Views Bangladesh Logo

ট্রাম্প কি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছে?

শি জিনপিং, নরেন্দ্র মোদি এবং ভ্লাদিমির পুতিন- তিনজনই তাদের নিজ নিজ ভূরাজনৈতিক পরিসরে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র নেতাদের একজন। যখন এই তিন নেতা একই টেবিলে বসে বৈঠক করেন, তখন শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক কূটনীতিতেও তার প্রতিফলন ঘটে। ট্রাম্পের শুল্কনীতি এবং বাণিজ্যিক সুরক্ষাবাদী অবস্থান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে ধরনের বৈশ্বিক অস্থিরতা তৈরি করেছে, তার প্রেক্ষাপটে এই বৈঠক নতুন মেরূকরণের ইঙ্গিত বহন করে কি না, সেই প্রশ্ন এখন আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত প্রভাব বলয়ে থাকা এই নেতাদের সমন্বিত অবস্থান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য, রাজনৈতিক কূটনীতি এবং নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি ক্রমেই সুরক্ষাবাদী হয়ে ওঠে। বিশেষত চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের কড়া শুল্কনীতি শুধু অর্থনৈতিক চাপই তৈরি করেনি, বরং রাজনৈতিক বার্তাও দিয়েছে যে আমেরিকা তার আধিপত্য রক্ষার জন্য নিয়মভিত্তিক বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা থেকে সরে আসতে প্রস্তুত। একদিকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান, অন্যদিকে একতরফা নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্যযুদ্ধ- এগুলো বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রকে আর ‘আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরে না, বরং ‘অস্থির অংশীদার’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। শি, মোদি ও পুতিন যখন একত্রিত হন, তখন তাদের সামনে যে মূল ইস্যুটি থাকে তা হলো, কীভাবে এই একতরফা চাপের মোকাবিলা করা যায়।

চীনের জন্য এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মার্কিন শুল্কযুদ্ধ সরাসরি বেইজিংয়ের রপ্তানি বাজারকে আঘাত করেছে এবং প্রযুক্তি খাতে অগ্রগতিকে ধীর করার চেষ্টা করছে। ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তি, ওষুধ এবং কৃষিপণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক তার অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগে থেকেই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে; ফলে মস্কো এমনিতেই বিকল্প মিত্র খুঁজতে বাধ্য। এ প্রেক্ষাপটে তিন দেশের মধ্যে বোঝাপড়ার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই বৈঠকের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চীন, ভারত ও রাশিয়া একত্রিত হয়ে যদি বিকল্প বাণিজ্য কাঠামো বা অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোট গড়ে তোলে, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারকেন্দ্রিক আধিপত্যের চ্যালেঞ্জ হবে। ইতোমধ্যে ব্রিকসের মতো প্ল্যাটফর্মে তারা যৌথভাবে নানা উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে ব্রিকস ব্যাংক বা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক উল্লেখযোগ্য। ট্রাম্পের শুল্কনীতি আসলে তাদের আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বৈঠকে আলোচনার অন্যতম বিষয় হতে পারে ডলারকেন্দ্রিক আর্থিক কাঠামো থেকে সরে এসে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন বাড়ানো। রাশিয়া ও চীন ইতোমধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ডলার এড়িয়ে চলার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের সঙ্গেও এ ধরনের পদক্ষেপের সম্ভাবনা জোরদার হতে পারে। এই প্রবণতা কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং ভূরাজনৈতিক শক্তি-সমীকরণের ক্ষেত্রেও এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।

রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এই বৈঠক বিশ্ব রাজনীতিতে বহু মেরূকরণের ধারাকে আরও দৃঢ় করে তুলতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মূলত দুধারায় বিভক্ত ছিল- একদিকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শিবির, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্বাধীন পূর্ব ব্লক। সোভিয়েত পতনের পর মনে হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রই এককভাবে বৈশ্বিক শাসক হয়ে উঠবে। কিন্তু নতুন সহস্রাব্দে এসে চীন তার অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে এবং রাশিয়া সামরিক ও কৌশলগত পুনরুত্থানের মাধ্যমে সেই একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ভারতের অবস্থান সবসময় কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দিল্লি বুঝতে পারছে, শুধু ওয়াশিংটনের ছত্রছায়ায় থেকে দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই ভারতও বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে। শি-মোদি-পুতিন বৈঠক সেই প্রবণতাকে আরও দৃশ্যমান করে তুলছে।

ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এ বৈঠক দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যেও প্রভাব ফেলতে পারে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাঁড়ানো এবং মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার ফলে এই অঞ্চলগুলোতে নতুন শক্তির শূন্যতা তৈরি হয়েছে। চীন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক করিডোর গড়ে তুলছে, রাশিয়া তার ঐতিহ্যগত প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট, আর ভারত এ অঞ্চলে তার নিরাপত্তা ও জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য সক্রিয়। তিন দেশ যদি সমন্বিতভাবে কাজ করে, তবে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।

নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও এ বৈঠকের আরেকটি সম্ভাব্য মাত্রা। রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী, চীন তার সামরিক শিল্পকে দ্রুত আধুনিকায়ন করছে এবং এই দুই দেশের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ভারতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তিতে নানা শর্ত আরোপ করছে, যা ভারতের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বৈঠকে যদি তিন নেতা নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে অগ্রসর হন, তবে তা শুধু অস্ত্র ব্যবসাই নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোকেও নতুন রূপ দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান, সাইবার নিরাপত্তা বা মহাকাশ প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

তবে এই বৈঠক এবং সম্ভাব্য নতুন মেরুকরণের পথে বাধাও কম নয়। ভারত-চীন সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্ত বিরোধ এবং কৌশলগত প্রতিযোগিতার কারণে জটিল। লাদাখে সংঘর্ষের মতো ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এখনো প্রকট। রাশিয়া ঐতিহ্যগতভাবে চীনের ঘনিষ্ঠ হলেও ভারতের সঙ্গেও তার কৌশলগত বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চায়। তাই তিন দেশের একযোগে দীর্ঘমেয়াদি ব্লক গঠনের ক্ষেত্রে নানাবিধ স্বার্থসংঘাত সামনে আসতে পারে। বৈঠকের মাধ্যমে এই বিভাজনগুলো পুরোপুরি মিটবে না, তবে ন্যূনতম সমঝোতার ক্ষেত্র খুঁজে বের করা সম্ভব হতে পারে।

বিশ্ব অর্থনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে যদি দেখা যায়, তাহলে শি-মোদি-পুতিন বৈঠক আসলে এক ধরনের সংকেত দিচ্ছে- একক কোনো শক্তি আর পুরো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। ট্রাম্পের শুল্কনীতি হয়তো স্বল্পমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি অন্যান্য রাষ্ট্রকে বিকল্প সহযোগিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর ফলে যে বহু মেরূকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা থামানো কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, প্রযুক্তি উন্নয়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং সামরিক জোট- সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়বে।

এই বৈঠকের তাৎপর্য তাই শুধু তাৎক্ষণিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি মূলত বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার এক নতুন বাস্তবতাকে সামনে আনছে। শি, মোদি ও পুতিন বুঝতে পারছেন যে, পৃথকভাবে কেউই যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবিলা করতে পারবেন না। কিন্তু সম্মিলিতভাবে তারা একটি নতুন শক্তি-সমীকরণ তৈরি করতে সক্ষম। এই সমীকরণ চূড়ান্তভাবে কোন দিকে যাবে, তা নির্ভর করবে পরবর্তী সময়ের কূটনৈতিক নমনীয়তা, অর্থনৈতিক স্বার্থ বিনিময় এবং আঞ্চলিক সংকট ব্যবস্থাপনার ওপর। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বৈশ্বিক রাজনীতির মঞ্চে এই বৈঠক একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে- বিশ্ব আর এক মেরু নয়, বরং বহু মেরুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

অতএব স্পষ্ট, শি, মোদি ও পুতিনের বৈঠক কেবল একটি কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং শক্তির নতুন মানচিত্র আঁকার সূচনা। ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদী শুল্কনীতি হয়তো আমেরিকার স্বল্পমেয়াদি স্বার্থকে রক্ষা করেছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি অন্য শক্তিগুলোকে একত্রিত হওয়ার অনিবার্য কারণ হিসেবে সামনে এনেছে। চীন, ভারত ও রাশিয়া যদি তাদের মতপার্থক্য সামলে ন্যূনতম সমন্বয়ও বজায় রাখতে পারে, তবে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে এর অভিঘাত হবে গভীর ও সুদূরপ্রসারী। বিশ্ব আজ এক মেরুর সংকীর্ণতায় আবদ্ধ নয়; বরং ধীরে ধীরে এক বহু মেরুকেন্দ্রিক বাস্তবতায় প্রবেশ করছে।

সেই বাস্তবতায় শি-মোদি-পুতিন বৈঠক এক শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে- শক্তির খেলার ময়দান আর একক কারও হাতে নেই, বরং ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে সম্মিলিত প্রভাব ও বিকল্প মেরূকরণের ওপর। ট্রাম্প হয়তো ভেবেছিলেন, শুল্কনীতির মাধ্যমে তিনি আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করবেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হয়তো নিজের পায়েই নিজে কুড়াল মারলেন- কারণ তার সেই নীতি প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল না করে বরং তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শক্তিশালী অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ