সরকারি তেল আর কতকাল চুরি হবে
বাংলাদেশে সরকারি তেল চুরির ঘটনা সর্বজনবিদিত। বছরের পর বছর ধরে তেল চুরির ঘটনা ঘটলেও সরকারের টনক নড়ে না। তেল চুরির ঘটনা মোটামুটি নিয়মিতই ধরা পড়ে, তদন্ত কমিটিও হয়। তবে চুরি থামে না। এক সময় তেল চুরি হতো ডিপো থেকে, তেলবাহী গাড়ি থেকে; এখন তেল চুরি হয় জাহাজ থেকেও।
আজ সোমবার (২০ অক্টোবর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ডিপো থেকে চারটি ধাপে তেল সরবরাহ করা হয়। অধিকাংশই যায় নদীপথে, ছোট ছোট জাহাজে করে। প্রায় প্রতিটি জাহাজে নির্ধারিত সক্ষমতার চেয়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার লিটার তেল বাড়তি নেওয়ার গোপন জায়গা থাকে। ট্রেনের ওয়াগনে তেল পরিবহনের ক্ষেত্রেও বাড়তি তেল দেওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রতিটি ট্যাংক লরিতে ১৫০ থেকে ২০০ লিটার তেল বাড়তি দিয়ে দেন চক্রের সদস্যরা। এমনকি ড্রামে তেল ভর্তির সময়ও ১৫ থেকে ২০ লিটার বাড়তি দিয়ে দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর জাহাজ থেকে তেল চুরি করে পটিয়া, শান্তিরহাট, মইজ্জারটেক, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জসহ স্থানীয় পাইকারি ও খুচরা বাজারে পাচার করা হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীতে সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় তেল চুরি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তেল চুরির বড় দুটি জায়গা হলো চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় তিন তেল কোম্পানির মূল ডিপো এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও গোদনাইলের ডিপো। এ দুটি জায়গায় নজরদারি নিশ্চিত করতে পারলেই চুরি অনেকাংশে কমে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তেল চুরির ঘটনা ধরা পড়ার পরও, তদন্ত হওয়ার পরও কীভাবে বছরের পর বছর চুরি অব্যাহত থাকে? জানা যায়, পুরো চক্র শনাক্ত না হওয়ায় চুরি থামছে না। তা ছাড়া পাঁচ বছর আগের এখনো বিচারাধীন।
জ্বালানি তেল আমদানি ও উৎপাদনের কাজটি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বাজারে সেই তেল বিক্রি করে বিপিসির আওতাধীন তিন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। তেল চুরির পেছনে তিনটি কোম্পানির কর্মীদেরই নানা কারসাজি রয়েছে। এই কারসাজির মধ্যে রয়েছে তেল পরিমাপ থেকে শুরু করে তাপমাত্রা সংরক্ষণ পর্যন্ত। তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে যে তেলের পরিমাণ বাড়ে-কমে এই বৈজ্ঞানিক সূত্র পর্যন্ত চোরদের জানা। এ ছাড়া ডিপোতে তেলে ভেজাল মিশিয়ে পরিমাণে বাড়ানোর ঘটনাও ঘটে। এর পেছনে এমন বিশাল চক্র জড়িত যে কান টানতে গেলে মাথা চলে আসে। ফলে চুরি ধরা পড়লেও, তদন্ত হলেও তার কোনো সুরহা করতে পারে না বিপিসি।
পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার তেল ডিপোতে দুর্নীতি ও কর্ণফুলী নদীতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল চুরি বন্ধে কিছু নির্দেশনা দিয়ে গত ২৮ আগস্ট তিন কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে বিপিসি। তেল পরিমাপ বিষয়ে সেখানে সনাতন পদ্ধতির বদলে কিছু আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বনের সুপারিশ দেয়া হয়। কিছু সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নে গত ২৯ সেপ্টেম্বর তিন কোম্পানিকে আবার চিঠি দিয়েছে বিপিসি। এতে বলা হয়, ট্যাংক লরির হালনাগাদ সক্ষমতা প্রতিবেদন দেখে তেল দিতে হবে। ভেজাল রোধে আধুনিক ল্যাব স্থাপন করতে হবে।
অবৈধ উৎস থেকে তেল সংগ্রহ ও বিক্রি বন্ধে ডিপো থেকে ফিলিং স্টেশনের তেল নেওয়ার তথ্য নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। জ্বালানি তেলের অনিয়ম, ভেজাল ও চুরি বন্ধে চট্টগ্রামের প্রধান স্থাপনাসহ সব ডিপোর কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। সারা দেশে তিন কোম্পানি মিলে ৪৭টি ডিপো রয়েছে। সারা দেশে সব মিলে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার তেল চুরি হয় বলে জানা যায়। সুপারিশ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিপো কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের গত ১৫ বছরের সম্পদের হিসাব নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। পুরো তেল সরবরাহ কাঠামোকে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির আওতায় আনা গেলে নজরদারি ও চুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে।
এই তেল চুরির ঘটনায় অসাধু চক্র লাভবান হলেও তার ক্ষতির শিকার হয় সরকার তথা জনগণ। কারণ চুরির কারণে তেলের মূল্য বাড়াতে হয়। তাই যেভাবেই হোক অবিলম্বে তেল চুরির বন্ধ জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে তা অবশ্যই সম্ভব। আর তার জন্য প্রথমেই দরকার তেল চুরির মূল সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া। শুধু তেলবাহী গাড়ির চালক, বা জাহাজের শ্রমিকদের ধরে কোনো ফল হবে না। আইনি শক্তি, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা আর সরকারের সচেতনতার মধ্য দিয়েই তেল চুরির ঘটনা রোধ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কোনো শর্ত ছাড়াই সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে