গণপিটুনি দেখে, না দেখার ভান করা কি পুলিশের কাজ!
গত শনিবার (৯ আগস্ট) রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় ভ্যান চোর সন্দেহে রূপলাল দাস (৪০), ও প্রদীপ দাসকে (৩৫) পিটিয়ে মারার ঘটনাটি আবারও জাতির বিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে এবং বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে কঠিনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। গণপিটুনি নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। গত এক বছর ধরে এটা বাংলাদেশে এক ভয়ানক ব্যাধির মতো আবির্ভাব হয়েছে, এ নিয়ে অনেক কথা হলেও এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় বা লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। বরং দিন দিন পরিস্থিতি নারকীয় হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আরও আতঙ্কজনক বিষয়! গণপিটুনি দেখে পুলিশই নাকি পালিয়ে যাচ্ছে!
এ তথ্য জানা গেছে তারাগঞ্জবাসীর ভাষ্যে। সংবাদমাধ্যমকে তারা জানিয়েছেন, রংপুরের তারাগঞ্জে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে পিটিয়ে হত্যার সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ এসেছিল। কিন্তু ‘মবের ভয়ে’ তাদের উদ্ধার না করে ফিরে যায় পুলিশ। ঘণ্টাখানেক পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাদের অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে একজন হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা যান; অন্যজন মারা যান কয়েক ঘণ্টা পর চিকিৎসাধীন অবস্থায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয় অধিবাসীরা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রশাসন কীসের জন্য? পুলিশ আসছিল, লোকগুলাক সেফ করবে না? কিন্তু পুলিশ আসিয়া বহুত লোক দেখিয়া ঘুরি যায়। পুলিশ চাইলে লোক দুইটাক বাঁচার পারত।’
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে যেখানে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তার তিন কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এর আগে আট দিনে তিনটি চুরি-ডাকাতি ও এক শিশুকে গলা কেটে হত্যা করে ভ্যান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ফলে মানুষজন চোর-ডাকাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ৩ আগস্ট থেকে চোর ধরতে এলাকাবাসী রাত জেগে পাহারা দেওয়া শুরু করেন। ঘটনাচক্রে যার নির্মম বলি হন রূপলাল ও প্রদীপ।
এর আগেও আমরা দেখেছি গাজীপুর থানার সামনে দিন-দুপুরে এক সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনকে (৩৫) পিটিয়ে আহত করা হয়েছে, ঘটনাটি পুলিশ দেখেও আহত সাংবাদিককে না বাঁচিয়ে ফিরে গেছে। বর্তমানে দেশে ভয়ানক ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এক দিকে মানুষ বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিপদের সময় এগিয়ে আসছে না। তাহলে এই অরাজক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা কি কল্পনা করা যায়?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে সরকার বা পুলিশের দিক থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কোনো উন্নতি চোখে পড়ছে না। বরং দিন দিন এসব ঘটনা বেড়েই চলেছে। আইনের প্রয়োগ যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় আশ্রয় খুঁজবে? গণপিটুনি শুধু নিরীহ মানুষকে হত্যা করে না; এটি আমাদের বিশ্বাস, নিরাপত্তা এবং ন্যায়ের ধারণাকেও ক্ষুণ্ন করে। পুলিশ যদি ভয়ভীতি বা পরিস্থিতির ভয় পেয়ে নীরব থাকে, তাহলে অন্যায়কারীরা সরব হবে সেটাই স্বাভাবিক।
গণপিটুনি ঘটার মূল কারণ সরকার ও আইনশৃঙ্খলার প্রতি আস্থাহীনতা। এখন গণপিটুনি দেখে ‘মব’-এর ভয়ে পুলিশ পালিয়ে যায়, তাহলে এই অন্যায়কে আরও প্রশ্রয় দেয়া হয়। গণপিটুনি দেখে ফিরে গিয়ে পরে এসে লাশ নিয়ে যাওয়া তো পুলিশের কাজ নয়। এ ঘটনায় স্থানীয় অধিবাসীরা তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন। লাশ নিয়ে তারা মহাসড়ক আটকে বিক্ষোভ করেছে, গণপিটুনিতে অংশ নেয়া অপরাধীদের বিচারের দাবি করেছেন; কিন্তু আমরা মনে করি সেদিন গণপিটুনি দেখে যেসব পুলিশ পালিয়ে গেছেন তাদেরও বিচারের আওতায় আনা জরুরি। পাশাপাশি পুলিশ যাতে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তার জন্য কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে