ্যচিত্রের মূল লক্ষ্যই ছিল বিশ্বব্যাপী বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে বিশ্ব জনমত তৈরি করা।

১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর এই সরকারের অধীনে ‘চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তর’ নামের একটি বিভাগ চালু করা হয়েছিল। সে সময় কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া অনেক গুণীজন এই বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে দুঃখের বিষয় স্টপ জেনোসাইড করতে গিয়ে এই বিভাগের কোনো সহযোগিতা পাননি জহির রায়হান। সে সময়ে কলকাতায় অবস্থান করা যুব নেতারা তার বিরোধিতা করেছেন। তবে জহির রায়হানের পাশে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।

এ বিষয়ে তিনি তার অকুণ্ঠ সমর্থন পান। সঙ্গে এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে আগ্রহ দেখান ভারতের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি এই চলচ্চিত্র ক্রয় করে তা দেশে বিদেশে প্রদর্শন করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগকে নির্দেশ দেন। মাত্র ১৮ মিনিটের এই তথ্যচিত্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত গণহত্যার প্রামাণ্য দলিলে পরিণত হয়। যা বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই তথ্যচিত্রের মূল চিত্রধারণ সম্পন্ন হয় কলকাতায় স্থাপিত শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে। যা এক বিশেষ আবেদন তুলে ধরে বিবেকবান বিশ্ববাসীর কাছে।

যুদ্ধদিনে কলকাতায় জহির রায়হান বিশেষ ভূমিকা রাখলেও স্বাধীন বাংলাদেশে তার জন্য অপেক্ষা করছিল ভীষণ এক খারাপ খবর। বিজয়ের ঊষালগ্নে জহির রায়হানের ভাই সাংবাদিক, সাহিত্যিক শহীদুল্লা কাউসারকে তুলে নিয়ে যায় আল বদর বাহিনী। এই ভাইকে খুঁজতেই পাগলের মতো এখানে সেখানে চষে বেড়িয়েছেন জহির রায়হান। সবশেষ ১৯৭২ সালে ৩০ জানুয়ারি ভাইয়ের সন্ধানে একদল সেনার সঙ্গে গিয়েছিলেন মিরপুরে। মিরপুর তখনো এক বিপদসংকুল এলাকা। পরাজিত পাকিস্তানি সেনারা প্রচুর অস্ত্র বিহারিদের হাতে তুলে দিয়েছিল। যার মাধ্যমে পুরো মিরপুরকে বিহারিরা একটা দুর্গে পরিণত করে। শত্রুদের এই দুর্গেই ভাইয়ের সন্ধানে গিয়ে শহীদ হন জহির রায়হান।

এক জেনারেলের সাক্ষাতে জহির রায়হানের মৃত্যু
জহির রায়হানের অন্তর্ধান বা মৃত্যু নিয়ে নানা কথা, গল্প ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব চালু আছে। এ বিষয়ে বহুল আলোচিত সব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনেকেই প্রতিপক্ষকে বিব্রত করতে ব্যবহার করে থাকেন। তবে জহির রায়হানের মৃত্যু নিয়ে এক বিশেষ গ্রহণযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) বীর বিক্রমের ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’ বইতে। তাতে তিনি উল্লেখ করেন ‘তিনি (জহির রায়হান) ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজেই মিরপুর যান। ভোরবেলায় তিনি মিরপুরে গেলে সৈন্যরা তাকে ভেতরে যেতে বাধা দেয়। পরে সৈনিকেরা তাকে ২নং সেকশনে কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের কাছে নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন মোর্শেদ তখন পুলিশ ও তার প্লাটুন কমান্ডারদের সঙ্গে সমন্বয় সভায় ব্যস্ত।

ক্যাপ্টেন মোর্শেদকে তার আসার উদ্দেশ্য জানানোর পর তিনি বলেন ‘ঠিক আছে তিনি পুলিশের সঙ্গে ভেতরে যেতে পারেন।’ এই বলে ক্যাপ্টেন মোর্শেদ তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রাথমিক তদন্তের সময় সাড়ে ১১ নং সেকশনে মোতায়েন সৈন্যদের কয়েকজন জানান, সকাল ৯টা/১০টার দিকে তারা হালকা-পাতলা গড়নের একজন বেসামরিক লোককে সাড়ে ১১ ও ১২ নং সেকশনের মাঝামাঝি রাস্তায় একা একা হাঁটতে দেখেন। এছাড়া জহির রায়হানের ছবি দেখার পর সৈন্যদের কয়েকজন ওই রকম গড়নের একজনকে দেখেন বলেও জানান। ১১টার দিকে বিহারিরা সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করে। অতর্কিত সেই আক্রমণে সৈন্যদের সঙ্গে তিনিও নিহত হন। তবে ঠিক কোন জায়গায় তিনি নিহত হন তখন তা সঠিক কেউ বলতে পারেনি। ৪২ জন সেনাসদস্যদের মধ্যে তিন-চারজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জহির রায়হানসহ বাকি কারোই মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।’ (পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪) জহির রায়হানের অন্তর্ধান নিয়ে এটাই আজ পর্যন্ত অধিকতর গ্রহণযোগ্য ঘটনাপ্রবাহ।

জহির রায়হান হত্যাকাণ্ড ও দৈনিক ভোরের কাগজের অনুসন্ধান:
কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রপরিচালক জহির রায়হানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কম জল ঘোলা হয়নি। কলকাতায় মুজিবনগর সরকারের যুবনেতাদের সঙ্গে তার নেতিবাচক সম্পর্কের সূত্র ধরে অনেকেই মিথ্যা প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন। ছিল রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রচেষ্টা। যদিও সেই প্রচেষ্টায় কিছুটা হলেও জল ঢেলে দিয়েছিলেন দৈনিক ভোরের কাগজের অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক। দেশের ইতিহাসের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ১৯৯৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল ‘নিখোঁজ নয়, গুলিতে নিহত হয়েছিলেন জহির রায়হান’ শিরোনামের প্রতিবেদন।

এই অনুসন্ধানে যুক্ত ছিলেন জহির রায়হানের সন্তান অনল রায়হানও। মুক্তিযোদ্ধা নায়েক আমির হোসেনের সহযোগিতায় পুরো অনুসন্ধান চালিয়ে তারা বের করে আনেন প্রকৃত সত্য। যাতে জানা যায়, নায়েক আমির হোসেন, সেদিন আর্মি ও পুলিশের থাকা একমাত্র সিভিলিয়ান সাংবাদিক ভদ্রলোককে তিনি (আমির হোসেন) নিজের চোখে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখেছিলেন। এর যাতে তাকে (জহির রায়হানকে) টেনে হিঁচড়ে বধ্যভূমিতে নিয়ে যেতেও দেখেছিলেন। ঊর্ধ্বতন এক সেনা কর্মকর্তা তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ‘সাংবাদিক’ হিসেবে। আমিরের প্রতি নির্দেশ ছিল ওই সাংবাদিকসহ অন্যদের পাহারায় থাকা।

মোটামুটি এটাই ছিল জহির রায়হানের হত্যা রহস্য। এ বিষয়ে এখনো সরকারি ভাষ্য আজও পাওয়া যায়নি। সরকারি কোনো দপ্তর বা পুলিশ এ বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান বা তত্ত্ব-তালাশও করেনি। যদিও যা হওয়া খুবই প্রয়োজন ছিল। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু নিয়ে রাষ্ট্র যে অবহেলা দেখিয়েছে বা এখনো দেখাচ্ছে, তা এক কথায় অমার্জনীয়।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ