Views Bangladesh Logo

রোহিঙ্গা সংকটের জটিলতা কাটাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপ বাড়াতে হবে

মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যে বাংলাদেশে বড় ধরনের সংকটের জন্ম দেবে তা কয়েক বছর ধরেই আশঙ্কা করা যাচ্ছিল। দিন দিন সেই আশঙ্কা সত্য হচ্ছে। কয়েকবার চেষ্টা করেও রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি। বরং দিন দিন নতুন নতুন রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশে ঢুকছে নানা ধরনের নেশাদ্রব্য। তার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক বরাদ্দও কমে আসছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায় রোহিঙ্গা ঢলের ৮ বছর পর আরও জটিল হয়ে গেছে রোহিঙ্গা সংকট। 

সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, বিগত ৮ বছরে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে খুন হয়েছেন ২৬৩ জন। এ সময় বিভিন্ন অপরাধের ৪ হাজার ৫৪টি মামলায় ৯ হাজার ৩৩ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়; কিন্তু ১৪ লাখ রোহিঙ্গার ভেতর থেকে আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা কঠিন। আট বছরে মাদকের ২ হাজার ৫৮৯টি মামলায় ৩ হাজার ৯৩৫ জনকে আসামি করা হলেও অনেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। একই সময় অস্ত্রের ৪১৮টি মামলায় ৮৭৩ জনকে আসামি করা হলেও চিহ্নিতদের অনেককে আইনের আওতায় আনা যায়নি। বিগত দেড় বছরে ৩৮টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মামলায় ৩৪ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়। ৩৭টি অপহরণের মামলায় আসামি করা হয় ৮৯ জনকে। ১৭টি মানব পাচার মামলায় আসামি করা হয় ১৮ জনকে।

এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তিনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সম্মেলনের আয়োজন করছে। প্রথমটি শুরু হয়েছে গতকাল সোমবার (২৫ আগস্ট) কক্সবাজারে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাকি দুই সম্মেলনের একটি হবে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। অন্যটি হবে ৬ ডিসেম্বর কাতারে।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অংশীজন সংলাপে দেয়া বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর ভূমিকা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অধ্যাপক ইউনূস তার বক্তব্যে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে যে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন তার মধ্যে রয়েছে- রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন, দাতাদের অব্যাহত সমর্থন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করার আহ্বান, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা, গণহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহিতা ত্বরান্বিত করা।

শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা বা জিআরপির আওতায় খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়া হয়। জিআরপিতে অনুদান দেয় বিভিন্ন দেশ, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সবচেয়ে বেশি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পর সহায়তা কমিয়ে দেয়া হয়। ২০২৫ সালের জন্য জিআরপির আওতায় ৯৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার চাওয়া হয়েছিল। গত জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে পাওয়া গেছে ৩৫ শতাংশ। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বলেন, যে সহায়তা দেয়া হয়, তা দিয়ে তাদের চলে না। বর্ষাকালে আশ্রয়শিবিরে পাহাড়ধসের ঝুঁকি, শীতকালে আগুনে পুড়ে মরার শঙ্কা ও আর নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়ে বাস করতে হচ্ছে। তারা দ্রুত ফিরতে চান।

রোহিঙ্গারাও ফিরতে চায়, বাংলাদেশ তাদের ফেরাতে চায়; কিন্তু মিয়ানমারে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে এর মধ্যে তাদের ফেরত পাঠানোও অসম্ভব। তাহলে উপায় কী? আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ছাড়া এটা প্রায় অসম্ভব। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত যেতে হলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির মধ্যে যোগসাজশ থাকতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে তাদের। সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকাকে অপরিহার্য উল্লেখ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আসিয়ান ও প্রতিবেশী দেশগুলোকে আরও সক্রিয়ভাবে রাখাইন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে মানব পাচার, মাদক চোরাচালান ও ক্ষুদ্র অস্ত্রের অবৈধ ব্যবসার মতো আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনেও উদ্যোগী হতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশেও এক প্রকার রাজনৈতিক সংকট চলছে। সামনে নির্বাচন। অন্তবর্তী সরকার আর অল্প কয়েক মাস ক্ষমতায় থাকবে। নির্বাচনের পর কোন সরকার আসবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন কীরকম হবে তাও অজানা।


এই পরিস্থিতিতে অন্তবর্তী সরকার যদি অন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনের কোনো স্থায়ী সমাধান বা নিশ্চয়তা না দিয়ে যেতে পারেন তাহলে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশে আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে তাও অনুমান করা যায়। তার মানে সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা সংকট শুধু জটিল না, বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুতর এক সমস্যা হয়ে থাকবে। তাই রোহিঙ্গা সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মহলে এখনই আরও চাপ বাড়াতে হবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ