Views Bangladesh Logo

আগুনে এই মর্মান্তিক মৃত্যু আর কত দিন?

বাংলাদেশে গুদাম-কারখানায় মানুষ পুড়ে মারা যাওয়া এখন মামুলি ব্যাপার। শত শত মানুষের প্রাণহানি আমাদের মনে আর দাগ কাটে না! আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার পর সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো যখন কিছু ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে, আমরা শান্তিতে ঘুমাতে যাই। যাক একটা উপায় হলো। কিন্তু আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া থেকে মানুষকে মুক্তির স্থায়ী কোনো সমাধান বের করতে সব সরকারই মোটামুটি সব সময়ই অবহেলার পরিচয় দিয়েছে।

গত মঙ্গলবার ঢাকার মিরপুরে একটি পোশাক কারখানায় আগুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখনো অনেকের খোঁজ মেলেনি। আহত অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২৫ হাজার থেকে ২৭ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ২ হাজার মানুষ মারা গেছে।

এসব দুর্ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার ওপর। কোনো মানুষের মৃত্যু অর্থমূল্যে পরিমাপ করা যায় না। এত মৃত্যুর পরও সরকার কেন সচেতন হয় না, তা আমরা জানি না। বিশেষ করে আবাসিক এলাকায় কেন এখনো পোশাক কারখানা স্থাপন ও রাসায়নিক গুদাম স্থাপন হয়, তা নিয়ে অনেক দিন ধরে প্রচুর সমালোচনা করা হলেও তাও কেন এখনো বন্ধ হয়নি তা নিয়ে সরকারকে স্পষ্ট জবাবদিহি করতে হবে।

বাংলাদেশে বেশির ভাগ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে শটসার্কিট থেকে, আর কারখানাগুলোতে অগ্নি দুর্ঘটনার মূল কারণ রাসায়নিক গুদামের আগুন লাগার কারণে। এই গত সেপ্টেম্বর মাসেই গাজীপুরের টঙ্গীতে রাসায়নিক গুদামে আগুনে পুড়ে একজন মারা গিয়েছিলেন। সে ঘট্নাটা সংবাদমাধ্যমে খবরে এলেও জনমনে তেমন রেখাপাত করেনি। এবার যে ১৬ জন মারা গেল, তা নিয়েও খুব আলোচনা হয়নি।

একজন, দুজন, বা এক ডজন, দুডজন মানুষের দুর্ঘটনায় মৃত্যু বোধহয় বাংলাদেশে কোনো ঘটনা না। তাজরীন ফ্যাশনস কারখানা, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের মতো শতাধিক মৃত্যু হলে কিছুটা জনক্ষোভ প্রকাশ পায়। তারপর আগুন নিভতে নিভতেই জনমনের আগুন নিভে যায়। তারপর অগ্নিদুর্ঘটনায় আরও বড় ধরনের হতাহত না হলে সেই আলোচনা থেমে যায়। জনগণও যেমন ভুলে যায়, সরকারও ভুলে যায়। গত বছর বেইলি রোডের একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জন মানুষ মারা গেলে শেষবার এ নিয়ে নাগরিক সমাজে একটু হৈচৈ হয়েছিল। তার কারণ সে সময় মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সমাজের কিছু মানুষ মারা গিয়েছিল।

এবার মিরপুরের গুদাম-কারখানায় শ্রমিকশ্রেণির মানুষ মারা যাওয়ার কারণেই হয়তো হৈচৈ কম। আমাদের শ্রেণিবৈষম্য এখনো কত প্রবল এ দিয়েও বোঝা যায়। কোথাও আগুন লেগে মানুষ মারা গেলে প্রতিবারই প্রশাসন বলে, ‘দোষীদের চিহ্নিত করা হবে।’ কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ কমে যায়, তদন্তের ফল ধুলোমাখা ফাইলে চাপা পড়ে। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, বিল্ডিং কোড, রাসায়নিক গুদাম সরানোর উদ্যোগ- সবই কাগজে আছে, বাস্তবে নেই।

ব্যবসায়ীদের লোভ, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, আর নাগরিকদের নিরাপত্তা-অবজ্ঞা মিলিয়ে আমরা তৈরি করেছি এক আগুনেপোড়া সমাজ। এই বাস্তবতা বদলাতে হলে দরকার কঠিন আইনের প্রয়োগ। দায়িত্বহীন কর্মকর্তার শাস্তি, এবং নাগরিক সচেতনতা। শুধু দমকল বাহিনীকে দোষ দিয়ে দায় এড়ানো চলবে না; বিল্ডিং অনুমোদন, রাসায়নিক ব্যবসার লাইসেন্স, রেস্টুরেন্টের নিরাপত্তা- সব জায়গায় দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।

আগুন লাগার ঘটনার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করে সরকার যদি কোনো সময়োপযোগী ব্যবস্থা না নেয়, এ ধরনের দুর্ঘট্না বাড়তেই থাকবে। তাই সরকারকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকারের কাছে একটাই প্রশ্ন, আগুনে পুড়ে আর কত মানুষ মরলে সরকারের হুঁশ হবে? সরকার কি এখনো এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে না।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ