সাদা পাথরের কান্না আর লুটপাটের মহাকাব্য
বাংলাদেশ—এমন এক দেশ, যেখানে ইতিহাস, রাজনীতি আর চুরি—এই তিনটি শব্দ যেন জন্ম থেকেই হাত ধরাধরি করে চলেছে। এখানে নদীর মতোই সততার প্রবাহও কখনো কখনো শুকিয়ে যায়। প্রকৃতি যেমন ধীরে ধীরে রূপ হারায়, সৎ মানুষও তেমনি বিলুপ্তির পথে হাঁটে।
সম্প্রতি সিলেটের ভোলাগঞ্জ আলোচনায় এসেছে সাদা পাথরের অবৈধ উত্তোলনের জন্য। পত্রিকার শিরোনামে, সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষোভে, আর চায়ের দোকানের আড্ডায় এখন ‘সাদা পাথরের কান্না’। কিন্তু সত্যি কথা বলতে—এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। এটি বাঙালির এক দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিক অধ্যায়। পার্থক্য শুধু একটাই: আগে চুরি হতো লুকিয়ে, এখন হয় রাষ্ট্রের নীরব আশীর্বাদে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ফটোসেশনের স্টাইলে।
ঐতিহাসিক মেগাস্থেনিস গঙ্গার উপত্যকার মানুষের সততা নিয়ে একসময় প্রশংসা করেছিলেন। হিউয়েন সাঙের লেখা অনুযায়ী, আমাদের সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত ছিল, আর মানুষ একে অপরের সম্পত্তি স্পর্শ করত না। কিন্তু যদি তারা আজ কবর থেকে উঠে এসে ভোলাগঞ্জের নদীর গর্ত দেখতেন, নিশ্চিত ভাবতেন—এটা নিশ্চয়ই মঙ্গলগ্রহের কোনো খনিশিল্প এলাকা।
আজকের বাংলাদেশে চুরি এক শিল্পে পরিণত হয়েছে। ম্যানহলের ঢাকনা, রাস্তার ডিভাইডারের রেলিং, সেতুর নাট-বল্টু, এমনকি গাছের গুঁড়িও নিরাপদ নয়। আর প্রকৃতির উপর এই দক্ষতার প্রয়োগ—নদীর তলদেশ থেকে পাথর তুলে, পাহাড় কেটে, বালু চুষে নেওয়া—এ যেন আমাদের জাতীয় বিশেষত্বের নতুন সংজ্ঞা।
অথচ একসময় ভোলাগঞ্জ ছিল পর্যটকের স্বপ্নভূমি—স্বচ্ছ পানির ধারা, সাদা পাথরের স্তূপ, আর দূরের সবুজ পাহাড়ের সারি। প্রকৃতি যেন সেখানে নিজের রূপসজ্জা করে রেখেছিল। আজ সেই সৌন্দর্যের জায়গায় দেখা যায় গর্ত, ঘোলা পানি, পাথরশূন্য তলদেশ, আর ধুলোর আস্তরণ। নদীর বুকে নৌকার সারি দেখে মনে হয় যেন কেউ ‘লুটেরাদের মহাযজ্ঞ’ নামের সিনেমার শুটিং করছে।
স্থানীয়রা জানায়, পাথর চুরির চক্র এত শক্তিশালী যে মুখ খোলা মানে নিজের জান-মাল বন্ধক রাখা। আগে আমরা চোখের সামনে জাফলং ধ্বংস হতে দেখেছি, এবার সেই ধ্বংসলীলা নেমেছে ভোলাগঞ্জের উপর।
ঢাকায় ম্যানহলের ঢাকনা উধাও, ডিভাইডারের লোহার রেলিং অদৃশ্য, এমনকি গণভবনের কার্পেটও একসময় লোপাট হয়েছিল। যদি বাঙালির চুরি-লুটপাটের ইতিহাস লেখা হয়, তা হবে মহাকাব্যিক—’মহাভারত’-এর চেয়েও বড়, ‘ইলিয়াড’-এর চেয়েও রক্তক্ষরণী। এখন সেই মহাকাব্যের নতুন অধ্যায়: ‘সাদা পাথর লুণ্ঠন’।
কোম্পানিগঞ্জের ভোলাগঞ্জে প্রকৃতি যেন সাদা মার্বেলের চাদর বিছিয়ে রেখেছিল। পর্যটকরা ছবি তুলত, কবিরা কবিতা লিখত, প্রেমিক-প্রেমিকারা শপথ নিত, আর কিছু মানুষ মনে মনে হিসাব করত—’এগুলো বিক্রি করা যায় কি না।’
সমস্যা হলো, এই পাথরগুলো ছিল প্রকৃতির গর্ভে। বাঙালি প্রকৃতিকে কখনো মায়ের মতো যত্ন করেনি—বরং দজ্জালের মতো লুটেপুটে খেয়েছে। প্রভাবশালীদের একদিন মনে হলো—’পাথরগুলো তো পড়ে আছে, আমরা নেব না কেন?’
একজন সাধারণ চোর হয়তো একা এসে দু-চারটি পাথর নিয়ে চলে যেত। কিন্তু এখানে চিত্রনাট্য মহাকাব্যিক! শত শত নৌকা, দলে দলে লোক, দিন-রাত অবিরাম পাথর তোলার প্রতিযোগিতা। প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে, কারণ লুটেরাদের নেতা হয়তো এমন কেউ, যার ফোনবুকে লেখা আছে—‘উপদেষ্টা: ব্যক্তিগত বন্ধু’।
প্রশাসনের নির্লজ্জতা একজন বৃদ্ধ স্থানীয় কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার সময়ে পাথর দেখে মন শান্ত হতো, এখন পাথর দেখলে শুধু পেটে মাথা ব্যথা হয়।’ কারণ, সেসব পাথর এখন আর পাহাড়ে নেই—গিয়ে বসেছে কারও বাংলোর সিঁড়িতে, বা শপিং মলের ফ্লোরে।
প্রশাসন এতটাই সক্রিয় (!) যে ভিডিও ফুটেজ দেখেও বলে—‘এগুলো পুরানো ফুটেজ।’ মনে হয়, পাথরগুলো নিজেরাই হাঁটতে হাঁটতে কক্সবাজারে বেড়াতে গেছে। আর তদন্ত? তার গতি এত ধীর যে শেষ হতে হতে সেখানকার তলদেশে হয়তো কৃত্রিম লেক বানানো হয়ে যাবে, নাম হবে—‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংরক্ষণ প্রকল্প’।
প্রকৃতির প্রতিশোধ পাথর তুলে নেওয়ার পর নদীর পানি ঘোলা হয়ে গেছে, মাছ পালাচ্ছে, পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যেন পাথরগুলোর আত্মা বলছে—‘যারা আমাকে লুটেছে, তাদের আমি ছাড়ব না।’
একজন যুবক বলল, ‘এখন আর এখানে পাথর নেই, শুধু গর্ত আর গর্ত। মনে হয় কেউ এখানে মহাপ্রলয়ের জন্য গর্ত খুঁড়ছে।’
যদি আমরা এখনই সচেতন না হই, একদিন দেখা যাবে—সুন্দরবনের গাছ নেই, চট্টগ্রামের পাহাড় নেই, এমনকি যমুনা সেতুর লোহাও নেই। তখন আমরা বসে বসে গান গাইব— ‘এই দেশে আর কিছুই রইল না, শুধু লুটেরা আর গর্ত রইল...।’
লুটেরারা হয়তো গর্ব করে বলবে—‘আমরা উন্নয়নের জন্য পাথর তুলেছি!’ অথচ উন্নয়ন হবে কেবল তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে—বাংলোর সিঁড়িতে সাদা পাথর, গ্যারেজে মার্বেল টাইলস। কিন্তু প্রকৃতি তাদের শাস্তি দেবে—বাড়ির প্ল্যান ভুল হবে, গাড়ির টায়ার পাঙ্কচার হবে, সন্তানরা পরীক্ষায় ফেল করবে। কারণ, লুট করা পাথরে ভাগ্য ভালো হয় না।
ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর শুধু পাথর নয়—এটি প্রকৃতির একটি কবিতা, একটি গানের সুর, একটি প্রেমের সাক্ষী। আমরা যদি এটিকে হারাই, তাহলে হারাবো কেবল একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়—হারাবো আমাদের বিবেকের শেষ চিহ্নটুকুও।
তাই এখনই সময় লুটপাটের এই মহাকাব্যে দাঁড়ি টানার। আসুন, সাদা পাথর বাঁচাই, নদী বাঁচাই, প্রকৃতিকে রক্ষা করি। আর লুটেরাদের বলে দিই— ‘পাথর ছেড়ে দাও, নইলে পাথরই হবে তোমাদের সমাধি।’
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে