Views Bangladesh Logo

শকগানের অবৈধ বাণিজ্য: আত্মরক্ষার নামে অপরাধের নতুন ফাঁদ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ভয়ংকর প্রবণতা নীরবে বিস্তার লাভ করছে। নানা ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে এখন খোলামেলাভাবে বিক্রি হচ্ছে ‘হাই ভোল্ট শকগান’। বিজ্ঞাপনে দাবি করা হচ্ছে, এটি নাকি আত্মরক্ষার কার্যকর অস্ত্র; কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শকগান ব্যবহারকারীর হাতেই শুধু নয়, সম্ভাব্য ভুক্তভোগীর জীবনেও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

এই শকগান দেখতে ছোট আকারের হলেও ভেতরে রয়েছে উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ প্রবাহের ক্ষমতা। প্রচারণা অনুযায়ী, এর শক খেলে যে কেউ মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান হারাতে পারে। বাস্তবে এই ‘অস্ত্র’ ব্যবহারের ফলে হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার মতো ভয়ংকর পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। তাই চিকিৎসকরা সতর্ক করে বলছেন, দীর্ঘ সময় শক লাগলে মৃত্যুও অবশ্যম্ভাবী।

আত্মরক্ষার নামে ছিনতাইকারীর হাতিয়ার
প্রথমে আত্মরক্ষার সরঞ্জাম হিসেবে জনপ্রিয় হলেও এখন এই শকগান ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসীদের হাতেও পৌঁছে যাচ্ছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তারা জানান, কেউ যদি রাতের অন্ধকারে কিংবা জনবিরল রাস্তায় এ ধরনের অস্ত্র দিয়ে পথচারীকে শক দেয়, তবে ভুক্তভোগী তাৎক্ষণিক অচেতন হয়ে পড়বেন। তখন সহজেই নগদ টাকা, মোবাইল ফোন কিংবা অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, “শকগান আমদানির ক্ষেত্রে কোনো আনুষ্ঠানিক অনুমতি নেই। এগুলো অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের আশঙ্কা, এগুলো অপরাধীদের হাতে পড়লে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।”

নিয়ন্ত্রণহীন অনলাইন বাজার
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ফেসবুকের কিছু গ্রুপ ও পেইজে সরাসরি পোস্ট করে শকগানের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। বিক্রেতারা পণ্যের ছবি, দাম ও ডেলিভারির শর্ত লিখে দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ভিডিও পোস্ট করে দেখাচ্ছেন—শকগান কীভাবে কাজ করে। এসব পোস্টে তরুণদের আগ্রহও চোখে পড়ার মতো। ক্রেতাদের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে, ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ সেবার পণ্য হাতে পাওয়ার আগেই কোনো ঝামেলায় না পড়তে হয়।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্ত্র আইন অনুযায়ী এ ধরনের যন্ত্র বিক্রি ও ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু অনলাইনে নিয়ন্ত্রণের অভাব ও সচেতনতার ঘাটতিতে বিক্রেতারা প্রায় অবাধেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
চিকিৎসক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ ভোল্টের শক শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। স্বাভাবিক অবস্থায় যে ব্যক্তি কোনো রোগে ভুগছেন না, তার ক্ষেত্রেও এটি হৃৎপিণ্ডের ছন্দ নষ্ট করে দিতে পারে। আর যাদের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ বা স্নায়বিক দুর্বলতা আছে, তাদের জন্য এটি মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, ‘অনেকেই ভাবেন শক দিলে শুধু সাময়িক অসাড়তা হবে। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় এতে স্থায়ী ক্ষতি হয়—মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, স্নায়ু নষ্ট হতে পারে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।’

শকগান সাধারণ মানুষের হাতে বিপজ্জনক
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘৫ হাজার-১০ হাজার ভোল্টের শক মূলত জেলখানায় বা পুলিশ অপরাধীদের ধরার জন্য অথবা তাদের স্থবির করার জন্য ব্যবহার হয়। এটি সাধারণ মানুষের হাতে গেলে নিঃসন্দেহে অপব্যবহার ঘটবে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হবে। সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন লিথিয়াম অস্ত্র বা আর্মস সাধারণ মানুষের হাতে দেয়া উচিত নয়, তেমনি শকগানও যেন সাধারণের হাতে না পৌঁছায় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রতিদিন নতুন ধরনের অপরাধ বাড়ছে, সেখানে শকগানের সহজলভ্যতা অপরাধ প্রবণতাকে আরও উৎসাহিত করবে।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান
বিষয়টি নিয়ে ডিএমপি উপ পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন উইং) তালেবুর রহমান বলেন, “বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। কেউ অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

প্রয়োজন দ্রুত পদক্ষেপ
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই প্রয়োজন কঠোর নজরদারি ও অভিযানের মাধ্যমে এসব অবৈধ শকগান বিক্রি বন্ধ করা। এর পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালানো জরুরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেসবুক পেজ ও গ্রুপগুলো শনাক্ত করে বন্ধ করে দিতে পারে।

আত্মরক্ষার নামে বাজারে আসা এই প্রাণঘাতী অস্ত্র আজ কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য নয় বরং সামাজিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে, যাতে শকগান নামের এই নতুন আতঙ্ক অপরাধীদের হাতে ‘সহজ অস্ত্র’ হয়ে না ওঠে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ