Views Bangladesh Logo

ভারত-বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান : স্মৃতি, সত্তা ও ভবিষ্যৎ

Pabitra  Sarkar

পবিত্র সরকার

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এখন একটি ক্ষুরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হয়। আমার কাছে সংস্কৃতি শুধু গানবাজনা-নাচনাটক ইত্যাদি নয়, তা মানবের এই ভূপ্রকৃতির ওপর যা কিছু কর্ম, নির্মাণ ও পরিবর্তন, তার সব কিছু। কৃষিও সংস্কৃতি, রন্ধনও সংস্কৃতি, ফলে মৎস্য শিকারও সংস্কৃতি। তাই সম্প্রতি যে ৯৫ জন নিশানা ভুলে বাংলাদেশের সমুদ্রে চলে গিয়ে ওদেশের পুলিশের হাতে বন্দি হয়েছিলেন এবং শুনলাম প্রচুর পিটুনি খেয়ে ফিরে এসেছেন- সেটাকে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের অংশ হিসেবে দেখব কি না জানি না। হলেও ‘বৈধ’ আর দুই দেশের পরস্পরের ইচ্ছাধীন আর অভিপ্রেত আদান-প্রদানের উদাহরণ হিসেবে নিশ্চয়ই নয়।

এর অর্থ হলো, আদান-প্রদান বলতে আমরা তো শেষেরটাকেই বুঝি। দুটি দেশ পরস্পরের সুস্থিতি, লাভ ও উন্নয়নের জন্য পরস্পরের মধ্যে, বস্তু, বিদ্যা, শিল্প, প্রেরণা, শুভেচ্ছা ইত্যাদির আদান-প্রদান করবে, পরস্পরের প্রয়োজনে সাহায্য (সামরিক বা অসামরিক) করবে- এটাই স্বাভাবিক এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে অধিকাংশ সময়, নানা রকমার উচ্চনীচতার পর্ব সত্ত্বেও তাই হয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত মানবিক ও সামরিকভাবেও উদীয়মান বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল, এক কোটি উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছিল, আর তার প্রায় ১৬০০ সৈন্য সেই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল- এই ‘আদান-প্রদান’-এর কথা এই আগস্ট অভ্যুত্থানের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের একটি গণপরিসরে মুহুর্মুহু উচ্চারিত হতো। পরে বাংলাদেশের সৈন্যবাহিনীকে ভারত সামরিক প্রশিক্ষণও দিয়েছে শুনেছি, আরও কী কী প্রশিক্ষণ দিয়েছে জানি না। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের ৫০ জন বিচারকের ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে আসার কথা ছিল, জানা গেল বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে দুই দেশের নিয়মিত পণ্য আদান-প্রদান হয়েছে, চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিরা কলকাতায় হায়দরাবাদে চেন্নাইয়ে দলে দলে এসেছেন, এসে নিউমার্কেটে ও গড়িয়াহাটে প্রচুর বাজার করেছেন। আজমির শরিফ ও অন্যত্র তীর্থ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসা অনেক মানুষের পরবর্তী প্রজন্ম ব্যাকুল হয়ে ছুটে গেছেন তাদের পূর্বপুরুষের জন্মভূমি দেখতে, গিয়ে ফেলে আসা ভিটের ওপর বসে চোখের জল ফেলেছেন। তেমনই বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন এপার থেকে যাওয়া উদ্বাস্তুরা। প্রয়াত লেখক হাসান আজিজুল হক ছুটে গেছেন তার বর্ধমানের গ্রামে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার উত্তর চব্বিশ পরগনার ভিটেতে বা পার্ক সার্কাসের ভাড়া বাড়িতে। বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা ভারতে পড়তে এসেছে, আমাদের রবীন্দ্র ভারতীতেই প্রতি বছর একটা বাংলাদেশি ‘ছাত্রধারা’ বজায় থেকেছে, বিশ্বভারতীতেও। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও বঞ্চিত হয়নি। গায়ক-গায়িকারা ওদেশ থেকে এসেছেন, এদেশ থেকে গেছেন, নাটকের দল গেছে এসেছে, চিত্রশিল্পীদের যুগ্ম কর্মশালা হয়েছে দু-দেশেই, অধ্যাপকরাও যাতায়াত করেছেন নানা আলোচনাচক্রে, এমনকি এই অধমের মতো লোকও আমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে বাংলা একাডেমিতে বাংলা ব্যাকরণ সম্পাদনা করে এসেছে ওদেশের প্রবীণ অধ্যাপকের সঙ্গে যুগ্মভাবে।

এখানে নন্দনে ও অন্যত্র বাংলাদেশের সিনেমা দেখতে আমরা ভিড় করেছি। আর এই সেদিনও সদ্যপ্রয়াত শ্যাম বেনেগালের শেখ মুজিবের ওপর তৈরি চমৎকার ছবিটি দেখলাম। সেটি নাকি ভারত সরকারের ফিল্ম ডিভিশন আর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সহায়ক কেন্দ্র যুগ্মভাবে প্রযোজনা করেছে। সবচেয়ে স্পষ্ট, প্রকাশ্য ও আকাঙ্ক্ষিত যেটি ছিল তা হলে কলকাতার বইমেলাতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। কলকাতা পুস্তকমেলা প্রাঙ্গণে বহু বছর ধরে বাংলাদেশের বইয়ের প্রাসাদোপম একটি আশ্রয় তৈরি হয়ে এসেছে, তার বাইরে কৌতূহলী ও ক্রেতাদের দীর্ঘ সারি দেখতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। ওই সারি ছিল, বিশ্বাস, প্রত্যাশা আর ভালোবাসা দিয়ে তৈরি। এ পারের বাঙালিরা বিশ্বাস করে যে, ওপারেও আমাদের একভাষী স্বজনরা জ্ঞান, রস আর সংস্কৃতির নানা দিকে শ্রদ্ধাযোগ্য অর্জন করে চেলেছে, সেগুলো সম্বন্ধে আমাদের জানতে হবে, না জানলে বাঙালি হিসেবে আমরা অসম্পূর্ণ থাকব। ওপারের বাঙালিরাও এপার বাংলার সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে একই, হয়তো আরও বেশি, শ্রদ্ধা আর আগ্রহ দেখিয়েছে। জানি না, এখন তার স্মৃতি বাংলাদেশে কতটা শক্তিশালী।


সেই আদান-প্রদানের ইতিহাসে এখন একটি ছেদের না হোক, অস্থিরতার পর্যায় আসন্ন বলে আমাদের মনে হচ্ছে। উপরে পঞ্চাশজন বিচারকের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে আসা বন্ধ হওয়ার খবর দিয়েছি। আমি জানি না প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত আগেকার সরকার নিয়েছিল কি না এবং তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকার নিয়েছে কি না; কিন্তু বইমেলাতে যোগদান করছে না বাংলাদেশ, তা নিঃসন্দেহে এই সরকার বা এই আমলের সিন্ধান্ত। পাঠকরা জানেন যে, বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বই নানাভাবে কলকাতায় উপস্থিত হতো। তার চাহিদা প্রথম থেকেই ছিল, কারণ বাংলাদেশে বা তার আগে পূর্ব পাকিস্তানে উল্লেখযোগ্য জ্ঞানাত্মক, আলোচনাত্মক ও সৃষ্টিশীল সাহিত্য তৈরি হচ্ছিল তার খবর এ পারের বাঙালি রাখত। কিন্তু বইগুলো পাবার কোনো সহজ রাস্তা ছিল না, কলকাতার কয়েকজন পুস্তক বিক্রেতা অল্পস্বল্প বই আনতেন যা এ পারের বাঙালির কাছে সে সব বই পাবার তৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে তুলত। এই লেখক ১৯৭০-এর বছরগুলোর গোড়ায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বাংলাদেশের বই ও পত্রপত্রিকার বিপুল সংগ্রহ দেখে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল এবং তার নিজের লেখায় সেই সুযোগকে সে যথাসম্ভব কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল।

তারপর বাংলাদেশ হলো, এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশের সাহিত্য বিশেষ পাঠ্য হলো বাংলা সাহিত্যের পাঠক্রমে, ফলে সেসব বইয়ের চাহিদা বাড়ল। দু-চারজন প্রকাশক ও গ্রন্থবিক্রেতা আনতে লাগলেন সেখানকার বই, আর কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশনও প্রথমে একটি গ্রন্থাগার খুলে বাংলাদেশের বই রাখার ব্যবস্থা করলেন। তারপর বাংলাদেশের প্রকাশকরা কলকাতা পুস্তক মেলাতে এই শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে বেশ ভালোভাবে অংশ নিতে শুরু করলেন। বইমেলার কেন্দ্রে তাদের একটি প্রাসাদের মতো অবস্থান হলো, তাতে বহু প্রকাশক স্টল সাজাতেন।

অন্যদিকে, সম্ভবত ২০০১ থেকে বাংলাদেশের বইয়ের একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন মেলা পুজোর আগে, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বা মোহর-কুঞ্জে অনুষ্ঠিত হতে শুরু করল তাতে বাংলাদেশ উপহাইকমিশন নানা জ্ঞানগর্ভ আলোচনারও ব্যবস্থা করতেন। আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু প্রধান প্রকাশকও কলেজ স্ট্রিটের অঞ্চলে নিজেদের শাখা খুলতে এগিয়ে এলেন।

এ বছর বইমেলায় বাংলাদেশের সেই বিশাল স্টল ছিল না। এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা হতাশ, বহু ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ পাঠক এই সব সুযোগের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে। জানি না, বাংলাদেশের প্রকাশকদের শাখাগুলোর কী অবস্থা হবে। তারা যদি কোনো চাপে বা নিরাপত্তার প্রশ্নে নিজেদের উপস্থিতি প্রত্যাহার করেন সে খুবই মর্মান্তিক ব্যাপার হবে। এ বিষয়ে আমি আগে অন্যত্র লিখেছি। শুনেছি, উত্তেজনার আবহে বাংলাদেশি প্রকাশকদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না জানিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ, তাই বাংলাদেশের প্রকাশকরা নিরুৎসাহিত হয়েছেন। তা যদি হয়ে থাকে সে খুব দুঃখের কথা। সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গবাসীদের কাছ থেকে ওই প্রতিক্রিয়া আমরা সম্ভব বলে মনে করি না। ফলে বাংলাদেশের নিজস্ব বইমেলাটি এবার অনুষ্ঠিত হবে কি না তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে, না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

এ কথা ঠিক যে, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কিছু অনভিপ্রেত আক্রমণ ও অবিচারের ঘটনার খবর এ দেশে আসায় এখানেও কিছু উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। যেমন কিছু ডাক্তার ঘোষণা করেছিলেন যে তারা বাংলাদেশের রোগীদের (সম্ভবত বিশেষ সম্প্রদায়ের রোগীদের) চিকিৎসা করবেন না বলে ঘোষণা করেছিলেন। দুর্গাপুরের একটি প্রদর্শনীতে নাকি ঢাকাই শাড়িও পোড়ানো হয়েছিল। আমরা এই ধরনের মনোভাবকে ধিক্কার জানিয়েছি এবং বলেছি যে রোগীরা রোগীই, তাদের কোনো জাত বা ধর্ম নেই যেমন, তেমনই এপারে ঢাকাই পোড়ানো হলে ওপারে মুর্শিদাবাদী পোড়ানো হবে। এর কোনো শেষ নেই, আর এটা কোনো সংকট সমাধানের পথও নয়। এভাবে সংঘাতের দিকে অগ্রসর হওয়া প্রতিবেশী কোনো দুটি দেশের পক্ষেই উচিত বা মঙ্গলদায়ক নয়; কিন্তু উত্তেজনা তৈরি করা ও জিইয়ে রাখা এক শ্রেণির মানুষের জীবিকা, তারা এটা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের একটা উপায় বলে মনে করে। তা যে দুই দেশের মানুষের পক্ষেই অবিমিশ্রভাবে ক্ষতিকর, তা তারা বোঝে না। তাই হাস্যকর ও নির্বোধ নানা গুজব ছড়ানো, তাতে বিশ্বাস করে আরও উত্তেজনা সৃষ্টি- তারই যেন একটা প্রতিযোগিতা লক্ষ করছি। এই প্রয়াসের আমরা নিন্দা করি।

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর তার উপদেষ্টারা, বাংলাদেশের নানা রাজনৈতিক দল এবং জনতা কেউ এক ভাষায় কথা বলছেন না তা আমরা লক্ষ করি এবং উদ্বিগ্ন থাকি। আবার ড. ইউনূসও যে সর্বক্ষণ এক ভাষায় কথা বলছেন তাও নয়। বিশেষ করে ভারত সম্বন্ধে তার মতামত পারদের মতো পরিবর্তনশীল বলে বোধ হচ্ছে।

আমরা চাই, দু-দেশের মধ্যে সহজ আদান-প্রদানের সম্পর্ক আবার প্রতিষ্ঠিত হোক। যে পণ্য বাংলাদেশের দরকার তা ভারত তাকে সরবরাহ করুক। এতে আধিপত্যের কিছু নেই, বাংলাদেশ উচিত দাম দিয়ে নেবে, তাতে ভারতের লাভ বই ক্ষতি হবে না। ভারতে আসুক বাংলাদেশের পণ্য, রোগার্ত মানুষ, ক্রেতা, কর্মী, পেশাজীবী, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা। দু-দেশেই সব সম্প্রদায় শান্তি ও নিরাপত্তা নিয়ে বাস করুক। বাংলাদেশের জনগণ তাদের পছন্দসই সরকার নির্বাচন করুন; কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সৌহার্দ্য থাকুক; কিন্তু জনসাধারণের স্তরে আবার সবরকমের আদান-প্রদান আরম্ভ হোক।

পবিত্র সরকার: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক, নাট্য সমালোচক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ