Views Bangladesh Logo

বাঙালির দুর্গাপূজা যেভাবে সামাজিক উৎসবে পরিণত হলো

বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম দুর্গাপূজা। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন অবধি পাঁচ দিন দুর্গোৎসব হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে এবার দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে ২৮ সেপ্টেম্বর। ২৯ সেপ্টেম্বর মহাসপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর মহাষ্টমী, ১ অক্টোবর মহানবমী এবং ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিনে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হবে।

দেবীর দুর্গার শুরু কোথায়? দেবীর ইতিহাস কী? সেই প্রাচীন যুগে দেবীর কনসেপ্টটা এলো কোথা থেকে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। এই উৎসবটি এখন বৈদিক ও লৌকিক নানা প্রথাপদ্ধতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। দুর্গাপূজার একেকটা রীতি নিয়ে রয়েছে হাজারটা ভাষ্য। বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থে একই দেবীর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা। আবার বাঙালি হিন্দুরা ধর্মগ্রন্থের বর্ণনার সঙ্গে নিজেদের কল্পনা মিশিয়ে একেকটা নতুন মিথ বা আচার সৃষ্টি করেছেন। কাজেই দুর্গাপূজা এবং এর বিভিন্ন আচার-নিয়ম পালন সম্পর্কে সর্বজনগ্রাহ্য কোনো মত প্রদান করা অসম্ভব। ‘নানা মুনির নানা মত’- কথাটা সম্ভবত সনাতন ধর্মের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য!

দেবী দুর্গার ঘটনা সবচেয়ে বিশদভাবে লেখা মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘দেবী-মাহাত্ম্যে’ (যাকে শ্রীশ্রী চণ্ডী বলা হয়)। অন্য সব পুরাণে দেবীকে পাওয়া যায় অন্যভাবে! তবে দুর্গা-এই নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দেবীমূর্তি। তার দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র, এক পা সিংহের পিঠে, এক পা অসুরের কাঁধে। তাকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক ঠাকুর। যারা পুরোনো দিনের রীতি মেনে মূর্তি বানান, তারা দুর্গা-বাহিনীর পেছনে চালচিত্রে আরও নানারকম ঠাকুরদেবতার ছবিও আঁকেন। আর যারা আধুনিক, তারা প্রতিমার মাথার ওপর একখানা ক্যালেন্ডারের শিবঠাকুর ঝুলিয়ে রাখেন। মোটামুটি এই মূর্তি বছরের পর বছর ধরে দেখে আমরা অভ্যস্ত।

বর্তমানে যে শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করা হয়, এই উৎসবকে অনেকে রামায়ণে বর্ণিত দুর্গাপূজার রূপ বলে মনে করেন। মা দুর্গার অকালবোধন এবং এর রামায়ণ যোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। অযোধ্যাপতি রাম ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। ১৪ বছর বনবাসকালে তার স্ত্রী সীতাকে দৈত্যরাজ রাবণ অপহরণ করেন। রাবণের কবল থেকে সীতাকে মুক্ত করার জন্য রাম দৈত্য রাজা বধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভগবান রামচন্দ্র রাবণের প্রাণনাশে সাফল্য অর্জনের জন্য দেবী দুর্গার কৃপা কামনা করেন ও সেজন্য তিনি আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। ঐতিহ্যগতভাবে দেবী দুর্গা বসন্ত ঋতুতে পূজিত হতেন; কিন্তু যুদ্ধের কারণে রামচন্দ্র শরৎ ঋতুতে দেবীর আশীর্বাদ লাভের জন্য প্রার্থনা করেন। যদিও শরৎকাল দেবদেবীদের ঘুমের সময় হিসেবেই খ্যাত। কারণ, এ সময় দিন ছোট ও রাত বড় হয় এবং রাত সাধারণত রাক্ষস জাতির পরিচায়ক বলে গণ্য করা হয়।

প্রথা অনুযায়ী দেবী দুর্গার অষ্টমীবিহিত সন্ধিপূজায় ১০৮টি নীল পদ্মের প্রয়োজন হয়। রামচন্দ্র ১০৮টি নীল পদ্মেরই ব্যবস্থা করেছিলেন; কিন্তু দেবী দুর্গা রামচন্দ্রকে পরীক্ষায় ফেলতে ছল করে ১টি পদ্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন। এ সময় নিরুপায় রামচন্দ্র ১০৮তম পদ্মস্বরূপ তার নিজের চোখ উপড়ে নিতে উদ্যত হন। রামের চোখকে নীল পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হতো। যাহোক, মা দুর্গা রামের একনিষ্ঠতা দেখে খুশি হয়ে স্বয়ং তার সামনে আবির্ভূত হন এবং রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের জন্য আশীর্বাদ করেন। মা দুর্গার এই অসময়ে আবাহন বাংলায় ‘অকালবোধন’ হিসেবে পরিচিত হয়। তারপর থেকেই শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা প্রচলিত হয়। শরৎকালীন এই দুর্গাপূজা সব বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বৃহদাকারে পালিত হয়। বসন্তকালীন দুর্গাপূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত যা ঐতিহ্যগতভাবে মূল দুর্গাপূজা হলেও শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপনের উন্মাদনায় তা প্রায় হারিয়ে গেছে।

আর্যরীতির সঙ্গে বাঙালির সৃজনশীলতা যুক্ত হয়ে দুর্গোৎসব বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। আনন্দময়ী দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গার আগমন বার্তায় বর্তমানে চরাচর আনন্দমুখর। আমরা দুর্গাপূজা বললেও আসলে এই পূজা মা দুর্গার একার নয়। সঙ্গে আরও অনেকেই আছেন। মা দুর্গা আসেন সবাইকে নিয়েই। ভালো-মন্দ, শত্রু-মিত্র, গাছ-প্রাণী সঙ্গে নিয়েই। চালচিত্রে শিব আছেন, তো পায়ের নিচে অসুর। কলাবউ, পেঁচা, হাঁস, ইঁদুর, ময়ূরও থাকে। হাসিকান্না, সুজন-দুর্জন, পশুপক্ষী-উদ্ভিদ সমাহারে আমাদের জীবনের পথ চলাটাকেই সহজ করে চিনিয়ে দিতে চান।

পৌরাণিক কাহিনি থেকে দুর্গাপূজার শুরু; কিন্তু ক্রমে দুর্গা যেন আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে উঠেছে। সাধারণ মেয়ে, তবে দাপুটে। এই দাপুটে মেয়ের কত নাম! এক অঙ্গে বহুরূপ। এক রূপে বহুনামে চিহ্নিত। শরৎঋতুতে আবাহন হয় বলে দেবীর আরেক নাম শারদীয়া। এ ছাড়া মহিষাসুরমর্দিণী, কাত্যায়নী, শিবানী, ভবানী, আদ্যাশক্তি, চণ্ডী , শতাক্ষী, দুর্গা, ঊমা, গৌরী, সতী, রুদ্রাণী, কল্যাণী, অম্বিকা, অদ্রিজা এমন কত নাম আছে দুর্গার। ঠিক নানি-দাদিরা যেমন আমাদের আদর করে একটা নামে ডাকে, মামাবাড়িতে আদিখ্যেতা করে অন্য নামে ডাকা হয়। আবার বাবার দেয়া একটা নাম, মায়ের দেয়া একটা নাম, স্কুলের জন্য একটা ভালো নাম। দেবী দুর্গারও তেমনই অনেক নাম। কারণ সে তো বাঙালিরই ঘরের মেয়ে!
আমরা যদি চণ্ডীর দেবী নির্মাণের ব্যাখ্যা ধরি, নানা শক্তি সমন্বয়ে আজকের ভাষায় তিনি একটি বিশেষ কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বানানো যন্ত্র, একজন নারীবেশী যুদ্ধাস্ত্র। অসুরের মধ্যে পুরুষের তথাকথিত নারীশরীরের লোভ সঞ্জাত করেছিলেন পৌরাণিকরা।

তাই দুর্গা নামের যুদ্ধাস্ত্রটি স্ত্রী রূপে শোভিত, এক পুরুষকে প্রলোভন দেখাবে বলেই। যদিও আমাদের ঘরের মেয়ে বা লৌকিক দুর্গার সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনির তেমন কোনো মিল নেই। লৌকিক দুর্গা যেহেতু ঘরের মেয়ে, তাই তথাকথিত মেয়েলি সব বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে বিরাজমান। আমাদের মায়েদের যেমন দুই হাতে দশ হাতের কাজ করতে হয়, ঠিক তেমন দুর্গাকে দশ হাতে যুদ্ধ করতে হয়েছিল মহিষাসুর বধের সময়।

সব দেবতারা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল দুর্গাকে। অনেকগুলো দৈত্য, দানব, অসুরকে তিনি মেরেছিলেন। আমরা শুধু মহিষাসুরের নামটাই জানি। রক্তবীজ, চন্ড, মুন্ড, শুম্ভ, নিশুম্ভ, ধূম্রলোচন, মধু, কৈটভ আর মহিষাসুর, মোট নয়জন অসুরকে তিনি বধ করেছিলেন। এই একেকজন দুষ্ট অসুর আসলে সমাজের খারাপ লোকদের প্রতীক। ধরে নেয়া যায়, এই অসুরদের একজন চোর, একজন ডাকাত, একজন মিথ্যাবাদী, একজন হিংসুটে, একজন মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে, একজন অসৎ, একজন খুনি, একজন প্রতারক আর একজন নিষ্ঠুর লোক। এরা সবাই দুষ্ট আর সমাজের জন্য ক্ষতিকর মানুষ। তাই বছরে একবার মা দুর্গাকে স্মরণ করে আমরা এসব অশুভ শক্তির বিনাশ করার চেষ্টা করি।

আমরা যেমন ঘর-সংসার, স্বামী-সন্তান, আত্মীয়-পরিজন ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা করতে পারি না, দুর্গার ক্ষেত্রেও আমরা ঠিক তাই দেখতে চেয়েছি। লৌকিক দুর্গা আমাদের মাঝে দেখা দেন সপরিবারে। বাঙালির আপন মনের মাধুরী মেশানো দুর্গা তার সন্তান কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে নিয়ে কৈলাশ থেকে বাপের বাড়ি আসেন। বাঙালির ঘরে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসার মতো আনন্দ। যেমন পরিবারে সবাই আপন, সেরকম জগজ্জননীর বিশ্বসংসারে আমরা শিক্ষিত, অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ী বৈশ্য, শাসনকর্তা- সবাই বিশ্বজননীর সন্তান- সরস্বতী, কার্তিক, লক্ষ্মী ও গণেশের মতো সবাই আপন। সন্তানদের কল্যাণের জন্য মা দুর্গা সর্বদাই উদগ্রীব। তাই ১০ দিক থেকে সন্তানদের রক্ষা করার জন্য তিনি ১০ হাতে ১০ অস্ত্র ধরেছেন।

তবে বাঙালি যেভাবে দুর্গাপূজাকে আত্মস্থ তথা জীবনের অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছে, তেমনভাবে আর কেউ করতে পারেনি। মাতৃরূপে বা শক্তিরূপে মা দুর্গা যেমন বাঙালির অন্তরজুড়ে বিরাজ করছেন, তেমনি কন্যারূপে উমা বাঙালির সংসারে এক অভূতপূর্ব আবেগের সঞ্চার করেছে। কথিত আছে, গিরিরাজ হিমালয় ও তার স্ত্রী মেনকা কন্যা উমা বা পার্বতীকে বিয়ের পর কৈলাসে শিবের ঘরে পাঠিয়েছিলেন।

বৎসারান্তরে সেই কন্যাকে দেখার জন্য মা মেনকার ব্যাকুল প্রার্থনা যেন প্রতিটি বাঙালি পরিবারের সর্বজনীন প্রার্থনায় পরিণত। ঘরের মেয়ে ঘরে আসবে- তাই বাঙালির ঘরে ঘরে দেখা দেয় আনন্দের শিহরণ। আমাদের এই দুঃখ-দৈন্যের ঘরে শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে আসবে মাত্র চার দিনের জন্য- তাই আর সব দুঃখ ভুলে ঘরে ঘরে আনন্দের পসরা সাজায়, নতুন জামাকাপড় পরে দুঃখকে বিদায় দিয়ে আনন্দময় হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ-বাতাস। এভাবে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সামাজিক উৎসবে পরিণত করার ঘটনা পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। মা দুর্গাকে বরণ করে নেয়ার জন্য বাঙালির আগমনী সংগীত আমাদের জীবনপ্রবাহে মিশে যাওয়া এক অবিচ্ছেদ্য ধারা। এর তাৎপর্য হৃদয় দিয়ে, গভীরবোধ দিয়ে অনুভব করতে হয়।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ