Views Bangladesh Logo

ছোটগল্প

খলিল দারোগার হাঁচি

Anif  Rubed

আনিফ রুবেদ

‘হাঁচির সঙ্গে ভুল করে প্রাণ বেরিয়ে গেছে খলিল দারোগার বা হাঁচির সঙ্গে খলিল দারোগা ভুল করে জীবাণু বের করার পরিবর্তে জীবন বের করে দিয়েছে’- এ কথা বা এ ধরনের কথা খলিল দারোগার অফিসের এক কনস্টেবলের মুখ থেকে প্রথম বেরোয়।

কনস্টেবলের মুখ থেকে বেরুনো কথা সঙ্গে সঙ্গে আর সব মানুষের কানে কানে ঢুকে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও চোখ আর মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে অন্য আরও মানুষের কান দিয়ে ঢুকে চোখ দিয়ে বের হচ্ছিল। যখন চোখ দিয়ে বের হচ্ছিল তখন চোখগুলো মানুষের একটু বিস্ফারিত হচ্ছিল। এ থেকেই বোঝা গেল শ্রাবিত কথার অর্ধাংশ লোকটির চোখ দিয়ে বের হলো এবং মুখ দিয়ে যখন প্রায়-শব্দ বের হলো ‘ও’ তখন বোঝা গেল কথার বাকি অর্ধাংশ মুখ দিয়ে বের হয়ে এলো।

‘হাঁচির সঙ্গে ভুল করে প্রাণ বের করে দিয়েছে খলিল দারোগা।’ এই কথাটি বা এ রকম কথাটি মানুষের কান দিয়ে ঢুকে দুভাগ হয়ে শ্রাবিত মানুষের চোখ আর মুখ দিয়ে দুভাগ বের হয়ে গেলে বাতাসের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কথাগুলোকে জোড় দিয়ে দিয়ে বাতাসকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছিল। খলিল দারোগা নিজের ব্যাপারে ভুল করার লোক না, তারপরও হাঁচি দিতে গিয়ে হাঁচির সঙ্গে প্রাণটাকেই বের করে দিবে এমন কথা শুনে সবাই আশ্চর্য হয়। আশ্চর্যগুলো জমা হয়ে আশ্চর্যের পাহাড় হচ্ছিল।

আমি যখন কথাটা শুনি তখন আমি হলদার পাড়ার যে প্রৌঢ়া মহিলা রণার দোকানের সামনে প্রতিদিন কলা বেচে তার থেকে কলা কেনার জন্য গেছিলাম আর পূর্বের লোকটির কলা কেনা শেষ হলে আমি কলাওয়ালির দিকে আর তার কলার দিকে তাকানোর সময় খেয়াল করি, সে নিচ দিকে অর্থাৎ কলার ডালির দিকে তাকিয়ে কলাতে উপরোক্ত কথা অর্থাৎ ‘হাঁচির সঙ্গে ভুল করে খলিল দারোগা জীবন বের করে দিয়েছে।’ এই কথাটি বা এ রকম কথা সমস্ত কলার গায়ে লাগাচ্ছে। এমন কি আমার সঙ্গে কলার দরদাম করা এবং কলা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দেবার সময়ও তাই করছিল।

সে কী কথা কলার গায়ে লাগাচ্ছে, তা বুঝতে পারছিলাম না তাই কলাওয়ালিকে বললাম- ‘এভাবে কলার গায়ে কথা না লাগিয়ে আমাকে বলত বাপু, ব্যাপারটা কি?’
তখন প্রৌঢ়া চমকে আমার দিকে তাকায়। সে যে কলার গায়ে কথা লাগাচ্ছে সেটা যে আমি দেখে ফেলেছি বা বুঝে ফেলেছি তা সে বুঝতে পারেনি। সে মনে করেছিল, বিষয়টা আমি বুঝতে পারছি না; কিন্তু যখন বুঝতে পারল তখনই সে চমকে উঠল। আমার ঐ কথা বলা আর তার ফলে তার চমকানোর সময়, একটা মুহূর্তের দৃশ্য এমন হলোÑ আমার ব্যাগটা হা হয়ে আছে কলা ভেতরে নেবার জন্য, কলাসহ তার হাতটি স্থির হয়ে আছে হা হওয়া ব্যাগের ঠিক হায়ের ওপর আর আমার কথা শুনে তার মুখ হা হয়ে গেছে আর সে হা মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ব্যাগের হা আর তার মুখের হা আর মাঝখানে কলার ছড়িসহ তার স্থির হাত।

এমন মুহূর্তটি শেষ হলে সে নড়ে চড়ে ওঠে, কলার গা হতে তার মাখানো কথাটি উঠিয়ে নেয় আর আমাকে বলে- ‘শুনলাম হাঁচির সঙ্গে খলিল দারোগা ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে, খলিল দারোগার খোসা পড়ে আছে থানার যে ঘরে সে বসে সে ঘরে।’
কথাটি আমার কান দিয়ে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গে দুভাগ হয়ে চোখ আর মুখ দিয়ে বের হয়ে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু আমি তা হতে দিই না।

বাড়ি ফিরে যাই আর আমার স্ত্রীর হাতে বাজারের ব্যাগটি দিই। আমার বউয়ের হাতটি চুরি করে ছুঁয়ে দিই যাতে মনে হতে পারে, আমি ছুঁয়ে দিয়েছি অনিচ্ছাকৃতভাবে। নতুন প্রেমিক তার প্রেমিকার হাত বা শরীরের যে কোনো অংশ এভাবে ছুঁয়ে দেয়। আমার বউ চমকে যায় এই জাতীয় ছোঁয়াতে এবং আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। আমি তার হাতটা ছুঁয়েছিলাম প্রেমিক হবার জন্য নয়, হয়তো আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমি বেঁচে আছি।

পড়ার ঘর থেকে আমাদের বড় ছেলে টেন পড়ুয়া বাসেদুর বেরিয়ে আসে আর তার মায়ের হাতের ব্যাগ থেকে কলার ছড়ি থেকে একটা কলা ছিঁড়ে নিয়ে ছুলে ফেলে এবং একটা কামড় দিয়ে গিলে ফেলার সময় কথা বলে উঠে। কলা তার ভেতরে ঢুকছে আর একটা কথা তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। কলা ঢোকার আর কথা বের হবার পথ একটায়। দাঁত আর জিহ্বা-তালুর চাপে গলিত কলা আর বেরিয়ে আসা কথার মধ্যে দেখা হয় বা ধাক্কাধাক্কি হয় বা কলা আর কথার মধ্যে কিছু আলাপ হয় বা পথ দেয়া-দেয়ি নিয়ে বচসা হয় বলে বাসেদুরের কথা আমি বুঝতে পারি না।

আমি তাকে বলি- ‘কলা আগে গিলে নে, তারপর কথা বল; কী বলছিস?’
সুতরাং গলার মাঝপথে কলা জয়ী হয় এবং সে প্রবেশ করে আগে আর কথাটি এবার বেরিয়ে আসে পরে- ‘বাবা, খলিল দারোগা হাঁচি দিতে গিয়ে ভুল করে নাকি জীবন দিয়ে দিয়েছে?’
ছেলের মুখ থেকে কথাটি বেরিয়ে এলে আমি আশ্চর্য হই এবং সন্দেহ হয় কলাওয়ালি কলার গা থেকে তার মাখানো কথা ভালো করে ছাড়িয়ে নেয়নি বা সব কলা থেকে ছাড়িয়ে নেয়নি। আমার রাগ হয় তার ওপর। কলা মুখে দেবার সঙ্গে সঙ্গে খলিল দারোগার কথাটি ছেলের ভেতর ক্রিয়া করে উঠেছে। আমি আবার বেরিয়ে যাই বাড়ি থেকে বাজারের উদ্দেশ্যে কলাওয়ালিকে ধরার জন্য; দুটো কথা শোনানোর জন্য।

পথে দেখা হয় জামকুটি গ্রামের সোলেমানের সঙ্গে। সে একটা রেডিও বাজাতে বাজাতে বাজার থেকে ফিরছিল। তার রেডিওটা একটা হিন্দি গান বলছিল আর সোলেমানের মনসহ মাথা ছোট ছোট করে তাল নিচ্ছিল।

দেখা হতেই সে আমাকে বলে- ‘দাদা গো, ছবির গানের মজাই আলাদা গো দাদা।’
আমি বলি- ‘বাদ দাও এসব, একটা কথা আছে, তুমি রেডিওটা বন্ধ করে দাও।’
সে বলে- ‘দাদা, এখন গান গাইছে যে ভদ্রলোক তিনি মস্ত মাপের শিল্পী। রেডিও বন্ধ করলে সে কীভাবে গান করবে আর রেডিও বন্ধ করে যদি তোমার কথা শুনি তবে গান গাইবার জন্য আবার এতক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হবে। বা সেই মস্তমাপের শিল্পীটা অপমানিত বোধ করবে। অবশ্য তারা বড়মনের মানুষ, অপমানিত বোধ করবেন না। না, করলেও আমার তো একটা হুঁশ আছে, এত বড়মাপের মানুষের গান থামিয়ে দেব মুখের ওপর, এটা একটা বেয়াদবি হবে। দেখছেন না, কেমন করে মরে যাবার পরেও সুন্দর গান গাইছে, মানুষকে আনন্দ দিচ্ছে। মানুষ আনন্দ পাচ্ছে।’

আমি তার রেডিওর গানের দিকে মনোযোগ দিই। রেডিওতে শচীন দেব বর্মন গান করছেন। সত্যিই তো, শচীন কর্তা বড়মাপের মানুষ। তিনি গান গাইছেন। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়া বড়ই বেয়াদবির মতো হবে। আমি তার পথ ছেড়ে দিলে শচীন কর্তা গান গাইতে এগুতে লাগল আর পূর্বের মতো সোলেমন মাথা দোলাতে লাগল।

আমি আবার হাঁটতে লাগলাম বাজারের দিকে। আমার উদ্দেশ্য তেমন কিছু না। কলাওয়ালিকে বলা যে, সে কেন কলার গায়ে ‘খলিল দারোগার প্রাণ তার হাঁচির সঙ্গে বেরিয়ে গেছে’ কথাটা লাগিয়ে দিয়েছে। আমার চলার গতি ধীর কারণ জোরে হাঁটতে গেলে পায়ের হাঁটুর কাছটায় আর নিচটায় বেশ ব্যথা হয়; কিন্তু আমার মনে চলার গতি বেশ জোরে। প্রথম যখন খলিল দারোগা সম্পর্কিত এ বাক্যটা আমি শুনি তখন কিন্তু অন্যকিছু শুনেছিলাম। কারণ, আমার কানেরও বেশ সমস্যা আছে। কোনো কোনো কথা অল্পতে শুনতে পাই না। আমি শুনেছিলাম- ‘খলিল দারোগার হাসির সঙ্গে প্রাণ বেরিয়ে গেছে।’

খলিল দারোগার হাসি সত্যিই ছিল খুব ভয়ংকর টাইপের। তার হাসির শব্দে অনেক নিরীহ মানুষের পিলে ফেটে প্রাণ বেরিয়ে গেছে। তার হাসির ভয়ংকর ঝংকার আমি দেখেছি; কিন্তু সত্যিকার ভয়ংকর লোকের সামনে তার হাসি কোনো কাজ দিত না, উল্টো তার বাঘহাসি বিলাইহাসিও নয়, ইঁদুরহাসিতে পরিণত হতো। এমপির খাসগুণ্ডার হাসি শুনে খলিল দারোগা পোশাক নষ্ট করে ফেলেছিল থানার মধ্যেই একদিন।

একদিন আমি দোকানের হিসাব-নিকাশ সেরে সাইকেল নিয়ে ফিরছিলাম। রাত একটু বেশিই হয়ে গেছিল।
খলিল দারোগা থামাল পথে- ‘এই এত রাতে কোথায়, কি, কেন?’
আমি বলেছিলাম- ‘আমি একটা দোকানে সেলসের কাজ করি, হিসাব সেরে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।’
শুনল না কিছু। ধরে নিয়ে গেল। কানের ওপর থাপ্পড় মারল কষে। কান আমার ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। থানায় নিয়ে মারল। তখন থেকেই হাঁটুর ব্যথাটা, তখন থেকেই কানে কম শোনাটা।

পরদিন ভোরে আমার দোকানের মালিক আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে না গেলে অবস্থা কি হতো কে জানে। সুতরাং আমি ভেবেছিলাম খলিল দারোগার প্রাণ বুঝি তার হাসির সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। প্রথম যেদিন তার হাসি শুনেছিলাম সেদিন ভেবেছিলাম, তার হাসি এতটাই ভয়ংকর যে, যদি খলিল দারোগা নিজেই নিরীহ মনে কোনো একবার শুনে ফেলে তার নিজের হাসি তাহলে নিশ্চিত পিলে ফেটে মারা যাবে।

যা হোক, পরে যার কাছে শুনেছিলাম সে দ্বিতীয়বার জোরের স্বরে বলেছিল- ‘হাসির সঙ্গে নয়, হাঁচির সঙ্গে খলিল দারোগার প্রাণ বেরিয়ে গেছে।’

কলাওয়ালির কাছে পৌঁছে গিয়ে বললাম- ‘তুমি কলার সঙ্গে খলিল দারোগার সংবাদ কেন লাগিয়ে দিয়েছিলে, আমার ছেলে কলা গিলতে গিয়ে মারা যেতে বসেছিল।’
কলাওয়ালি বলল- ‘বাবু কিছু মনে নেবেন না, আপনার ওপর খলিল দারোগা যে অত্যাচার করেছিল তা আমি ভুলতে পারিনি। সে অনেক নিরীহ লোকের ব্যাপারেই এমনটা ছিল। আমি তাদের কলাতেই শুধু কথাটা লাগিয়ে দিয়েছি যারা খলিল দারোগার হাতে অহেতুক লাঞ্ছিত হয়েছে। যাতে করে সকলে তার হাঁচি অপঘাতে মৃত্যু শুনে প্রীত হতে পারে।’
আমি কিছু আর না বলে আবার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরি।

খলিল দারোগা মারা যাবার চল্লিশ দিন পর তার স্ত্রী সন্তানেরা পিকনিকের জন্য মুক্ত, সুন্দর কোনো জায়গাতে বেরিয়ে পড়ে। এ কথাটাও ঐ কলাওয়ালি আমার কলার গায়ে লাগিয়ে দিয়েছিল।

আনিফ রুবেদ: কবি ও কথাশিল্পী।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ