বন্দরে পণ্য পরিবহন খরচ সহনশীল রাখুন
আমাদের দুটি সমুদ্র বন্দর থাকলেও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে মূলত চট্টগ্রাম বন্দরই বেশি ব্যবহৃত হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ সমুদ্র বন্দর নিয়ে অনেক আশার বাণী শুনিয়েছিলেন। কিছুটা আশার আলো আমরা দেখতেও পাচ্ছিলাম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কনটেইনার পরিবহনে নতুন রেকর্ড গড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। এ সময় প্রায় ৩২ লাখ ৯৬ হাজার টিইইউস কনটেইনার পরিবহন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পুরো সময়ে ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউস কনটেইনার পরিবাহিত হয় বন্দর দিয়ে।
২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৩২ লাখ ৫৫ হাজার টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে এ বন্দর। ৫ আগস্ট-পরবর্তী ডলার-সংকট কাটিয়ে আমদানিও স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে নতুন রেকর্ড সম্ভব হয়েছে বলে দাবি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের; কিন্তু সাম্প্রতিক একটা খবর চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ-এর মুখোমুখি করে দেবে বলে মনে হচ্ছে। গতকাল বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেল, বন্দরে পণ্য পরিবহন খরচ হঠাৎ দ্বিগুণ বেড়েছে। এ ধরনের হঠাৎ খরচ বৃদ্ধি কেবল ব্যবসায়ীদের জন্যই নয়, সাধারণ ভোক্তাদের জন্যও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের মতো একটি উত্পাদন ও রফতানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এটি অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। রপ্তানি খাতের কাঁচামাল কনটেইনারে আমদানির সময় বাড়তি মাশুল দিতে হবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে। একই পণ্য রপ্তানিতে আরেক দফা মাশুল গুনতে হবে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি)। দুইয়ে মিলে বাড়তি মাশুল দাঁড়াবে প্রায় ৯১ শতাংশ! বন্দরে পণ্য পরিবহনের খরচ বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন খরচ কমাতে চাপে পড়বে। ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো ইতিমধ্যেই সীমিত পুঁজিতে পরিচালিত হচ্ছে, আর এই অতিরিক্ত খরচ তাদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি করবে। ফলে পণ্যের মূল্য বাড়াতে বাধ্য হবেন ব্যবসায়ীরা।
স্বাভাবিকভাবেই এটা সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সেইসঙ্গে রপ্তানি খাতেও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ক্রেতারা অন্য উৎস খুঁজতে শুরু করবে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে ৪১ শতাংশ খরচ বেড়েছে ব্যবসায়ীদের। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কনটেইনার পরিবহনের মাশুল। অথচ সমুদ্রপথে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় পুরোটাই হয় কনটেইনারে।
আবার শিল্পের কাঁচামাল ও মূল্যবান যন্ত্রপাতিও আমদানি হয় কনটেইনারে। ফলে কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে মাশুল বাড়ানোর প্রভাব বেশি পড়বে বলে জানান ব্যবহারকারীরা। এতদিন ২০ ফুট লম্বা একটি কনটেইনারে গড়ে মাশুল ছিল ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। এখন দিতে হবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। নতুন প্রজ্ঞাপনে মাশুলের ক্ষেত্রে ডলারপ্রতি বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছে ১২২ টাকা। প্রতি একক কনটেইনার জাহাজ থেকে ওঠানো বা নামানোর জন্য আগে মাশুল ছিল ৫ হাজার ২৯৪ টাকা। এখন তা বাড়িয়ে ৮ হাজার ২৯৬ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া সব ধরনের সাধারণ পণ্যে কেজিপ্রতি মাশুল বাড়বে গড়ে ১৪ পয়সা।
হঠাৎ দ্বিগুণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়িরা হতাশ হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, এতদিন যে হারে মাশুল আদায় করা হয়েছে তার বড় অংশই ১৯৮৬ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন বাড়ানো হলেও তা আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় কম। বন্দর কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, সুদের হার বৃদ্ধি, শ্রমিক মজুরি ও যন্ত্রপাতির ব্যয়বৃদ্ধি এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচের কারণে সেবা মাশুল বাড়াতে হয়েছে। তারপরও হঠাৎ দ্বিগুণ খরচ বেড়ে যাওয়া নিশ্চয়িই ব্যবসায়িদের জন্য অনেক বড় চাপ। দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যবসা ও অর্থনীতির জন্য স্থিতিশীল পরিবহন খরচ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
সরকার, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসাথে বসে এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। নইলে ছোট উদ্যোগগুলো বন্ধ হয়ে যাবে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পণ্যের খরচ বাড়ানো কোন সমাধান নয়; বরং এটি অর্থনীতির চাকা ধীরগতিতে ঘুরিয়ে দেবে। সুতরাং, হঠাৎ বন্দরে পরিবহন খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়া দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও শঙ্কাজনক। এখনই সমন্বিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আমাদের প্রত্যাশা বন্দরে পণ্য পরিবহন খরচ সমন্বয় করতে ব্যবসায়ি ও সরকারের মধ্যে বোঝাপড়া আরো স্পষ্ট থাকুক। বন্দরে পণ্য পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি সহনশীলতার পর্যায় রাখলে তা নিশ্চিতভাবেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে