ক্ষুধার্তদের হত্যা: গাজায় ত্রাণ সরবরাহ ফের স্থগিত ইসরায়েলের
ফিলিস্তিনের গাজায় ত্রাণ সরবরাহ আবারও স্থগিত করেছে ইসরায়েল। ফলে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক ঢুকতে পারছে না অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে। তাদের বিতরণ করা ত্রাণসামগ্রী হামাস সদস্যদের হাতে চলে যাচ্ছে- এমন অভিযোগে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে দাবি ইসরায়েলের গণমাধ্যমগুলোর।
তবে এর আগে ইসরায়েলি ত্রাণ আনতে যাওয়া মানুষকে কতোটা নির্মম-নির্দয় ও কোনো কারণ ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে, সেসব ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা। দেশটির সংবাদমাধ্যম হারেৎজকে তারা জানিয়েছেন, ‘অকারণেই এসব হত্যা করা হয়েছে। যারা ত্রাণ নিতে এসেছিলেন, তাদের কেউই ইসরায়েলি সেনাদের জন্য ঝুঁকির কারণ ছিলেন না’।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে এবং খোদ নিজ দেশেই সমালোচনার মুখে আপাতত ত্রাণ বিতরণ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরায়েল। তবে, শনিবার (২৮ জুন) বিবৃতিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, ত্রাণসামগ্রী যেন হামাসের হাতে না যায়, সেজন্য নতুন পরিকল্পনা করবে তারা। সেটি না হওয়া পর্যন্ত গাজায় কোনো ত্রাণ ঢুকতে দেবে না।
মার্চের শুরুতে গাজায় বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা এবং দেশের ত্রাণ প্রবেশও বন্ধ করে দিয়েছিল ইসরায়েল। ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ২৭ মে জাতিসংঘসহ প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) তৈরি করে সীমিত আকারে ত্রাণ বিতরণ করছিল দেশটি।
তবে শুরু থেকেই ব্যর্থ বিতর্কিত সংস্থাটি। জিএইচএফের বিতরণকেন্দ্রগুলোতে যখনই মানুষ খাবার নিতে গেছেন, তখনই হতাহতের শিকার হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, চার সপ্তাহে অন্তত ৫৪৯ জন বেসামরিক ফিলিস্তিনি ত্রাণ ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও চার হাজার ৬৬ জন।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিতর্কিত এই সংস্থার ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলো ফিলিস্তিনিদের জন্য তাই মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসরায়েলি এক সেনা শুক্রবার (২৭ জুন) বলেছেন, ‘এটি হলো হত্যাযজ্ঞের মাঠ। আমি যেখানে মোতায়েন ছিলাম, সেখানে প্রতিদিন অন্তত এক থেকে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছে। গাজার এসব মানুষকে শত্রুবাহিনী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তাদের সরাতে ভিড় ব্যবস্থাপনার কোনো কিছু ব্যবহার করা হয়নি, কোনো কাঁদানে গ্যাসও ব্যবহার করা হয়নি। সরাসরি গুলি করা হয়েছে। ভারী মেশিন গান, গ্রেনেড লঞ্চার, কামান থেকে গোলা ছোড়া হয়েছে’।
হারেৎজকে তিনি বলেন, ‘যখন আমরা গুলি বন্ধ করতাম, তখন মানুষ বুঝতেন, এখন তারা ত্রাণকেন্দ্রের দিকে আগাতে পারবেন। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল গুলি’।
তিনি বলেন, ‘ভোরের দিকে যদি কেউ ত্রাণকেন্দ্রের লাইনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন, যা আমাদের অবস্থান থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরে, আবার কিছু ক্ষেত্রে আমরা কাছ থেকে গুলি করতাম। কিন্তু আমাদের সেনাদের জন্য তারা কেউই ঝুঁকির কারণ ছিলেন না। আমি এখন পর্যন্ত শুনিনি, যারা ত্রাণ নিতে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ গুলি ছুড়েছে। সেখানে কোনো শত্রু ছিল না। কোনো অস্ত্র ছিল না’।
অন্য এক সেনা বলেন, ‘ক্ষুধার্ত মানুষকে দূরে রাখতে কামান থেকে গোলা ছোড়া কোনো পেশাদারিত্ব নয়, মানবিক কাজও নয়। আমি জানি হামাসের কিছু যোদ্ধাও (ত্রাণকেন্দ্রের কাছে) সেখানে ছিলেন। কিন্তু সেখানে এমন মানুষ ছিলেন, যারা শুধুমাত্র ত্রাণই নিতে এসেছিলেন’।
তিনি বলেন, ‘এটি এমন জায়গায় পরিণত হয়েছে, যেখানে নিজস্ব আইন চলে। মানুষের মৃত্যু সেখানে কিছুই না। এমনকি কোনো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হিসেবেও এসব হত্যাকে উল্লেখ করা হয় না’।
এদিকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সঙ্গে এসব ঘটনা নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তারা এগুলো অস্বীকার করেনি, আবার স্বীকারও করেনি।
তবে ইসরায়েলি সেনাদের স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থা মিলিটারি অ্যাডভোকেট জেনারেল অফিস জানিয়েছে, ত্রাণকেন্দ্রে আসা নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে ইসরায়েলি সেনারা যে যুদ্ধাপরাধ করেছে, সেগুলোর তদন্ত তারা করবে।
অন্যদিকে এতো সমালোচনার পরও ত্রাণ সংস্থা জিএইচএফকে সরাসরি ৩০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা অনুমোদন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র টমি পিগট বলেন, ‘জিএইচএফের গুরুত্বপূর্ণ কাজকে সমর্থন দিতে আমরা অন্যান্য দেশগুলোকেও আহ্বান জানাই’। সংস্থাটির কার্যক্রমের সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, সংস্থাটি এখন পর্যন্ত চার কোটি ৬০ লাখ খাবার বিতরণ করেছে, যা অবিশ্বাস্য ও প্রশংসার দাবি রাখে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন এবং জিএইচএফের এই উদ্যোগ তাদেরই সেই লক্ষ্য পূরণের অংশ’।
তবে জাতিসংঘ ও শীর্ষ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সংস্থাটির ত্রাণ বিতরণ বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছে ডক্টরস উইথআউট বর্ডারসও।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে জানিয়েছে, শেষ ২৪ ঘণ্টার হতাহতসহ ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৩৩১ জনে এবং আহত হয়েছেন এক লাখ ৩২ হাজার ৬৩২ জন বেসামরিক ফিলিস্তিনি। ধ্বংসস্তূপের নিচে ও রাস্তায় আটকে আছেন আরও বহু মানুষ। উদ্ধারকর্মীরা সেখানে পৌঁছাতে পারছেন না।
গাজার মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনারা উত্তর গাজা অঞ্চলের এক হাজারেরও বেশি বাড়িঘর পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস করেছে। পাশাপাশি, ওই এলাকার তিন লাখেরও বেশি বাসিন্দাকে গাজা সিটির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে, যেখানে তাদের আশ্রয় দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামোই নেই।
জাতিসংঘেরও মতে, দখলদার ইসরায়েলের নির্বিচার আক্রমণে গাজার প্রায় ৯০ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে অধিকাংশ অবকাঠামো।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে