খালেদা জিয়ার প্রস্থান: বিএনপি ও বাংলাদেশের সামনে নতুন বাস্তবতা
গৃহবধূ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির আপোসহীন নেত্রী হয়ে ওঠা বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে দেশের রাজনীতির এক বিশাল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো। আজ ৩০ ডিসেম্বর সকালে তাঁর মৃত্যুর খবরে শুধু একটি দলের নয়, বরং বাংলাদেশের দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস এক গভীর শূন্যতায় নিমজ্জিত হলো। যিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেও বারবার ক্ষমতার বাইরে থেকেছেন, যিনি আপোসহীন অবস্থানের জন্য যেমন প্রশংসিত হয়েছেন এবং সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন—তাঁর প্রস্থান মানেই একটি সময়ের অবসান।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান ছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত, প্রায় আকস্মিক। রাজনীতির কোনো সক্রিয় প্রস্তুতি বা পূর্বপরিকল্পিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি রাজনীতিতে আসেননি। বরং তিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ, সেনা কর্মকর্তা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, যিনি পরিবারের পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং দলীয় প্রয়োজনে খালেদা জিয়াকে সামনে আসতে হয়।
সেই সামনে আসা ছিলো প্রথমে অনিশ্চিত, দ্বিধাগ্রস্ত এবং অনেকের চোখে সাময়িক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে শুধু একজন উত্তরাধিকারী নন, বরং একজন স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
সামরিক শাসনের দীর্ঘ ছায়া কাটিয়ে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ যখন আবার গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরে, তখন সেই ঐতিহাসিক যাত্রার নেতৃত্বে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ শুধু নারী নেতৃত্বের দৃষ্টান্তই নয়, বরং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়। সংসদীয় গণতন্ত্র পুনর্বহাল, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের ভূমিকা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।
তবে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন কখনোই মসৃণ ছিলো না। তাঁর পুরো রাজনৈতিক যাত্রা ছিলো দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ণ। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বৈরিতা বাংলাদেশের রাজনীতিকে স্থায়ীভাবে দুই মেরুতে বিভক্ত করে দেয়। এই দ্বন্দ্ব ব্যক্তিগত পর্যায় ছাড়িয়ে নীতি, আদর্শ, রাষ্ট্র পরিচালনা ও ইতিহাস ব্যাখ্যার ভিন্নতায় রূপ নেয়। ‘বেগমদের রাজনীতি’ নামে পরিচিত এই অধ্যায় দেশের গণতন্ত্রকে যেমন সচল রেখেছে, তেমনি বহু সময় তাকে স্থবিরও করেছে।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো তাঁর আপোসহীনতা। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হলে নেতৃত্বও দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দৃঢ়তা তাঁকে জনপ্রিয় করেছে। নির্বাচন বর্জন, আন্দোলনকেন্দ্রিক রাজনীতি, রাজপথের চাপ—এসব কৌশল তাঁর রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো। কেউ একে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই বলেছেন, কেউ আবার একে অনমনীয় রাজনীতির উদাহরণ হিসেবে দেখেছেন।
২০০১ সালে তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে তিনি একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করেন। সে সময় অর্থনীতি, অবকাঠামো ও সামাজিক খাতে অগ্রগতি হয় অনেক। এরপর সময়ের চাকা ঘুরে যায়। ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পর শুরু হয় দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রতিকূলতা, মামলা, কারাবাস ও অসুস্থতার অধ্যায়। রাজনীতির কেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে তিনি সরে যেতে বাধ্য হন, কিন্তু প্রতীকী নেতৃত্ব হিসেবে দলের ভেতরে ও বাইরে তাঁর উপস্থিতি অটুট থাকে।
কারাবাস ও শারীরিক অসুস্থতা খালেদা জিয়াকে ক্রমে জনসম্মুখ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। রাজনীতি তখন তাঁর কণ্ঠে নয়, বরং তাঁর নামেই পরিচালিত হতে থাকে। এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও বিএনপির জনপ্রিয় তিলমাত্র কমেনি। বরং তাঁর প্রতি দলের নেতাকর্মীদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত ছিলো। অসুস্থ শরীর, নিঃশব্দ উপস্থিতি আর দীর্ঘ নীরবতার মধ্যেও তিনি ছিলেন রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা—যা বিরল।
আজ তাঁর মৃত্যু সেই দীর্ঘ সংগ্রামের অবসান টানলো। এটি শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবনাবসান নয়; এটি একটি রাজনৈতিক ধারার, একটি চিন্তাধারার এবং একটি সময়ের সমাপ্তি। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিএনপি এক অভিভাবকহীন অধ্যায়ে প্রবেশ করলো আর বাংলাদেশ হারালো এমন এক নেতা, যিনি নিজেই একটি ইতিহাস।
ইতিহাস বেগম খালেদা জিয়াকে বিচার করবে বহু দৃষ্টিকোণ থেকে। কেউ তাঁকে দেখবেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নেত্রী হিসেবে, কেউ দেখবেন রাজনৈতিক অনড়তার প্রতীক হিসেবে। তাঁর শাসনামলে নেওয়া সিদ্ধান্ত, ভুল ও সাফল্য—সবই ইতিহাসের পাতায় থাকবে বিশ্লেষণের জন্য। কিন্তু একটি সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই—তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন, রাজনীতির ভাষা ও কাঠামোকে বদলে দিয়েছেন।
একজন নারী হিসেবে পুরুষপ্রধান রাজনৈতিক বাস্তবতায় টিকে থাকা, বারবার ক্ষমতার কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যে দোলাচলে থাকা এবং শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া—খালেদা জিয়ার জীবন সেই জটিল বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। তাঁর বিদায়ে প্রশ্ন থেকে যায়—এই শূন্যতা কি নতুন রাজনীতির জন্ম দেবে, নাকি পুরোনো দ্বন্দ্বেরই নতুন রূপ আমরা দেখবো?
বেগম খালেদা জিয়া চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন এক দীর্ঘ, সংগ্রামী ও অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক অধ্যায়। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুধু একটি নাম নয়, একটি যুগের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে