বিভুরঞ্জন সরকারের বিদায়ই কি শেষ বিদায়, নাকি তারপরও আছে!
২১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার সাংবাদিক ও কলাম লেখক বিভুরঞ্জন সরকার নিখোঁজ হন। নিখোঁজের পরদিন মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার মেঘনা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার নিখোঁজের সংবাদ প্রথমে পাই লেখক লিনু হকের ফেসবুক পোস্ট থেকে, কিছুক্ষণ পর দেখলাম সারা ফেসবুকে তার নিখোঁজের সংবাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ক্লাসমেট ও রাজনৈতিক আদর্শের সতীর্থ জীবন কৃষ্ণ সাহাকে ফোন করলাম; কিন্তু তিনি বিভুরঞ্জন সরকারের বাসা কোথায় তা বলতে পারলেন না। বুঝলাম, সমাজে বিভুরঞ্জন সরকারের প্রয়োজন অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে।
শিল্পকলা একাডেমিতে আড্ডার সঙ্গী প্রদীপ হালদার জানালো, বিভুরঞ্জন সরকারের মরদেহ মেঘনা নদীতে ভেসে উঠেছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় কর্মস্থল বনশ্রীর আজকের পত্রিকা কার্যালয়ে যাওয়ার কথা বলে সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বের হলেও তিনি পত্রিকা অফিসে যাননি, সঙ্গে মোবাইল ফোনটিও নেননি, বরং মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে বাসায় রেখে গেছেন। এছাড়াও তিনি ঘর থেকে বের হওয়ার এক ঘণ্টা আগে সকাল ৯টায় ‘খোলা চিঠি’ অভিধায়ে নিজের একটি লেখা গণমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মেইল করেন। বিডিনিউজের কাছে প্রেরিত লেখাটি পড়েও মনে হয় তিনি ভেবেচিন্তে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কী বলে জানি না; কিন্তু সাঁতার জানা কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করলেও ডুবে মরতে পারবে না, উঁচু কিছু থেকে লাফ দিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হলে ভিন্ন কথা। এটা একটা রহস্যের বিষয়ও বটে।
কী ছিল সেই খোলা চিঠিতে? খোলা চিঠিতে তিনি তার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন যা অনেকের মনে প্রবলভাবে দাগ কেটেছে। তার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী তা নিয়েও টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। অনেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার প্রতি অবহেলাকে দায়ী করছেন, আবার অন্যপক্ষ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মব সন্ত্রাসকে দায়ী করছেন। বিভুরঞ্জন সরকার কিন্তু খোলা চিঠিতে উভয়কে দায়ী করে গেছেন। তিনি লিভার সিরোসিসসহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিলেন। প্রতি মাসে তার ওষুধের জন্য খরচ হতো বিশ হাজার টাকার অধিক। বুয়েট পাস করা তার ছেলেটিও জটিল রোগে আক্রান্ত এবং বেকার; তার বিবাহিত ডাক্তার মেয়েটি উচ্চতর শিক্ষার থিসিস পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে হিন্দু নাম থাকায় বা বিভুরঞ্জনের সন্তান হওয়ায় তার ছেলে বেকার থাকা বা মেয়ের ফেল করার কারণ বলে তার বিশ্বাস। বিভুরঞ্জন সরকার ধারদেনায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সুহৃদদের কাছে বাঁচার জন্য গোপনে হাত পেতেছেন, এত ধারদেনা ছিল যে তাকে তিনি তার ‘পেশা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ছাত্রজীবন থেকেই বিভুরঞ্জন সরকার সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। তার লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েছি ১৯৮৪ সাল থেকে প্রকাশিত শফিক রেহমানের সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’ পড়ে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাপ্তাহিক পত্রিকাটির দুর্দান্ত ভূমিকার কারণে শফিক রেহমানকে পত্রিকা বন্ধ করে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে পত্রিকাটি আবার চালু হয়। যায়যায়দিনে শুরু থেকে নিয়মিত লিখতেন খন্দকার মনিরুজ্জমান, তারিখ ইব্রাহীম, তসলিমা নাসরিন এবং শফিক রেহমান নিজে।
নব্বই দশকের প্রথম দিকে আমার কূটনৈতিক ভাই মহিউদ্দিন আহমদও যায়যায়দিনে নিয়মিত লিখতেন। সত্য কথন কোনো সরকারই পছন্দ করে না এবং করে না বলেই বিভুরঞ্জন সরকার নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তার লেখায় ছদ্মনাম ‘তারিখ ইব্রাহীম’ লিখতেন। শফিক রেহমান বিএনপির বুদ্ধিজীবী; এতদসত্ত্বেও শফিক রেহমান সরকারবিরোধী মতকে তার পত্রিকায় সাদরে স্থান দিতেন, শুধু স্থান দিতেন না- বিরোধী মতকে প্রাধান্যও দিতেন। শফিক রেহমানের যুক্তি ছিল, সরকারের কথা বলার জন্য সরকারের নিজস্ব মিডিয়া আছে, তাই সাপ্তাহিক যায়যায়দিনকে তিনি কখনো সরকারের গুণগান দিয়ে ভর্তি করেননি। যায়যায়দিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিভুরঞ্জন সরকার আর কোনো পত্রিকায় স্থিতি হতে পারেননি।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বিভুরঞ্জন সরকারকে তার সঙ্গে দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, যায়যায়দিনের মায়া কাটাতে না পারায় বিভুরঞ্জন সেই আহ্বানে সাড়া দেননি। শফিক রেহমানকে বলে বিভুরঞ্জনকে যায়যায়দিনে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন মতিউর রহমানই। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র সাপ্তাহিক ‘একতা’য় দুইজন একত্রে কাজ করেছেন। একতায় তখন দুইজনের লেখাই পড়তাম। ভোরের কাগজে যোগ দিলে তিনি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ পেতেন এবং মতিউর রহমানের সঙ্গে থাকলে আর্থিক অনটনে হয়তো বিভুরঞ্জনকে এভাবে মরতে হতো না।
মরলেই মানুষের কদর বাড়ে, সবাই বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীরা মৃতদেহ সম্মুখে রেখে বলেন, ‘তার স্থান পূরণ হওয়ার নয়।’ রাষ্ট্রও গুরুত্বসহকারে শোকবানী প্রকাশ করে; কিন্তু একুশে ও স্বাধীনতা পুরস্কার অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেয়া হয় মরণোত্তর। রাষ্ট্রের এই স্বীকৃতি মৃত মানুষের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনে না। শেখ হাসিনার দরবারে সাহায্যের আবেদন করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলে খোলা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কিছু যে পাননি তা কিন্তু নয়, তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী পাননি।
অনেক সাংবাদিক সরকারের তরফ থেকে প্রদত্ত প্লট পেলেও তিনি দুইবার আবেদন করেও সফল হননি। তার আরও আক্ষেপ ছিল, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখে অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও তার হয়নি; দুটি বই লিখে আগামী প্রকাশনী থেকে কোনো রয়েলটি পাননি। শেখ হাসিনা তাকে সফরসঙ্গী করে সিঙ্গাপুর নিয়ে গেলেও তাতে তার কোনো আর্থিক বেনিফিট হয়নি; অর্থাৎ অভাব তাকে এতবেশি তাড়া করেছিল যে, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়ার সম্মানটুকু তার কাছে গৌণ মনে হয়েছে। বিভুরঞ্জন কিন্তু আওয়ামী লীগের লোক ছিলেন না, ছিলেন রাশিয়াপন্থি কমিউনিস্ট। তারপরও মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে তার অবিচল অবস্থানের কারণে তাকে সবসময় ‘আওয়ামী ট্যাগ’ দেয়া হয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গণমাধ্যমের আতঙ্কে থাকার কথা বিভুরঞ্জন তার খোলা চিঠিতে উল্লেখ করে গেছেন। মিডিয়ার নির্বাহী কর্মকর্তাদের সবাই আতঙ্কে থাকেন মর্মে ‘মানবজমিন’ পত্রিকার মতিউর রহমানও উল্লেখ করেছেন। বিভুরঞ্জনের সর্বশেষ কর্মক্ষেত্র আজকের কাগজে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি লেখার জন্য তাকে ‘লালচোখ’ দেখানো হয়েছে, তার তত্ত্বাবধানে মুদ্রিত মাজহারুল ইসলাম বাবলার একটি লেখার জন্য তাকে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ‘চোটপাট’ করেছে। ওই লেখায় ছিল, সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাকে সামরিক হেলিকপ্টারে দিল্লি পাঠিয়েছে এবং শুধু পুলিশের গুলিতে নয়, মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে জঙ্গিরাও মানুষ হত্যা করেছে। বিভুরঞ্জনের মতে মাজহারুল ইসলামের লেখায় কোনো অসত্য ছিল না।
এই সংবাদ ছাপানোর কারণে পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক তার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিভুরঞ্জনকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। পত্রিকা সম্ভবত চাপে ছিল, তাই বিভুরঞ্জনকে বিদায় করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না। স্বল্প বেতনের এই চাকরিটা হারানোর আতঙ্ক তাকে হয়তো জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল।
আমি এবং বিভুরঞ্জন সমবয়সী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় ছিল না; কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখাশোনা ছিল, কথাবার্তা হতো। তিনি কখনো আওয়ামী লীগ করেননি; কিন্তু ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোর সমর্থক। বয়সে অনেক ছোট হলেও তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল আমার কূটনৈতিক ভাই মহিউদ্দিন আহমদের। দুজনই ছিলেন লিভার সিরোসিসের রোগী। মহিউদ্দিন আহমদ নিয়মিত তার বাড়ির আঙ্গিনায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা ও গানের অনুষ্ঠান করতেন; কিন্তু ওই সব অনুষ্ঠানে বিভুরঞ্জন সরকারকে কখনো যোগ দিতে দেখিনি; তিনি যেতেন একা, গল্প করতেন, দুপুরে খেতেন, খেয়ে খাটে শুয়ে বিশ্রাম নিতেন।
আমার ভাইয়ের বাসায় অসংখ্য দুর্লোভ বই আছে, বিভুরঞ্জন সরকারের আকর্ষণ ছিল বইগুলোর প্রতি। সম্ভবত বয়স এবং সম্পর্কের কারণে মহিউদ্দিন আহমদ থেকে যে কোনো ধরনের সহায়তা নিতে তিনি বিব্রত হতেন না। মহিউদ্দিন আহমদের স্ত্রী বিলকিস মহিউদ্দিনের কাছে শুনলাম, শেখ হাসিনার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে বিভুরঞ্জন সরকার ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন এবং এই আর্থিক সহায়তা লাভে আমার ভাই মহিউদ্দিনের কিছুটা অবদানও ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকর্মী আশুতোষ সাহার সঙ্গে শিল্প একাডেমিতে যাওয়ার পথে একদিন বিভুরঞ্জন সরকারের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করছেন।’ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ দৈনিক সংবাদে লিখলাম, তারা কোনো পয়সা দিল না, বিগত এক মাস যাবৎ লিখছি না; কিন্তু কেন লিখছি না তা পত্রিকার কেউ জানতেও চাইল না, আমার জীবন কত অপাঙক্তেয়।’ এই অপাঙক্তেয় সাংবাদিক ও কলাম লেখক বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যুর খবরে এখন ফেসবুকজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে; তার সহকর্মী, সুহৃদ ও পরিচিতজনরা তাকে নিয়ে হৃদয়গ্রাহী স্মৃতিচারণ করছেন।
বিডিনিউজকে তার লেখা ‘খোলা চিঠি’ পড়ে অপরিচিত সাধারণ পাঠকও তার মৃত্যু নিয়ে নিজেদের বেদনাদায়ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। শোকের এই মাতম সৎকারকে শোকাবহ করেছে সত্য; কিন্তু তার জীবনের অবসায়ন ঠেকাতে পারেনি। হয়তো তাকে কেউ মারেনি; কিন্তু মরতে উদ্বুদ্ধ করেছে সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাঁকশাল।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে