পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ‘অপমানিত’ রাষ্ট্রপতির চিঠি এবং কিছু সাংবিধানিক প্রশ্ন
বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি সরানো নিয়ে যখন তোলপাড় শুরু হলো তখন অনেকের মনেই এই প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতিকে কি সরিয়ে দেয়া হচ্ছে বা তিনি নিজেই কি চলে যাচ্ছেন?
এবার সেই রাষ্ট্রপতির একটি চিঠি সামনে এলো যা তিনি লিখেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনকে। বুধবার (১ অক্টোবর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ওই চিঠিটি প্রকাশ করেন সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। এরপর একাধিক গণমাধ্যমও চিঠিটি প্রকাশ করে।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষর করা চিঠিতে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের কূটনৈতিক অফিস থেকে নিজের ছবি অপসারণের বিষয়টি উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি যেন অপদস্থ না হন সে জন্য কি কৌশলী পদক্ষেপ নেয়া যেত না?’
রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাংবিধানিক দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন উল্লেখ করে মো. সাহাবুদ্দিন লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার পর হতে অদ্যাবধি যা হয় নাই তাই করছি। প্রায় অর্ধশতাধিক অর্ডিন্যান্স জারি করে সরকারকে আইনগত পূর্ণ সহযোগিতা করছি। সরকার আইনগতভাবে সবল অবস্থানে আছে। ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত দেশের সংকটকালে আমার কার্যক্রমও প্রনিধানযোগ্য।’
রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তিটি নিজের রাগ-ক্ষোভ আর বেদনা প্রকাশ করে চিঠি লিখলেন তার অধস্তন মন্ত্রী পদমর্যাদার একজন ব্যক্তিকে। এই ঘটনাটি বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসেই সম্ভবত বিরল।
প্রসঙ্গত, সরকারি অফিস কিংবা বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে রাষ্ট্রপতির ছবি টানাতে হবে- এমন কোনো আইন বা সাংবিধানিক বিধান নেই। সরকারি অফিসে কেবল বঙ্গবন্ধুর ছবি টানানোর বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে- যেটি সংবিধানে যুক্ত করা হয় ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।
সংবিধানের ৪ অনুচ্ছেদে একটি নতুন উপদফা যুক্ত করে বলা হয়: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং সব সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করতে হবে।
কিন্তু সরকারি অফিসে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ সরকার প্রধানের ছবি টানানোর বিষয়ে কোনো আইন নেই কিংবা সংবিধানেও এর কোনো বিধান নেই। বরং কেবিনেটের সিদ্ধান্তের আলোকে সরকারি অফিসে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি প্রদর্শন করা হয়। সুতরাং, বিদেশি মিশন থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি সরিয়ে ফেলা নিয়ে যে বিতর্ক ওঠে, খুব সহজেই সেই বিতর্ক এড়ানো যেত যদি এ বিষয়ে কেবিনেটে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো।
কেননা কেবিনেট পূর্ববর্তী যে কোনো কেবিনেটের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারে। যেমন সংসদ চাইলে পূর্ববর্তী সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারে। সংসদকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে জনগণের ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি মাথায় রেখে। সংবিধান যেহেতু বলছে ‘প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে’- অতএব, সেই জনগণের প্রতিনিধিরা চাইলে পূর্ববর্তী সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারেন। একইভাবে সরকারি অফিস ও বিদেশি মিশনে রাষ্ট্রপতির ছবি টানানোর বিষয়ে কেবিনেটের যে সিদ্ধান্ত ছিল সেটি অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে কেবিনেটে সিদ্ধান্ত দিয়েই বাতিল করতে পারত; কিন্তু তারা সেটি করেনি।
চিঠিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রপতিও লিখেছেন: ‘এক রাতের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে আমার ছবিটি অপসারিত হয়ে শুধু গণমাধ্যমের উপজীব্য নয় বরং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আমার সম্মান ভূলুণ্ঠিত হলো। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা একজন সচেতন নাগরিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হলো অপমানিত।’
গত ১৭ আগস্ট দিনভর দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো বিদেশি দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর ইস্যুতে সরব ছিল। বিষয়টা ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়। সুনির্দিষ্ট সূত্র উল্লেখ না করে খবরে বলা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশে অবস্থিত দূতাবাস, হাইকমিশন ও কূটনৈতিক আবাসিক অফিস থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছে।
তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, এটি লিখিত কোনো নির্দেশনা নয় এবং এ বিষয়ে কেবিনেটে কোনো আলোচনা হয়নি। যে কারণে প্রশ্ন ওঠে, মৌখিক নির্দেশনাটি কে দিলেন এবং কেন এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মৌখিক নির্দেশনায় করতে হলো? সরকারের উদ্দেশ্য যেহেতু রাষ্ট্রপতির ছবি সরিয়ে ফেলা, অতএব সেটি যদি মৌখিক নির্দেশনাতেই হয়ে যায় তাহলে আর লিখিত নির্দেশনার কী প্রয়োজন- এরকম একটি চিন্তা কি সরকারের বিবেচনায় ছিল?
এ বিষয়ে ওইদিন রাতে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন: ‘সরকারি দপ্তরে পোট্রেট ব্যবহার শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার নিরুৎসাহিত করছে। অলিখিতভাবে জিরো পোট্রেট নীতি বজায় রেখেছে। তারপরও কেউ কেউ সরকার কিংবা রাষ্ট্র প্রধানের ছবি নিজ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করেছে। সেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে এমন কোনো লিখিত নির্দেশনা কোনো দপ্তর কিংবা মিশনকে দেয়া হয়নি। তারপরও দেখা যাচ্ছে আজ এটা নিয়ে বাজার গরম করে ফেলা হয়েছে। নির্বাচনের সময় ঘোষণা করার পর রাজনীতি নিয়ে ঘোঁট পাকানোর সুযোগ কমে আসছে। কাটতি ধরে রাখার জন্য ছোটখাটো অনেক বিষয়কেও এখন তাই পাহাড়সম করে তোলা হচ্ছে।’
অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সরকারি অফিসগুলো থেকে স্বাভাবিকভাবেই শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। অনেক স্থানে তার ছবি ভাঙচুর করা হয়। ছবিতে আগুন দেয়া হয়। সেইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছবিও ভাঙচুর করা হয়। এমনকি তার ছবি নিচে ফেলে জুতা দিয়ে মাড়ানোর ঘটনাও ঘটে।
গত বছরের নভেম্বরে বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলা হয় এবং বিষয়টি নিয়ে তখন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটি ফেসবুক পোস্টও দেন; কিন্তু বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রদর্শন বাধ্যতামূলক। যে কারণে তখন প্রশ্ন ওঠে, বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে একজন উপদেষ্টা নিজেই সংবিধান লঙ্ঘন করলেন কি না, নাকি উপ-প্রেস সচিবের ভাষায় এটিও ‘জিরো পোট্রেট নীতি’র বহিঃপ্রকাশ?
কিন্তু এবারের ঘটনায় এটি স্পষ্ট যে, সরকারি অফিস কিংবা বিদেশি মিশন থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ছবি সরানো হয়নি, বরং সরানো হয়েছে মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি। অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্রপতির পদটি মুখ্য নয়, বরং আপত্তিটা ব্যক্তিকে নিয়ে। যেহেতু তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তিনি আওয়ামী লীগের লোক হিসেবেই পরিচিত অতএব অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরও তিনি কী করে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসে থাকেন তা নিয়ে অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সংগঠনসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের প্রশ্ন আছে। এমনকি তাকে সরানোর জন্য বঙ্গভবন ঘেরা কর্মসূচিও পালিত হয়েছে; কিন্তু নানা কারণেই তাকে সরানো যায়নি এবং তিনি নিজেও পদত্যাগ করেননি। প্রশ্ন হলো, বিদেশি মিশন থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নির্দেশনা কি তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার ইঙ্গিত?
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও দীর্ঘ। সংবিধানের ৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: এই সংবিধান লংঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করা যাবে; এর জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে অনুরূপ অভিযোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে দিতে হবে; স্পিকারের কাছে ওই নোটিশ প্রদানের দিন হতে ১৪ দিন পর এবং ৩০ দিনের মধ্যে এই প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আলোচনা হবে। সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য স্পিকার অবিলম্বে সংসদ আহ্বান করবেন। অভিযোগ বিবেচনার পর মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অভিযোগ যথার্থ বলে ঘোষণা করে সংসদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করলে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে। এর মাঝখানে আরও কিছু প্রক্রিয়া আছে যা বেশ জটিল।
শুধু তাই নয়, শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে অপসারণ করতে হলেও সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে তার (রাষ্ট্রপতি) অসামর্থ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে দিতে হবে। স্পিকার সংসদের অধিবেশন আহ্বান করবেন এবং একটি চিকিৎসা-পর্ষদ গঠন করবেন। দশ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির শারীরিক অক্ষমতা পরীক্ষা করতে হবে। এরপর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে। অর্থাৎ এটিও বেশ জটিল। যে কারণে অতীতে দেখা গেছে রাষ্ট্রপতিদের অপসারণের চেয়ে তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়; কিন্তু এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগও জটিল। কেননা সংবিধানের ৫০(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: স্পিকারের উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে রাষ্ট্রপতি স্বীয় পদ ত্যাগ করতে পারবেন। এই মুহূর্তে যেহেতু দেশে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার কেউই নেই- তাহলে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন? প্রধান বিচারপতির কাছে? সেটি করতে হলে সংবিধানের এই বিধান পরিবর্তন করতে হবে। সেটি না পারলে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিতে হবে- যে মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এর বাইরে আপাতত আর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
তার মানে অন্তর্বর্তী সরকার এবং তাদের স্টেকহোল্ডাররা চাইলেই প্রচলিত নিয়ম তথা সাংবিধানিক বিধান মেনে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে সরাতে পারছে না। আবার তিনি যদি পদত্যাগ করতে চান, সেটিও জটিল এবং যদি পদত্যাগে রাজি না হন তাহলেও তাকে জোর করে সরানোর সুযোগ নেই। এ কারণেই হয়তো বঙ্গভবন ঘেরাও করে একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা হয়েছিল।
সুতরাং, রাষ্ট্রপতি থাকছেন কি থাকছেন না এবং তিনি থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার ও তার স্টেকহোল্ডারদের কী অসুবিধা তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, তার ছবি সরানো নিয়ে যে ঘটনা ঘটলো বা ঘটানো হলো- তার মধ্য দিয়ে আসলে কে কাকে কী বার্তা দেয়ার চেষ্টা করলেন এবং এই বিষয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি নিজের মনোকষ্ট প্রকাশ করে তার অধস্তন পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে যে চিঠি লিখলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে এই ঘটনা কীভাবে মূল্যায়িত হবে তা এখনই বলা কঠিন।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে