Views Bangladesh Logo

কেমন ছিল পৃথিবীর প্রাচীন আইনসংহিতা ‘উরুকাগিনার আইন’?

Chandan  Chowdhury

চন্দন চৌধুরী

প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার লাগাশ রাজ্যে, ক্ষমতার দম্ভ যখন গরিবের শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিচ্ছিল তখন উরুকাগিনা নামে এক স্বপ্নদর্শী রাজা আবির্ভূত হলেন। তিনি শুধু রাজা ছিলেন না, ছিলেন এক বিপ্লবী, যিনি প্রথমবার মানব ইতিহাসে জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য একটি আইনিব্যবস্থা প্রণয়নের সাহস করেছিলেন। তার এই সংস্কার যা ইতিহাসে ‘উরুকাগিনার আইন’ নামে পরিচিত, এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল যেখানে নিপীড়িত মানুষ প্রথমবার মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ অব্দের দিকে মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় শহর-রাজ্য লাগাশ তখন দুর্নীতির চোরাবালিতে নিমজ্জিত। রাজা লুগালান্দার শাসনামলে পুরোহিত ও উচ্চবিত্তরা সাধারণ মানুষের সম্পদ নির্বিচারে লুট করত। দরিদ্ররা তাদের জমি ও সম্পত্তি হারাচ্ছিল, বিধবা ও এতিমরা ছিল অসহায়। সমাজের প্রতিটি স্তরে ছিল শুধু শোষণ আর বঞ্চনা। এই দুঃসময়ে লাগাশের সিংহাসনে আরোহণ করলেন উরুকাগিনা। তিনি নিজেকে কেবল ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হিসেবে নয়, বরং দেবতাদের দ্বারা জনগণের মুক্তির দূত হিসেবে দাবি করলেন। তার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ছিল দুর্নীতি দমন করে সমাজে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।

মুক্তির সনদ: প্রথম আইনসংহিতা
উরুকাগিনার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তার সংস্কারমূলক আইন। যদিও এই আইনের মূল পাঠ্যটি আজও সম্পূর্ণরূপে আবিষ্কৃত হয়নি তবে বিভিন্ন শিলালিপি থেকে এর কিছু অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই আইনগুলো কেবল ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকানোর জন্য ছিল না বরং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার এক সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা ছিল।

আইনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক
বিধবা ও এতিমের সুরক্ষা: উরুকাগিনা বিধবা ও এতিমদের কর থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। এটি ছিল একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ যা দুর্বলদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করেছিল।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচ: রাজা ঘোষণা করেন, কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সব খরচ রাষ্ট্র বহন করবে। এর মধ্যে ছিল খাবার, পানীয় এবং অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানের খরচ। এটি নিশ্চিত করেছিল যে, দরিদ্র পরিবারগুলোও তাদের স্বজনদের সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাতে পারবে।

জমি ও সম্পত্তি রক্ষা: এই আইন ধনী ও পুরোহিতদের জমি জোরপূর্বক দখল করা থেকে বিরত রেখেছিল। উরুকাগিনা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনো ধনী ব্যক্তি দরিদ্রদের কাছ থেকে জোর করে কিছু কিনতে পারবে না। যদি গরিব মানুষ বিক্রি করতে না চায় তবে তাদের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করা যাবে না।

ঋণের জাল থেকে মুক্তি: উচ্চ সুদের হার ছিল সে সময়ের একটি বড় সমস্যা। উরুকাগিনার আইন এই শোষণমূলক প্রথা রোধ করে মানুষকে ঋণের জাল থেকে মুক্তি দেয়।

‘আমাই-গি’ স্বাধীনতার প্রথম শব্দ: উরুকাগিনার আইনসংহিতায় ‘আমাই-গি’ (ama-gi) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল, যার অর্থ স্বাধীনতা। এটি মানব ইতিহাসে লিখিতভাবে স্বাধীনতার ধারণার প্রথম ব্যবহার। উরুকাগিনা তার শিলালিপিতে গর্বের সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘বিধবা ও এতিম আর শক্তিশালী মানুষের দয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকবে না।’

ক্ষমতার লড়াই এবং পরাজয়
উরুকাগিনার রাজত্বকালে শুধু সংস্কারই নয়, ছিল যুদ্ধের দামামা। তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উরুকের রাজা লুগাল-জাগেসি। উরুক ছিল লাগাশের প্রতিবেশী শহর-রাজ্য। লুগাল-জাগেসি উম্মা অঞ্চলের শাসকও ছিলেন। এই দুই রাজার মধ্যে লাগাশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দখল নিয়ে তীব্র সংঘাত দেখা দেয়।

উরুকাগিনার রাজত্বের সপ্তম বছরে লুগাল-জাগেসি লাগাশ আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে উরুকাগিনা পরাজিত হন এবং লাগাশের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেন লুগাল-জাগেসি। লাগাশের এই ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে একটি শোকগাথা রচিত হয়েছিল যা সম্ভবত মানব ইতিহাসের প্রথম শোকগাথার উদাহরণ। এতে লেখা ছিল, ‘উম্মার লোকেরা... নিনগিরসু দেবতার বিরুদ্ধে পাপ করেছে।... উরুকাগিনা, গিরসুর রাজা, কোনো অপরাধ করেননি; কিন্তু লুগাল-জাগেসি, উম্মার শাসক, তার দেবী নিসাবা তাকে তার পাপের বোঝা বহন করাক।’

লুগাল-জাগেসি সুমেরের প্রায় পুরোটা জয় করে প্রথম সুমেরীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও, তার রাজত্ব ছিল স্বল্পস্থায়ী। এরপর আক্কাদের রাজা সারগন তাকে পরাজিত করেন এবং তার সাম্রাজ্য দখল করে নেন।

নারীদের ভূমিকা এবং বিতর্ক
উরুকাগিনার সংস্কারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল রাজপরিবারের নারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি। তিনি রাজকীয় ‘নারীদের গৃহ’ (Household of Women)-কে বড় করে প্রায় ১,৫০০ সদস্যের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। তিনি এর নাম দেন ‘দেবী বাউয়ের গৃহ’ (Household of goddess Bau)। পুরোহিতদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা বিশাল জমি এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে আনা হয় এবং উরুকাগিনার স্ত্রী শাসার (বা শাগশাগ) তত্ত্বাবধানে রাখা হয়।

তবে তার কিছু আইন আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিতর্কিত। যেমন, তিনি নারীদের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করেন এবং এর শাস্তি হিসেবে পাথর ছুড়ে মারার বিধান রাখেন। আরেকটি খণ্ডিত শিলালিপিতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো নারী কোনো পুরুষকে [পাঠ্য অস্পষ্ট] বলে, তবে তার মুখ পোড়া ইট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হবে।’ পুরুষদের জন্য অনুরূপ কোনো আইন পাওয়া যায়নি যা কিছু আধুনিক ঐতিহাসিককে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে যে, এই আইনগুলো নারীদের অবমাননার প্রথম লিখিত প্রমাণ।

উরুকাগিনার উত্তরাধিকার
উরুকাগিনার আইন মানবজাতির ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এটি প্রথম প্রমাণ করে যে, সরকার কেবল শাসন করার জন্য নয়, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যও গঠিত হতে পারে। তার এই প্রয়াস আধুনিক সমাজ ও আইনিব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, একজন শাসক শুধু ক্ষমতা ভোগ করার জন্য নয়, বরং শোষিত ও বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যও থাকতে পারেন। যদিও তার রাজত্ব স্বল্পস্থায়ী ছিল এবং তিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন; কিন্তু তার আইন ও আদর্শ আজও অম্লান। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে, সত্যিকারের শক্তি অস্ত্রের মধ্যে নয়, বরং ন্যায় ও সাম্যের মধ্যে নিহিত। এখানে উরুকাগিনার কিছু অতিরিক্ত আইনের বিবরণ দেওয়া হলো যা তার সংস্কারের অংশ ছিল:

সাধারণ মানুষের সুরক্ষা
ঋণ থেকে মুক্তি: উরুকাগিনা তার শিলালিপিতে ঘোষণা করেছিলেন যে, জনগণের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত কর এবং ঋণের বোঝা হ্রাস করা হবে। তিনি সুদখোর মহাজনদের প্রভাব সীমিত করেছিলেন যাতে সাধারণ মানুষ ঋণের জালে আটকা না পড়েন।

জবরদখল রোধ: পুরোহিত এবং উচ্চবিত্তরা গরিব কৃষকদের জমি জোর করে দখল করতেন। উরুকাগিনার আইন এই প্রথা বন্ধ করে দেয়। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘যখন ভালো গাধা কেনা হয়, তখন পুরোহিত আর তার ওপর চাপ দেবে না যে, ‘আমি তোমাকে এটি দেব’, বরং একজন ধনী ব্যক্তি তার চুক্তি অনুযায়ী রুপার মাধ্যমে অর্থ প্রদান করবে।’ এর মাধ্যমে তিনি বাজারের ন্যায্য মূল্য এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন।

সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার
মন্দিরের সম্পত্তি: উরুকাগিনা মন্দিরের সম্পত্তি এবং পবিত্র স্থানগুলো পুরোহিতদের ব্যক্তিগত ভোগ-দখল থেকে মুক্ত করে সেগুলোকে জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করার বিধান করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘পুরোহিতের ঘর আর বাগান মন্দিরের সম্পত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’ এই পদক্ষেপ মন্দিরের সম্পদের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নিয়ম: মৃতদেহকে সমাধিস্থ করার জন্য যে সব আচার-অনুষ্ঠান ও খরচ নির্ধারিত ছিল উরুকাগিনা তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। যেমন একজন মৃত ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করার জন্য তিন কলস বিয়ার এবং ৮০টি রুটি দেওয়া হবে। কবরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা একটি শয্যা এবং একটি ছাগল পাবে। পাশাপাশি, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পুরোহিত ও সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য রুটি ও বিয়ারের পরিমাণও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল যাতে কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু দাবি করতে না পারেন।

অপরাধ ও বিচার
চুরি ও হত্যা: যদিও উরুকাগিনার আইনের বেশিরভাগই সামাজিক সংস্কারের ওপর কেন্দ্র করে ছিল, তবুও এতে চুরি, হত্যা এবং মানুষের সম্পত্তি জবরদখল করার মতো অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের উল্লেখ ছিল। শিলালিপিতে বলা হয়েছে, এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে যা সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

উরুকাগিনার এই আইনগুলো শুধু একটি আইনি কাঠামোই তৈরি করেনি বরং একটি নতুন সামাজিক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছিল। তার লক্ষ্য ছিল একটি এমন সমাজ গঠন করা যেখানে সবাই সমান অধিকার এবং নিরাপত্তা ভোগ করবে এবং এই কারণেই তাকে মানব ইতিহাসের প্রথম সংস্কারকদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়।

চন্দন চৌধুরী: কবি ও সাংবাদিক




মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ