Views Bangladesh Logo

মাইলস্টোন দুর্ঘটনার মতো ঘটনা আর যেন না ঘটে, তার ব্যবস্থা করুন

দেশজুড়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় হতভম্ব এবং শিউরে উঠেছে যে, তাদের সন্তানরা স্কুলে এবং কলেজে কতখানি ঝুঁকিমুক্ত এবং সুরক্ষিত। দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি এবং সীমা দেখে বলাই বাহুল্য- দেশের জননিরাপত্তা একেবারেই সুরক্ষিত নয়, এ ঘটনাই তার বাস্তব প্রমাণ। আর আধাঘণ্টা পর ঘটনাটি ঘটলেও হয়ত অনেক শিশু এবং কিশোর বেঁচে যেত; কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস যখন আর মাত্র কিছু সময় পড়ে তারা মা-বাবা বা কোনো গুরুজনের কোলে চড়ে গল্প করতে করতে বাড়ির দিকে রওয়ানা হবে, তার মাত্র কিছু সময় আগে অর্থাৎ যখন শিক্ষকরা তাদের নিত্যদিনের মতো লাইনে দাঁড় করিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি করছিল, তখনই এরকম স্মরণকালের একটি অতীব দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল।

আজকের পত্রিকায় দেখলাম এক ভদ্রলোক একটি ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হতবিহ্বল অবস্থায়। তিনি তার সন্তানকে খুঁজে পেয়েছেন; কিন্তু তাকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন তার স্ত্রী তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। এটা কতটা হৃদয়বিদারক ভাবুন তো!

ইন্টারনেট এবং তথ্য প্রযুক্তির যুগে আমরা যে যেখানে ছিলাম, কর্মস্থলে বা বাড়িতে বা রাস্তায় অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলাম পুরো ঘটনাটি। একটি শিশুকে দেখলাম হয়ত তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে তার সমস্ত শরীর পুড়ে গেছে, তার প্রায় পুড়ে যাওয়া ব্যাগটি হাতে দেখা যাচ্ছে , চুল পুড়ে গিয়েছে, পরিহিত শার্ট , প্যান্ট পুড়ে গেছে শরীরের সঙ্গে লেগে গেছে, মুখটি বোঝা যাচ্ছে না।শিশুটি তখনো দাঁড়িয়েছিল, হয়ত একটু সাহায্যের আশায় তার পরে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে জানি না, সে খুঁজছিল হয়ত কাউকে, যে তাকে একটু চিকিৎসা দিতে পারে , শিশুটি বেঁচে গেছে কি না, বলতে পারব না, তবে এ দৃশ্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, যেই দেখেছে শিউরে উঠেছে। ভয়ানক এ দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়!

আমি দুটি দিক থেকে বিষয়টি দেখি। ছবিতে দেখা গেলো কিছু লোক ভয়ানক ব্যস্ত ছবি তোলার জন্য, ইউটিউব এ যত তাড়াতাড়ি তিনি সেটা পোস্ট করতে পারেন তার প্রতিযোগিতা, অসংখ্য মোবাইল হাতে উৎসুক জনতাকে দেখা গিয়েছে তারা ঘটনার ভিডিও করতে ব্যস্ত। মানুষকে ঠেলে সরানো যাচ্ছিল না যার ফলে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হয়েছে, যে ছেলেটির উদাহরণ দেয়া হলো তার সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল চিকিৎসা; কিন্তু সেটি কখন হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি না জানি না।

আর একটি বিষয় দূর থেকে দেখে মনে হয়েছে, সেনাবাহিনীর একটি বড় দল ব্যস্ত হয়ে পড়ল বিমানের বিধ্বস্ত অংশ সরিয়ে ফেলার জন্য। সকলে আরও একযোগে কাজ করলে আরও দ্রুত শিশুদের হাসপাতালে নিতে পারলে হয়ত আরও কিছু প্রাণ বেঁচে যেত। তবে কিছু ভলানটিয়ার প্রতিটি দুর্ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের যেমন দেখা যায়, তারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে। দেখা গেছে, অসংখ্য প্ল্যাকার্ড হাতে বিভিন্ন বয়সী ছাত্র, অভিভাবক রক্ত দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, দেখে সত্যিই আপ্লুত হয়েছি। রিকশাওয়ালা, মুটেওয়ালা, ভ্যান গাড়িওয়ালা এমনকি বাসওয়ালা বুক পেতে দিয়েছে সাহায্যের জন্য, দেখে চোখে পানি চলে এসেছিল, এরাই সত্যিকারের মানুষ ।

শিশুদের আত্মীয়স্বজন তাদের বাচ্চাদের খুঁজে পাচ্ছিল না, এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে তারা ছুটছিলেন তাদের অতি আদরের সন্তানদের জন্য তাদের আহাজারি এক হৃদ্যয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। এ দৃশ্য যেমন দেখা যায় না তেমন ভোলাও যায়নি, এখন কথা হলো এই পরিস্থিতি কতটা এড়ানো যেত। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি প্রশিক্ষণ ফাইটার জেট একটি জনবহুল শহুরে এলাকায়, একটি ব্যস্ত কমার্শিয়াল রানওয়ে ব্যবহার করে দিনের এমন একটি ব্যস্ত সময়ে যখন শহরের প্রতিটি মানুষ তাদের কাজের মধ্য রয়েছে তখন এ উড্ডয়নটি কতটা যৌক্তিক হয়েছে। এ প্রশিক্ষণ ফাইটার জেটটি যদি এমন একটি সময় বেছে নিত, যখন মানুষ কম বাইরে থাকে, তাতে হতাহত অনেক কম হতে পারত। যেমন ভোররাতে বা খুব সকালে ইত্যাদি, এটা এয়ারফোর্সের নিয়মের মধ্য হয়ত পড়ে না।

এ ছাড়াও যেটা জানা গেল যে প্রশিক্ষণ ফাইটার জেটটি অনেক পুরোনো ছিল, অতীতে এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে পাইলটকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, কারণ অনেক পুরাণ এয়ারক্রাফট ব্যবহার করা হয়েছে। এ ঘটনাটি অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশ এয়ারক্রাফট ফোর্সে এ ধরনের কতগুলো ফাইটার জেট রয়েছে, কিছু আরোও কেনার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত হচ্ছে কিনা। আমরা জানতে পেরেছি, রিসিপ্রক্যাল ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশ বোয়িং কেনার জন্য চেষ্টা করছে। সে ব্যাপারে এখন থেকেই সাবধান হয়ে ভিন্ন পলিসি চিন্তা করতে হবে।

একটি ছোট্ট শিশুর একটি আইডেন্টিটি কার্ড দেখলাম, অসংখ্য স্কুল ব্যাগ, ছেড়া খাতা, পানির বোতল, জুতা মনে করিয়ে দিয়েছে এগুলো যাদের জন্য নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল তারা আর এগুলো কোন দিন ব্যবহার করবে না। ভাবতে পারি না শিশুর মা বাবার কি অবস্থা। তারা এমনকি কেউ কেউ তাদের সন্তানদের মৃত দেহটি পর্যন্ত দেখতে পেলেন না । পুড়ে এমন দলা পাকানো অবস্থায় কিছু মৃতদেহ বেড় করা হয়েছে যা দেখে চেনার উপায়টি পর্যন্ত নেই। এরকম বীভৎস পরিস্থিতি কেন হলো? শিক্ষার্থীদের চাপে শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার করা হলো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ হবে কি? এইচএসসি পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আরও দাবি রয়েছে শিক্ষার্থীদের।

এগুলোর পেছনে কি কি কারণ থাকতে পারে। এরকম একটি জনবহুল জায়গার এত কাছে একটি বিমান এয়ারফোর্স বেইজ কি করে হতে পারে যেখানে এমন বিমান ব্যবহার করা হয় । ২৩ বৎসর ধরে সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলটিই বা কেন বিমান এয়ারফোর্স বেইজের এত কাছে প্রতিষ্ঠিত হলো, কোনটি আগে হয়েছে। এবারের এসএসসি রেজাল্টও বেশ ভালো এ স্কুলের সবাই আনন্দ উদ্যাপন করেছে । অভিভাবকরা উৎসাহী হয়ে তাদের সন্তানদের এ শিক্ষালয়ে পাঠিয়েছেন ।

প্রায় ৬ হাজার স্টুডেন্টস এবং অসংখ্য গুণগত মানসম্মত শিক্ষকেরদের সমন্বয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি সুনামের সঙ্গে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল, এ ঘটনার পরে নিশ্চয়ই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এখানে পড়তে পাঠাতে নিশ্চিত বোধ করবেন না। আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কি তাদের সঠিক নিয়ম মেনে তাদের অবকাঠামো তৈরি করেন। আর কিছুদিন ইনভেস্টিগেশন করলেই দেখা যাবে এগুলোর মধ্যও হয়ত অনেক সমস্যা আছে। নিরীহ শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্টসহ অনেকের অকাল মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনায় আমরা ভীষণ ভাবে শোকাহত ও ব্যথিত। এই শোকাবহ ঘটনা আমাদের হৃদয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। আমরা শুধু অভিভাবকদের সান্ত্বনাই দিতে পারি; কিন্তু সেটা একেবারেই যথেষ্ট নয়।

কাঠামোগত ত্রুটি, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অথবা অন্য কোনো দুর্বলতা যাই থাকুক না কেন, যে প্রেক্ষাপটে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, তার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়াও উচ্চ জন-ঘনত্ব ও শিল্পাঞ্চল ঘেঁষা বিশেষ করে রাজধানী এলাকায় এ ধরনের দুর্ঘটনা, নিরাপত্তাগত মানদণ্ড, কাঠামোগত ঝুঁকি নিরীক্ষা ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আরও কঠোর বিধিবিধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের আশু প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই দুর্ঘটনার পদ্ধতিগত সংস্কার এবং জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তার প্রতি একটি স্পষ্ট সতর্কীকরণ বার্তা। আমরা আশা করি, একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে এই ঘটনার মূল কারণ চিহ্নিত করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে।

এই দুঃখজনক এবং কঠিন সময়ে যারা তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্ব নিয়ে দুর্ঘটনার পরপরই পাশে দাঁড়িয়েছেন, সেইসব অকুতোভয় উদ্ধারকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী এবং সাহসী চিকিৎসকদের প্রতি আমরা অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের পরিবার, ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রতি আমাদের আন্তরিক সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশ করছি এবং নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। সে সঙ্গে এরকম ঘটনার আর কোন পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের একাট্টা হয়ে কাজ করার অনুরোধ জানাই।

ফেরদৌস আরা বেগম: অর্থনীতিবিদ এবং প্রধান নির্বাহী, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ