সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য না হলে সংস্কার হবে কোন পথে
অভূতপূর্ব এক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন রাষ্ট্রগঠনের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথমেই যেটা আলোচনায় এসেছিল দেশের শাসনব্যবস্থার পুনর্গঠন জরুরি। সরকারব্যবস্থা যেন এরকম না হতে পারে, যেন আবারও দেশে ফ্যাসিস্ট-স্বৈরাচারী ব্যবস্থা ফিরে না আসে- সেই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল, তা নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে কাজও করেছিল; কিন্তু সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছুতে পারছে না তার বিভিন্ন নজিরও আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজও গতকাল এই কথা বললেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম আবু সাঈদের শাহাদতবার্ষিকীতে (১৬ জুলাই) সবাই মিলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব; কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটা সম্ভব হবে তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। এ বিষয়ে আমাদের এখন খানিকটা শঙ্কাও রয়েছে।’
সোমবার (৩০ জুন) সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিন দফা আলোচনা করেও কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ ছাড়া বেশিরভাগ মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়েও এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।
সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করছে ঐকমত্য কমিশন। এই পর্বে মৌলিক সংস্কারের ২০টির মতো প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এখন পর্যন্ত সাত দিনে আলোচনা হয়েছে ৯টি বিষয়ে। ঐকমত্য হয়েছে মাত্র দুটি বিষয়ে। আর কিছু ক্ষেত্রে আংশিক ঐকমত্য হয়েছে। তবে কোনো বিষয় এখনো আলোচনার টেবিল থেকে বাদ দেয়া হয়নি।
সংস্কার কার্যক্রম শুরুর দিকে আমরা শুনেছিলাম সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মোটামুটি একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কারণ সংস্কারবিহীন নির্বাচন কেবল ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় হবে, রাষ্ট্রের শাসনপ্রণালি থেকে যাবে আগের মতোই; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সংস্কারের চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের দিকেই বেশি আগ্রহী। আর বর্তমানে দেশের যে আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্তর্বর্তী সরকারও যেন নির্বাচন দিয়ে সরে পড়তে পারলেই বাঁচে। সেরকম হলে সংস্কার কার্যক্রম সত্যিই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। নির্বাচনের পর যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে তারা সংস্কার কতটুকু করবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
কিন্তু সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কেন ঐকমত্যে পৌঁছুতে পারছে না? এর কারণ অনেক, সংস্কার প্রস্তাব অনেক রাজনৈতিক দলের মতাদর্শিক স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যার কারণে দেখা গেছে সভা-সমিতি-মিছিল করে সংস্কার কমিশনের বাতিলেরও আন্দোলন চলেছে। মৌলিক সংস্কারের জায়গায় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ এত দূরবর্তী যে ঐকমত্যের প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর রয়েছে সংশয়।
জনগণ চায় রাজনৈতিক দলগুলো যেন একটা ঐকমত্যে পৌঁছায়। জনগণ এত দিন যাদের প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে ভয়ংকরভাবে নির্যাতিত হয়েছে, কার্যত ক্ষেত্রে তারা যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারে অনাগ্রহী দেখে তখন জনগণ যথেষ্ট পরিমাণ আশাহত হয়; কিন্তু সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য না হলে সংস্কার হবে কোন পথে? আর সংস্কার না হলে এত বড় গণঅভ্যুত্থানের কী অর্থ থাকবে সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে