Views Bangladesh Logo

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হলো

মাদের দেশের ইতিহাসে প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন ও সামাজিক পরিবর্তনের মূল ভিত্তি ছিল সাম্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানও ছিল সেই ধারাবাহিকতার অংশ, যেখানে তরুণ প্রজন্ম রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি ন্যায্য সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়ে গেছে। বৈষম্যের এ দুষ্টচক্র ভাঙতে গেলে গণ-আন্দোলনের পাশাপাশি প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তন।

দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, অসম উন্নয়ন এবং রাজস্ব বণ্টনের অসংগতি বৈষম্যকে আরও তীব্র করেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে সাধারণ জনগণ কাঙ্ক্ষিত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ বাস্তবতায় এক নতুন অর্থনৈতিক রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা আজ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি বিতর্ক আমাদের চিন্তাধারাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয় বনাম নির্বাচনে দেরি হলে সংস্কার নয়- এই বিতর্কে রাজনৈতিক মহল এতটাই জড়িয়ে পড়েছে যে, জরুরি বিষয়গুলো থেকে তাদের নজর সরে যাচ্ছে।

উভয়পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে বিতর্ক এখন আরও তীব্র হয়ে উঠছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের দুটোই প্রয়োজন এবং ২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যেই তা অর্জন করা সম্ভব। জনগণ চায় সংস্কারের এই সুবর্ণ সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। তবে দেশের মানুষ বর্তমান পরিস্থিতির জটিলতা সম্পর্কেও সচেতন এবং তাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও আইনি পরিবেশ। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাপক দুর্নীতি ও অপশাসনের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি জনরোষ সৃষ্টি করেছিল তার কারসাজিমূলক নির্বাচনগুলো।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাত্রদের জনপ্রিয়তা ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগে কিছুটা অপেক্ষা করতে রাজি আছে; কিন্তু সেই অপেক্ষারও সীমা আছে। নির্বাচন কেবল সরকারই গঠন করে না, বরং ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিও নিশ্চিত করে। আমাদের শাসন ব্যবস্থায় সম্ভবত সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অবমূল্যায়িত শব্দ হচ্ছে জবাবদিহি। রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই একমাত্র কার্যকর উপায়। বলা যায়, অতীতে এটিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়নি। তবে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতের পরিস্থিতি হবে ভিন্ন। অন্তর্বর্তী সরকার সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কার কমিশন গঠন করায় প্রশংসার দাবি রাখে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও বিগত সময়ের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিচার প্রক্রিয়া চলমান। এই চলমান প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরকারের সংস্কার নিয়ে একটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা সাজানো প্রয়োজন। এর মধ্যে দেখতে হবে কোন কোন সংস্কার অতি জরুরি এবং নির্বাচনের আগেই তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সেসব সংস্কারকে চিহ্নিত করতে হবে। কেননা ন্যূনতম সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় গেলে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন হিসেবে থেকে যাবে। সংস্কার নিয়ে ইতোমধ্যেই জনমনে এক ধরনের হতাশা বিদ্যমান। এটি দূর করার জন্য সরকারকে দৃশ্যমান কিছু পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। নির্বাচন-পূর্ব সংস্কারগুলো চিহ্নিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো এবং অংশীজনদের সঙ্গে অতিদ্রুত সংলাপে বসা এখনকার প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। এখানে মৌলিক কিছু সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

সেটা যদি করা না হয়, তাহলে নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত তারিখ ঠিক রাখাও কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সেটি হলে দেশ আবারও রাজনৈতিকভাবে একটি সংকটের মুখে পড়বে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে সংস্কার এবং নির্বাচন প্রশ্নে একটি সৌহার্দ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও একটি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সংস্কার প্রসঙ্গে জুলাই সনদ, সংবিধান, ইলেকশন কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা, সংসদীয় ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দলের মধ্যকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থাসহ আরও যে বিষয়গুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারে সেগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। যাতে করে নির্বাচনের আগে অন্তত কিছু জরুরি ও ন্যূনতম সংস্কারের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা যায়।

নির্বাচন-পূর্ব সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে যা চলমান এবং নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে সংস্কারের বাকি প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন করা। এ জায়গায় অবশ্য অনেকের দ্বিধা থাকতে পারে, আদৌ কি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সংস্কার চলমান থাকবে? রাজনৈতিক দলগুলো বারবারই বলছে যে, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেও অনেক সংস্কার করা সম্ভব এবং তারা সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যথেষ্ট আগ্রহী। রাজনৈতিক দলগুলোকে কীভাবে এই প্রতিশ্রুতির বিষয়ে একটি জবাবদিহির আওতায় আনা যায় সে বিষয় নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। এর সঙ্গে একমত হওয়া সংস্কারগুলো যেন দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হয়, সে বিষয়টিও মাথায় রাখা প্রয়োজন। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেন তারা জনগণের কাছে কেবল প্রতিশ্রুতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ না করে বরং তারা যেন সেটি বাস্তবায়ন করতে পারে।

একটি গ্রহণযোগ্য জুলাই সনদের মাধ্যমে এর শুরু হতে পারে। আমরা দেখছি যে জুলাই সনদের আলোচনা চলমান এবং ঐকমত্য কমিশন সেটি নিয়েও কাজ করছে। জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন-পরবর্তী সংস্কার বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা তৈরি করা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের নির্বাচনের ইশতেহারে সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোকে তাদের প্রস্তাবিত নিজ নিজ কার্যাবলির সঙ্গে সমন্বয় করার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে আসতে পারে তাহলে তাদের ওপর জনগণের আস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে। কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত হওয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা রাজনৈতিক দলগুলোর যে রয়েছে তা দৃশ্যমান। যে কারণে নির্বাচন-পরবর্তী সংস্কারের একটি বিস্তারিত দিকনির্দেশনা ও রূপরেখা তৈরি করে জনসাধারণের সম্মুখে উত্থাপন করা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও একটি ইতিবাচক বিষয় হবে।

পাশাপাশি এটি নির্বাচিত সরকারের জন্য জনগণের প্রত্যাশা পূরণের একটি প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের দলিল হিসেবেও থেকে যাবে। সেটি করা গেলে সংস্কারবিষয়ক সেই প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারকে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার চাইলে খুব সহজেই উপেক্ষা করতে পারবে না। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোরও ইতিবাচকভাবে দেশের স্বার্থে একমত হতে হবে এবং এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। একে অপরকে দোষারোপ করা ও সহিংসতার যে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক চর্চা আমাদের রয়েছে তা থেকে বের হয়ে আসার এখনই সময়। জনগণকে স্বস্তিময় একটি ভবিষ্যৎ উপহার দেয়ার মাধ্যমে তারাও একটি ইতিবাচক ও গণবান্ধব এবং স্থায়ী রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ ও জনপ্রিয় দল হিসেবে বিএনপি সেই নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে সব সময় মনে রাখতে হবে, যৌক্তিক ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত সংস্কার বিষয়ে যেন রাজনীতি কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায় এবং সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করে যেতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো দেশ পুনর্গঠনের যে ঐতিহাসিক সময়ের দ্বারপ্রান্তে, সেই সুযোগ তারা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে দেশ, জনগণ ও তারাই লাভবান হবে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় জনগণের স্বার্থে কাজ করার কথা বলে থাকে; কিন্তু দিন শেষে তাদের স্বার্থ অনেকাংশেই উপেক্ষিত থেকে যায়।

জনগণ যেন এবার উপেক্ষিত থেকে না যায় সেই বিষয়গুলোও আমাদের সংস্কার প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের স্বার্থকে সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সত্যিকার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তাই সবাইকে ছাড় দেয়ার মনমানসিকতার মধ্য দিয়ে দেশের স্বার্থে সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও নির্বাচন নিয়ে ঐক্যে পৌঁছানো প্রয়োজন। যদিও বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচিত সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থার অভাব ঐতিহাসিক হলেও এবারের বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোকে সেই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যেন তারা যৌক্তিক, প্রয়োজনীয় ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ ইতিবাচক পদক্ষেপ হাতে নেয়।

দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে এদেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন। সব রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুরোধ থাকবে- আপনারা বিতর্কে না জড়িয়ে সংস্কার ও নির্বাচনের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিন। এতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা পাবে। পারস্পরিক বিভেদ ভুলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে তারা দ্রুত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সংস্কার ও নির্বাচন আয়োজনের এই দ্বৈত লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারে।

রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক। 

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ