Views Bangladesh Logo

জুলাই গণঅভ্যুত্থান: শহীদ ও আহত তালিকায় জালিয়াতির কুৎসিত চিত্র কেন?

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিগন্তে এক নতুন সূর্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, অবশেষে দেশ হয়তো এক সত্যিকারের পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে। বিশেষ করে তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এ আন্দোলন এক নতুন আশার সঞ্চার করেছিল, যেখানে ‘পরিবর্তন’-এর স্লোগান কেবল শব্দ ছিল না, ছিল এক সম্মিলিত স্বপ্ন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই স্বপ্নের আলো খুব দ্রুতই ফিকে হয়ে এসেছে এক গভীর অন্ধকারে। আন্দোলনের নেতৃত্বদানের দাবি করা ব্যক্তিরা একের পর এক এমন সব কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছেন, যা শুধু হতাশাজনক নয়, রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ।

দুর্নীতির অভিযোগ থেকে শুরু করে তহবিল আত্মসাতের তদন্ত, এমনকি নারী নির্যাতন, হয়রানি, মাদক ও চাঁদাবাজির মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছে একসময়ের ‘আন্দোলনের হিরো’ হিসেবে পরিচিতদের বিরুদ্ধে। তাদের মুখের বুলি বা টকশোর ভাষণ এখন আর জনতার বিশ্বাস অর্জন করতে পারছে না, কারণ পর্দার আড়ালের চরিত্রটা এখন আর গোপন নেই।

সবচেয়ে গভীর প্রশ্নটি উঠেছে জুলাই শহীদ ও আহতদের তালিকায় চরম অনিয়ম ও জালিয়াতি নিয়ে। ফাঁস হওয়া তথ্য অনুযায়ী, অনেকেই আন্দোলনে আহত না হয়েও ব্যক্তিগত দুর্ঘটনার কারণে নিজেদের নাম তালিকায় ঢুকিয়েছেন। জাল মেডিকেল রিপোর্ট তৈরি করে বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজেকে ‘আহত যোদ্ধা’ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। এমনকি শহীদের তালিকাতেও এমন নাম এসেছে, যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা পারিবারিক কলহের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তদন্তে এসব ভুয়া নাম শনাক্ত করে এরই মধ্যে বেশ কিছু গেজেট বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (MIS)-এর তালিকায় থাকা প্রায় ৭০ জনের বেশি ভুয়া শহীদ ও আহতকে চিহ্নিত করেছে ফাউন্ডেশন। কিছু ভুয়া আহত ব্যক্তি তো অনুদান নিয়েই গা ঢাকা দিয়েছেন। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে, টাকাও ফেরত এসেছে কিছু। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন স্পর্শকাতর একটি তালিকা যাচাই-বাছাই ছাড়াই এত তাড়াহুড়ো করে গেজেটভুক্ত করা হলো কেন? এই ভুলের শুরুটা কোথায়?

আরও দুঃখজনক সত্য হলো, যারা আন্দোলনের মুখ ছিলেন, ‘দেবতা’ হয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই সেই মঞ্চকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। কেউ আন্দোলনের নামে চাঁদা তুলেছেন, কেউ ‘আন্দোলনের ব্র্যান্ড ভ্যালু’ ব্যবহার করে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করেছেন, আবার কেউ নিজের ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি বাড়িয়েছেন। এককালের রোমাঞ্চকর স্লোগান এখন পরিণত হয়েছে ঠুনকো বিপ্লবের নিছক বিজ্ঞাপনে।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি হলো—এটা কি কেবল কয়েকজনের বিচ্যুতি, নাকি আমাদের জাতীয় চরিত্রের এক সামগ্রিক চিত্র? আমরা কি নেতৃত্বে আসা প্রতিটি নতুন মুখের কাছে শুধু পুরোনোদের অপকর্মের কথা শুনে হাত তালি দিই; কিন্তু নতুনদের কাজ যাচাই করি না? আমরা কি আবারও প্রতারিত হচ্ছি, নাকি নিজেরাই প্রতারিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় উৎসাহী? আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, ‘চেঞ্জ’ নামক হাইপের নিচে লুকিয়ে আছে পুরোনো ধান্দাবাজি রাজনীতিরই নতুন সংস্করণ। নতুনদের মুখে পুরোনো কথার পাণ্ডুলিপি।

জনগণ যেদিন এই ভাঙচুর, প্রতারণা আর লোক দেখানো বিপ্লবের ফাঁদ থেকে সরে এসে নেতৃত্বের হিসাব চাওয়া শুরু করবে, সেদিনই হয়তো সত্যিকার অর্থে জনগণের গণঅভ্যুত্থান শুরু হবে। তার আগে পর্যন্ত আমরা শুধু দেখব—কেউ আন্দোলনের শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে নিজের নামের ব্যানার টাঙাবে, আর কেউ আন্দোলনের আহতদের কষ্টের খতিয়ান বানিয়ে অর্থনৈতিক লাভের ‘বিজনেস মডেল’ দাঁড় করাবে। এটাই যদি হয় গণঅভ্যুত্থানের উত্তরাধিকার, তবে প্রশ্ন করতেই হবে—আমরা কি সত্যিই স্বাধীনতার পথিক, নাকি প্রতারণার চক্রে আবদ্ধ জাতি?

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের চিঠি অনুযায়ী, আহত ও শহীদদের সরকারি তালিকায় যেভাবে ভুয়া নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এই আন্দোলনের প্রকৃত নায়কদের প্রতি এক গভীর অবমাননা। এমন একটি সংবেদনশীল প্রক্রিয়ায়, যেখানে একজন মানুষকে 'শহীদ' ঘোষণা করা হয়, সেখানে ভুল তথ্য, জাল কাগজপত্র এবং রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমে ভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিল করার প্রবণতা পুরো আন্দোলনকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে একাধিক ব্যর্থতা এবং অবহেলার সমন্বয়ে। প্রথমত, সরকারিভাবে তালিকা তৈরির দায়িত্ব ছিল জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন অফিস এবং গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেলের। অথচ তাদের পক্ষ থেকে যথাযথ যাচাই-বাছাই না করেই অসংখ্য আবেদনপত্র এমআইএসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারও কারও দাবি, আন্দোলনে অংশগ্রহণের কোনো প্রমাণ নেই, কেউ ব্যক্তিগত দুর্ঘটনায় আহত হয়েও নিজেদের জুলাই যোদ্ধা হিসেবে দাবি করেছেন, আবার কেউ চাঁদাবাজি, পারিবারিক কলহ বা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েও 'শহীদ' হিসেবে তালিকায় জায়গা পেয়েছেন—এমন উদাহরণগুলো নৈতিকতার পাটাতনটাই ভেঙে দিয়েছে। ইলিয়াস হোসেন হিরণ বা মো. লিটনের মতো ব্যক্তিরা জাল মেডিকেল কাগজপত্র ব্যবহার করে সরকারি অর্থসহায়তা গ্রহণ করেছেন।

এমনকি আন্দোলন দমনে গিয়ে পাল্টা আঘাতে আহত হয়েছেন এমন ব্যক্তিরাও আহতদের তালিকায় নাম তুলেছেন—যা নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে লজ্জাজনক। নোয়াখালীর ইমতিয়াজ হোসেন, যিনি থানা লুট করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত নিজের গুলিতে নিহত হন, অথবা ডেমরার আবু সাইদ, যিনি চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে মারা যান, এমনকি বিজয়, যিনি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান, এবং আল আমিন, যিনি জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে গুলিতে নিহত হন – এরা সকলেই জুলাই অভ্যুত্থানের ‘শহীদ’ হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়েছেন!

সরকারি গেজেট পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এসব ভুয়া নাম, যা প্রক্রিয়ার গভীর দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তোলে। শহীদের নামের পাশে এমন কারও নাম থাকা, যার মৃত্যু আন্দোলনের সঙ্গে একবিন্দু সম্পর্কিত নয়, তা শুধু ইতিহাসের বিকৃতি নয়, বরং শহীদ পরিবারের জন্য এক প্রকার অপমান। যারা সত্যিকার অর্থে জীবন দিয়েছেন, যারা পঙ্গু হয়েছেন, তারা আজ তাদের নামের পাশে থাকা একাধিক প্রতারকের কারণে বিচারহীনতার যন্ত্রণা ভোগ করছেন। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তরফে এখন কিছু ক্ষতিপূরণমূলক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে—যাচাই-বাছাই, নাম বাতিল, মুচলেকা আদায় ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ। তবে প্রশ্ন হলো, এত দিন কোথায় ছিল এই সতর্কতা? কেন শুরুতেই একটি নিরপেক্ষ যাচাই প্রক্রিয়া গঠিত হয়নি? কেন একাধিক স্তরের সত্যতা যাচাই ছাড়াই অর্থ সাহায্য প্রদান করা হলো? দ্রুত আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার চাপের দোহাই দিয়ে ফাউন্ডেশন যেমন দায় এড়াতে পারে না, তেমনি সরকারি ব্যবস্থাপনাও এ বিষয়ে দায়মুক্ত নয়।

এই জালিয়াতি শুধু অর্থ আত্মসাতের সমস্যা নয়, এটি এক ধরনের জাতীয় আত্মবিরোধ। এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে। এর প্রতিকার করতে হলে প্রথমেই দরকার একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী যাচাই-বাছাই কমিটি, যারা স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত শহীদ ও আহতদের আলাদা করে শনাক্ত করবে। সেইসঙ্গে ফৌজদারি আইনের আওতায় এনে ভুয়া দাবিদারদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এও বিবেচনায় রাখা জরুরি যে, এই ঘটনার দায় ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়—এটি একটি প্রশাসনিক এবং নীতিগত ব্যর্থতা। আন্দোলনের রাজনীতি, স্মৃতি এবং ইতিহাস যখন রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতায় বিকৃত হয়, তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে সেই আন্দোলনের মর্যাদা হারিয়ে যায়।

অতএব, সময় এসেছে এই প্রতারণার চক্র ভেঙে ফেলার। শহীদ এবং আহতদের স্মৃতিকে যথাযথ মর্যাদায় রক্ষা করতে হলে শুধু কথার বুলি নয়, চাই কার্যকর পদক্ষেপ—যাতে ইতিহাস বিকৃতি না হয়, এবং যারা প্রকৃত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত হয়। অন্যথায়, জুলাই আন্দোলন একটি জাতীয় প্রতারণার অধ্যায়ে পরিণত হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এই ভয়াবহ প্রতারণা শুধু সরকারের অর্থ অপচয় করছে না, বরং প্রকৃত শহীদ ও আহতদের প্রতি চরম অন্যায় করছে এবং আন্দোলনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য অবিলম্বে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমেই জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রস্তাবিত 'ফ্রড ডিটেক্টিং টিম' গঠন করে প্রতিটি নাম ও আবেদনপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করা জরুরি। সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে একটি কঠোর ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।

যারা মিথ্যা তথ্য ও জালিয়াতির মাধ্যমে সুবিধা গ্রহণ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে না দিয়ে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই ধরনের অপকর্ম করার সাহস না পায়। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় যাদের অবহেলা বা গাফিলতি প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে এবং এমন কোনো অসংগতি নজরে এলে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জানানোর জন্য উৎসাহিত করতে হবে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের প্রতি আমাদের সম্মান ও কৃতজ্ঞতা চিরন্তন। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আজকের পরিবর্তন। এই আন্দোলনকে ঘিরে সংঘটিত প্রতারণা দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জন্য লজ্জাজনক। এই কলঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে এবং প্রকৃত শহীদ ও আহতদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকারকে অবিলম্বে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত চেতনা সমুন্নত থাকবে এবং শহীদদের আত্মত্যাগ পাবে যথার্থ সম্মান।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ