Views Bangladesh Logo

গাজীপুরে সাংবাদিক হত্যা

বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি বড় অপরাধচক্রকে বাঁচাতে পরিকল্পিত খুন

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

চান্দনা চৌরাস্তা- গাজীপুরের আলো-ছায়ার শেষ প্রান্ত। ৭ আগস্ট ২০২৫ সন্ধ্যায় এখানেই প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে। পুলিশ বলছে, মোবাইল ফোনে সংরক্ষণ করে রাখা অপরাধকর্মের ‘ভিডিওই হয়ে দাঁড়ায় তার মৃত্যুর কারণ। তবে সরেজমিনে দেখা যায়, তুহিন হত্যা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি বড় অপরাধচক্রকে বাঁচাতে পরিকল্পিত খুন- এ প্রশ্নই এখন গাজীপুরে সবার মুখে মুখে।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, চাঁদাবাজির ভিডিও ধারণ করার ফলেই তার এই পরিণতি। তবে পুলিশ বলছে, অন্য আরেকটি অপরাধের ঘটনার ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করার ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে অপরাধীরা এবং হামলা চালিয়ে হত্যা করে তুহিনকে। যে কোনো অপরাধকর্মের ভিডিও ধারণ করা ইদানীং খুবই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। বড় বড় অপরাধের ঘটনাগুলো এভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে; কিন্তু, ভিডিও করলেই কী অপরাধীরা যে কাউকে হামলা করে হত্যা করছে? আগে কোনো ক্ষেত্রেই এরকম ঘটনা না ঘটলে সেদিন কেন অপরাধীরা হত্যা করল তুহিনকে?

ভিউজ বাংলাদেশের অনুসন্ধানে অনেকটাই উঠে হয়ে এসেছে এই প্রশ্নের উত্তর। স্থানীয় সাংবাদিক এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, 'হানিট্রাপে' ফেলে পুরুষদের প্রতারণা করার ঘটনা গাজীপুরে নতুন কিছু না হলেও ইদানীং এর মাত্রা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। সেরকমই একটি ঘটনার কথা জানতে পেরে সেটার ভিডিও নিজের মুঠোফোনে ধারণ করছিলেন তুহিন আর পুরো অপরাধ-চেইন ধামাচাপা দিতেই হত্যা করা হয় তাকে।

পুলিশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, সন্ধ্যা ৭টার দিকে চান্দনা চৌরাস্তার কাছে বাদশা মিয়া নামের এক শ্রমিক এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলছিলেন। সেসময় তাকে হানিট্রাপ করার চেষ্টা করা হয়। একপর্যায়ে দেশি অস্ত্র হাতে কয়েকজন অপরাধী বাদশাকে হামলা করলে তুহিন মোবাইল নিয়ে ভিডিও শুরু করেন। তখন সেই দুর্বৃত্তরা বাদশাকে দেখে তুহিনের দিকে তেড়ে আসে এবং ভিডিও মুছে ফেলতে হুমকি দেয়। তুহিন অস্বীকৃতি জানিয়ে দৌড়ে সেস্থান ত্যাগ করে চায়ের দোকানের ভেতরে আশ্রয় নিলে, অপরাধীরা দোকানের ভেতরে গিয়ে ধারালো অস্ত্র চালিয়ে তাকে হত্যা করে।

এ হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সিসিটিভি ফুটেজ দেখে গ্রেপ্তার করা হয় আটজনকে। পুলিশের নথিতে গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্তদের মধ্যে কেবল মো. মিজান ওরফে কেটু মিজানের (৩৫) তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে। মিজানের বিরুদ্ধে ১৫টির অধিক মামলার কথা জানিয়েছে পুলিশ। স্থানীয়দের কাছে কেটু মিজান ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচিত। মিজান ঠান্ডা মাথার সন্ত্রাসী এবং স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানান স্থানীয়রা। তাদের দাবি, মিজান স্থানীয় রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়ায় মাগিং-গ্যাংয়ের অন্যতম হোতা। মিজান ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত বাকি সাতজনের বিষয়ে পুলিশের নথিতে আগের কোনো অপরাধকর্মের তথ্য লিপিবদ্ধ নেই।

এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের ডিজিটাল নথিতে কারও ব্যাপারে কোনো তথ্য না থাকলে ধারণা করা হয় তারা নতুন করে অপরাধকর্মে জড়িত হয়েছে বা প্রভাবশালী হওয়ার ফলে অপরাধ করে পার পেয়ে গেছে। তুহিন হত্যার ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারকৃতদের বয়স দেখে ধারণা করা হচ্ছে তারা মিজানের মাগিং গ্যাংয়ে খুব বেশি দিন আগে যুক্ত হয়নি।

এ ব্যাপারে একাধিক স্থানীয় ব্যবসায়ী জানালেন, মিজান এসব মাগিং গ্যাং বন্ধ হয়ে যাওয়া পোশাক কারখানা থেকে চাকরিচ্যুত কম বয়সী ছেলেদের যুক্ত করেছে। এমনকি গ্রেপ্তার হওয়া নারী পারুল আক্তারের সহযোগিতায় মিজান পোশাক কারখানার বেকার নারীদের নিয়ে তৈরি করেছে 'হানিট্রাপ' গ্যাং। এ ব্যাপারে জিএমপি কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান নিজের বক্তব্যে স্বীকার করেন এ এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানার বন্ধ হওয়া এবং কর্মসংস্থান হ্রাস অপরাধ কর্ম বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেকাংশে দায়ী।

গাজীপুর প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায় গত বছর ৫ আগস্টের পর এ পর্যন্ত গাজীপুরে প্রায় দুই শতাধিক মানুষ খুনের শিকার হয়েছে। জিএমপি কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান ঘটনাবলির পেছনে বড় কারণ হিসেবে কলকারখানা বন্ধ, কর্মসংস্থান হ্রাস, পুলিশ সদস্যের স্বল্পতা, এবং অপরাধী নেটওয়ার্কের সক্রিয়তাকেই দায়ী করেন। তার ভাষ্য, প্রিভেনশন কাজটি ‘সুচারুভাবে’ করতে পারেনি পুলিশ- এটি পুলিশও মেনে নিয়েছে। এই অবনতির ধারাবাহিকতায় সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে এবং ক্ষোভ বাড়ছে।

এলাকাবাসী জানায়, শহরের প্রতিদিনই বাজার, হাট, ব্রিজের নিচ থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে মরদেহ। চান্দনা চৌরাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে দোকানদার, ভ্যানচালক ও স্থানীয়রা ভয়ে কথা বলছিলেন। স্থানীয় কবির হোসেন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, 'তুহিন সাংবাদিক বলে আজ সারাদেশ যেভাবে গাজীপুরের হত্যাকাণ্ডের খবর নিয়ে সরব, সাধারণ একজন গার্মেন্টস কর্মী হত্যার শিকার হলে এত দ্রুত কি পদক্ষেপ নিত পুলিশ? এক সময় রাত-দিন জেগে থাকত এই শিল্পনগরী গাজীপুর। এখন অন্ধকার নামলেই ভয় করে। কলকারখানা বন্ধ হয়েছে, মানুষের জীবন তো থেমে নাই। হতাশা থেকে বেকার ছেলেরা মাদকাসক্ত হচ্ছে, জড়িয়ে পড়ছে অপরাধকর্মে।'

তার কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে করিম চা স্টলের মালিক করিম মিয়া বলেন, 'আট বছর যাবত এখানে দোকান করছি। গত এক বছরে যত হত্যার কথা শুনলাম, সেটা এর আগে শুনিনি। বেকার গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেশি ভাগই এখন স্থানীয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে।' গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর গাজীপুরের অন্তত ১৭টি মাঝারি ও বড় গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে যায়- এর মধ্যে শ্রীপুর, কালিয়াকৈর এবং কাশিমপুরের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (BGMEA) তথ্য অনুযায়ী, এই বন্ধের ফলে সরাসরি প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন, আর পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়ে আরও কয়েক হাজার পরিবারে। স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের মতে, বেকারদের অনেকেই নতুন চাকরি বা বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে না পেয়ে ক্ষুদ্র অপরাধ, চুরি, ছিনতাই, ও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন।

পুলিশও স্বীকার করেছে যে, ২০২৪ সালের শেষ কয়েক মাস থেকে গাজীপুরে অপরাধের হার প্রায় ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত কিছু আসামি সরাসরি এই বেকার শ্রমিকদের মধ্য থেকে এসেছে, এবং কয়েকজন আগে গার্মেন্টস কারখানায় সিকিউরিটি গার্ড বা লোডার হিসেবে কাজ করতেন। চাকরি হারানোর পর তারা স্থানীয় অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, যাদের মধ্যে মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি অন্যতম আয়ের উৎস হয়ে ওঠে।

এদিকে স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, গাজীপুরের সাম্প্রতিক হত্যা-পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যার গল্প নয়- এটি এক আর্থসামাজিক সংকেত। কর্মসংস্থানের সংকোচ, সংগঠিত অপরাধ-নেটওয়ার্কের উত্থান, এবং দায়বদ্ধ পুলিশিংয়ের অভাব মিলিয়ে শহরটিকে ভীতিপ্রবণ করে তুলেছে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ