বৈষম্য নিরসনে কতটা পথ পেরোল বাংলাদেশ?
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বয়স ইত্যাদির ভিত্তিতে কারও প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণকেই বৈষম্য বলে। বৈষম্যের সঙ্গে মঙ্গল বা অমঙ্গলের সম্পর্ক থাকা বাধ্যতামূলক নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টার কথা ও আচরণের মধ্যেও বৈপরীত্যের বৈষম্য রয়েছে; এই বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় ক্ষমতা গ্রহণের আগে-পরের কথায়।
বাংলাদেশে ২৬ লাখ ভারতীয় লোকের চাকরি নিয়ে তার বক্তব্যের বৈষম্যের কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তার কথার বৈপরীত্য অসংখ্য। ২১ আগস্টে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে ক্ষমতা গ্রহণের আগে আইন উপদেষ্টার সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল, এই হামলার সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় মহল জড়িত ছিল বলেই এই ঘটনাকে তারা জঘন্যভাবে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছে। আর আইন উপদেষ্টার এখন কী মত, তা জানতে চাওয়ার হিম্মত কারও আছে বলে মনে হয় না।
বাছ-বিচার না করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা হলে আইন উপদেষ্টার সাফ জবাব, ‘স্বৈরাচার’ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে কেউ মামলা করলে সরকার সেখানে বাধা দিতে পারে না এবং অভিযুক্তদের অপরাধের সত্যাসত্য নির্ধারিত হবে শুধু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আইনের কথা। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের কোটা ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে রিট করেছিলেন কয়েকজন সংক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার দায়ের করা মামলার দায় নিশ্চয়ই আইন উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের ছিল না। তাহলে আসিফ নজরুল তখন আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের করা মামলার দায় আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন কেন। কেন তিনি তখন বলেননি যে, মুক্তিযোদ্ধাদের মামলা করার নাগরিক অধিকার রয়েছে, ওই মামলায় বাধা দেয়ার ক্ষমতা তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ছিল না, মুক্তিযোদ্ধাদের মামলা শুধু আইনি প্রক্রিয়ার নিষ্পন্ন হতে পারে। বুদ্ধিজীবী আসিফ নজরুল এবং আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের মধ্যে এমন অসংখ্য বৈপরীত্য দেখা যায়।
ত্রিশ বছরের অধিক বয়সীরা চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবে না এই বৈষম্য নিরসনের চেষ্টা গণঅভ্যুত্থানের পর করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কারণ উন্নত দেশগুলোতে একটি নির্ধারিত বয়সের পর যে কোনো বয়সে চাকরি করা যায়, আমাদের দেশের মতো ৩০ বছরের পর চাকরির আবেদন করা যাবে না, এমন নিয়ম নেই। অন্যদিকে আমাদের দেশে ৫৯ বছরের অধিক হলে চাকরির ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত বিবেচিত হয় এবং ৬৫ বছর হলে চুক্তিভিত্তিক চাকরিও করা যায় না। এমন আইন বৈষম্যমূলক বলেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মহাম্মদ ইউনূস আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। মামলায় তিনি হেরে যান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পঁয়ষট্টি ঊর্ধ্ব বয়সের গভর্নর ফজলে কবিরের চাকরির অপরিহার্যতা বিবেচনায় আওয়ামী লীগ সরকার আইন পরিবর্তন করেছিল; কিন্তু ড. ইউনূসের বেলায় ছিল উদাসীন। তাই বোধ হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় বসেই পঁয়ষট্টি ঊর্ধ্ব বহু লোককে ডেকে এনে চাকরি দিয়েছেন। বৈষম্য আরও আছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিচারপতি প্রমুখের অবসরের বয়সসীমা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি; কিন্তু কেন? তাদের বর্ধিত বয়সের অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য অপরিহার্য বিবেচিত হলে স্কুল-কলেজের শিক্ষক বা আমলাদের অভিজ্ঞতা কেন গুরুত্বহীন?
কোটাবিরোধী আন্দোলন কখন যে হঠাৎ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত হলো তা প্রবীণ আইনজ্ঞ জেড আই খান পান্নাও খেয়াল করেননি; কিন্তু এই নামকরণ সঠিক বলে মনে হয় না। জাতে তোলার জন্য মহাত্মা গান্ধী মেথরদের নাম দিয়েছিলেন ‘হরিজন’, হরি মানে কৃষ্ণ, অর্থাৎ কৃষ্ণের জন। ‘ভগবানের আপনজন’ আখ্যা দিয়েও তিনি তাদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। কোটা না থাকায় ভারতের সংবিধান প্রণেতা ভীমরাও রামজি আম্বেদকর তার স্কুলজীবনে তার সতীর্থদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে ক্লাস করার সুযোগ পাননি।
অস্পৃশ্য, দলিত সম্প্রদায়ের ছেলে বিধায় পিপাসা লাগলে ওপর থেকে পিয়ন পানি ঢেলে দিত, পানির পাত্র স্পর্শ করাও ছিল মহাপাপ। ভারতে এই বৈষম্য এখনো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যারা আদিবাসী হিসেবে পরিচিত এবং সমগ্র দেশের নারী জাতি এখনো সমাজে অবহেলিত ও বঞ্চিত, যতটুকু এগিয়েছে, তা কোটার বদৌলতেই। বৈষম্য দূর করার জন্যই কোটার দরকার; তাই স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ কোটার প্রবর্তন করেছিল। একই কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত কমিটিও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছেলেদের জন্য ৩৫ এবং মেয়েদের জন্য ৩৭ নির্ধারণ করেছিল; কমিটির এই বৈষম্যমূলক সুপারিশ অবশ্য শেষ পর্যন্ত টিকেনি। তবে তাদের সুপারিশ থেকে প্রতীয়মান হয়, আমাদের সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে।
ড. মহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর শোনা গিয়েছিল আমেরিকা বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা ফেরত দেবে; কিন্তু ফেরত দিয়েছে বলে আর শোনা গেল না। দেখুন, পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে একটু বেশি সুবিধা লাভের স্বার্থে বাংলাদেশের জিএসপির কোটা লাগে; কিন্তু অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও অবহেলিত নারীর কোটা থাকলে তা বাতিলের আন্দোলন হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত লোকদের অগ্রাধিকার দেয়ার রীতি পৃথিবীর সব দেশ অনুসরণ করে থাকে; এই অগ্রাধিকার না থাকলে বৈষম্যের ফারাক আরও গভীর ও ব্যাপক হতো। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের সবাইকে এক পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন; কিন্তু বৈষম্য দূর না হলে প্রধান উপদেষ্টার ‘এক পরিবার’ গড়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যাবে।
আয়-ব্যয়ের পাহাড়সম বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। ফুটপাতে পলিথিনের ঘর বানিয়ে যারা সংসার পাতে তাদের অনেকে দেহ বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করে থাকে; আর যাদের দেহ আকর্ষণীয় নয় তারা ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে। ধনধান্যে যারা প্রভাবশালী তাদের নির্যাতনে এই সমাজে দেহ বিক্রি করে খাওয়ারও উপায় নেই। আওয়ামী লীগের নেতা শামীম ওসমানের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থেকে পতিতাদের উচ্ছেদ করা হলো, এই উচ্ছেদ অভিযানে সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এক হয়ে গেল, উচ্ছেদের পর কেউ তাদের ডেকে নিয়ে একবেলা খাবারও দেয়নি। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও তাদের লাঠি দিয়ে পেটানোর করুণ দৃশ্য মানুষ দেখেছে।
বিগত কয়েকদিন ধরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তার কুকুরগুলো আমাদের বাড়ির সিঁড়িতে আশ্রয় নিতে এলে ভাড়াটিয়ারা পিটিয়ে তাড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাত খাইয়ে তোফাজ্জলকে যেভাবে পিটিয়ে মেরেছে, এমন নৃশংস হত্যা দেখতে দেখতে বাংলাদেশ মানুষ মানুষিক রোগী হয়ে গেছে। মানুষ পিটিয়ে মারার ক্ষেত্রে অনেকেই ইসরায়েলের নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহু যেমন রক্তপিপাসু, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের হত্যাকারীকে ঘৃণা করা উচিত। রং ভেদে কুকুরের প্রতি বৈষম্য আছে, কালো কুকুরের প্রতি কেউ কেউ বিরূপ। মানুষের শরীরের রং নিয়ে আছে চরম বৈষম্য। যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন, তাদের মনোভাব জানা নেই, তবে বেশিরভাগ বর ফর্সা মেয়ে পছন্দ করে থাকে।
সমাজতন্ত্রের উন্নতর স্তর সাম্যবাদে বৈষম্য দূরের একটা ব্যবস্থা ছিল, তাও ধ্বংস করে দিল গর্বাচেব আর আমেরিকা। বৈষম্য রয়েছে আমাদের সংবিধানে, ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধর্ম করে দেশের মূল আইনে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। এই বৈষম্য দূর করার ক্ষমতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই। আলেম-ওলামারা হাতের অসমান পাঁচটি আঙুল উঁচু করে তুলে ধরে সাম্যবাদের অসারতা প্রমাণ করতেন। বৈষম্য নিরসনে জাসদ পেশাভিত্তিক ৫০০ আসনের সংসদের দাবি করেছিল; মাহমুদুর রহমান মান্না ৫০০ আসনের মধ্যেও বৈষম্য আবিষ্কার করে জাসদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ পাশে বক্তৃতা দিয়ে পেশাভিত্তিক সংসদের অসারতা প্রমাণ করেছিলেন। তার মতে একজন স্থায়ী কুলি আরেকজন অস্থায়ী কুলিকে সহ্য করতে পারে না। স্থায়ী কুলি এবং অস্থায়ী কুলির মতো প্রতিটি বিভাজিত পেশার জন্য পৃথক প্রতিনিধির প্রয়োজন হলে সংসদে আসন লাগবে সহস্রাধিক। একই পেশার বিভাজিত শ্রেণির এই চিত্র প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যের চিত্র। এমন হাজারো বৈষম্য নিরসনে একমাত্র সমাধান হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘রিসেট বাটন’ টিপ দিয়ে ‘বৈষম্য’ শব্দটি অভিধান থাকে মুছে দেয়া, অথবা বৈষম্য নিরসনে পুনরায় কোটাপ্রথা চালু করা।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে