Views Bangladesh Logo

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি

দুর্ঘটনার ট্রমা কাটাতে শিশু-কিশোর ও মা-বাবার করণীয়

Mohit  Kamal

মোহিত কামাল

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে তা আমাদের সবাইকেই স্তব্ধ করে দিয়েছে। আমরা যারা দূর থেকে ঘটনাটি দেখেছি তারাও অসহ্য কষ্ট ভোগ করেছি। কোমলমতি শিশুদের মৃত্যু আমাদের আপন সন্তান হারানোর ব্যথা দিয়েছে। যেসব শিশু আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে তাদের কষ্ট বর্ণনার ভাষা আমাদের জানা নেই। যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে তাদের জন্য সবার কষ্ট হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে। আমাদের অনেকেই কথা বলতে পারছি না, স্তব্ধ হয়ে গেছি। অনেকে ভয় পাচ্ছি, ঘুমাতেও পারছি না, দুঃস্বপ্ন দেখছি।


মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনায় শিশুরাও অনেক কষ্ট পাচ্ছে। কেউবা ঢাকা শহরের অন্যান্য স্কুলের, কেউবা সারা বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রী, কিশোর-কিশোরী। এ রকম কঠিন অবস্থায় এমন প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। শিশুদের কষ্ট আমরা বড়রাও অনুভব করছি। শিশুদের আমরা বলতে চাই, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।


শিশুরা অনেকে স্কুলে থাকা অবস্থায় চোখের সামনে দেখেছে ওই ভয়ংকর ঘটনা। কেউ দেখেছে ফেসবুকে, কেউবা টেলিভিশনে। ভয়াল ঘটনার কথা শোনা বা দেখা দৃশ্যগুলো আমাদের মনে জখম করেছে, আঘাত করেছে; কিন্তু দেহের আঘাত আর মনের আঘাতের মধ্যে পার্থক্য আছে। দেহের আঘাত আমরা খোলা চোখে দেখতে পাই, রক্ত দেখতে পাই, আগুনে পুড়ে যাওয়া দেখতে পাই। এ নির্মম দৃশ্যগুলো চোখ দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক বা ব্রেনের ভেতরে চলে যায়। সেখানে আছে আমাদের মন, মনের আবেগ মানে আমাদের মায়া-মমতা-ভালোবাসার আনন্দ-সুখ। এসব ভালো আবেগ ছাড়াও আছে দুঃখ-কষ্ট-যাতনা-হতাশা, রাগ-ক্রোধ, ঈর্ষা-হিংসা, ঘৃণা। মনে আঘাত পেলে কষ্টে ভেঙে যাই আমরা। বিমান ভেঙে পড়ার মতো সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ফলে প্রতিদিনের গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ থেকে দূরে সরে যাই।

শিশুদের করণীয়: নিজের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা
ফেসবুকে এসব দেখা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখব। যত বেশি দেখব, তত বেশি আমাদের মনে জখম হবে। অদৃশ্য বা অদেখা সেই ক্ষত গোপনে গোপনে ক্ষতি করবে। মনে রাখতে হবে, আমরা যারা কিশোর-কিশোরী, আমাদের সবার মন বেশ নরম, অনেক নরম। নরম মনে আঘাতের ছাপ বসে গেলে সারা জীবন তার খারাপ ফল ভোগ করতে হয়। নিজের প্রতিদিনের দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যেতে হয়, নিজের অজান্তেই। পরিস্থিতি মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা কমে যায়। কখনো কখনো বেশি বেশি মন খারাপ বা বিষাদে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জীবন চলার পথ থেকে দূরে সরে যেতে হয় বা উন্নতির পথের সিঁড়ি তখন হারিয়ে যায়।


টেলিভিশনে এসব বিষয়ে খবর দেখব না এখন। পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত ভয়ংকর ছবি কিংবা খবর পড়ব না। তবে প্রকাশিত ভালো খবর কিংবা শিশুদের পাতার মজার মজার লেখাগুলো আমরা পড়ব। কষ্ট দূর করার জন্য মনে বিকল্প শান্তি দেয়ার চেষ্টা করব। যারা যে কাজে আনন্দে পেতাম আগে, সেই কাজটা করব। অনেকে বই পড়তাম, মজার মজার বই পড়ে আনন্দ পেতাম, এখনো সে কাজে বেশি বেশি সময় দেব।


পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘরে বসে ছক্কালুডু, সাপলুডু কিংবা কেরামবোর্ড খেলা যেতে পারে। দাবা খেলাও এখনকার কষ্ট আর মনের চাপ কমাতে সাহায্য করবে। এসব অভ্যাস থাকলে তা বাড়াতে হবে আর না থাকলে নতুনভাবে এসব খেলা শিখতে হবে। অনেকে বেড়াতে পছন্দ করি। বাবা-মাকে বলে এখন বেশি বেশি বেড়ানোর চেষ্টা করব। অনেকে গান কিংবা চিত্র আঁকায় আগ্রহী ছিলাম। সে কাজে উৎসাহী হব।


অনেকেই গান শুনতাম, গান শুনব। বেশি বেশি শুনব। অনেকে ছড়া আবৃত্তি করতাম, এখন আরও বেশি বেশি করব। যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে তাদের জন্য যার যার ধর্ম অনুযায়ী আমরা প্রার্থনা করব। নামাজ পড়ব। বন্ধুর জন্য দোয়া করব। শিশু-কিশোর সংগঠনের সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করব।


কোনো আহত বন্ধু কথা বলতে চাইলে ফোনে কিংবা সরাসরি দেখা করতে চাইলে তার পাশে দাঁড়াব। তার সঙ্গে কথা বলব। তাকে এড়িয়ে যাব না। অসুস্থ বন্ধু সুস্থ বন্ধুকে কাছে পেলে মনের কথা প্রকাশ করবে। কষ্টের কথা খুলে বলবে, যন্ত্রণার কথা বলবে, সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনব। তবে তাকে কিছু বলার জন্য চাপাচাপি করব না। তাহলে অসুস্থতা দ্রুত কাটিয়ে ওঠার সাহস আর শক্তি পাবে সে।


আমাদের অনেকেরই পাঠ্যবই পড়ার পাশাপাশি ছড়া, কবিতা, গল্প লেখার আগ্রহ আছে, উৎসাহ আছে, অভ্যাস আছে। সেই অভ্যাসটা কাজে লাগাব। লিখব। লিখতে থাকব। বড়দের তা পড়িয়ে ভালো মনে হলে তা কিশোর আলো কিংবা বিভিন্ন পত্রিকার শিশুদের পাতায় পাঠিয়ে দেব। প্রকাশিত না হলেও ভেঙে পড়ব না। লিখতে লিখতে, নানা ধরনের গল্প-কবিতা-ছড়া পড়তে পড়তে একদিন লেখক হয়ে যাব- এই বিশ্বাস ধরে রাখব মনে।


অনেকেই ছাদবাগান পছন্দ করি। এ সময় পরিচর্যার এই দায়িত্ব বাড়িয়ে দেব। বাগানের দেখাশোনা করব। নতুন গাছ লাগাব, পুরোনো গাছের গোড়ায় ঠিকমতো পানি দেব, রোদ পাচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল করব। সবাই তো মনে আঘাত পেয়েছি। তাই বলে নিজেকে গুটিয়ে রাখব না। আঘাত জয় করব। কঠিন অবস্থাটা মেনে নেব। স্কুল শুরু হলে অবশ্যই যাওয়া শুরু করব। স্কুল থেকে দূরে থাকব না। মনে রাখব, কষ্ট-দুঃখ, ব্যর্থতা আর হতাশা জয় করার নামই হচ্ছে জীবন। আরও মনে রাখব, কষ্ট ছাড়া কোনো জীবন নেই। জীবনে কষ্ট পেতে হবে, সফল হতে হলে তা জয় করতে হবে সাহসের সঙ্গে।


মনের মধ্যে কোনো প্রশ্ন এলে সঙ্গে সঙ্গে তা মা-বাবা বা অন্য কোনো কাছের মানুষের কাছে প্রকাশ করব। মনের কষ্ট, দুঃখ, যাতনা দমিয়ে রাখব না। কাছের কোনো বন্ধু মারা গিয়ে থাকলে তার জন্য যেসব ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয় সম্ভব হলে সেখানে অংশগ্রহণ করব। এ ধরনের কাজে যোগ দিলে ঘটনা মেনে নেয়ার জোর পাবে মন, শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি জাগে মনে।

মা-বাবাদের জন্য পরামর্শ
আপনার সন্তান স্তব্ধ বা বিমূঢ় হয়ে যেতে পারে, হতবিহ্বল কিংবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় অন্য রকম হয়ে যেতে পারে। কিংবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে পারে, মনের জখমের কারণে কথা বলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের অবস্থায় প্রথম কথা হচ্ছে ঘাবড়ে যাবেন না। দিশাহারা হয়ে জোর করে তাকে কথা বলানোর চেষ্টা করবেন না।
স্কুলে না যেতে চাইলে জোর করবেন না। সময় যেতে দিন। মনের ক্ষত কাটিয়ে উঠলে সে নিজে থেকেই স্কুলে যাওয়ার জন্য উৎসাহী হবে। তার সমস্যা তাকেই জয় করতে দিন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সময় দিন।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, যদি বেশি দিন সে স্কুলে যেতে না চায়, যদি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ওঠে কিংবা খিঁচুনি হয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, ভয় পেতে থাকে তাহলে অবশ্যই নিকটস্থ মনের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন সন্তানকে। মনের চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার অর্থ এই নয়, সে মানসিক রোগী হয়ে গেছে। কুসংস্কার দূর করে এগিয়ে যেতে হবে সমস্যা সমাধানের জন্য। দেরি করা যাবে না। সাইকোলজিস্টদের সহায়তাও নিতে পারেন।


সে কিছু বলতে চাইলে তার বোধের স্তরে নেমে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে হবে। তার সঙ্গে সৎ হতে হবে। মিথ্যা আশ্বাস দেবেন না। মিথ্যা দিয়ে কখনো সমস্যা জয় করা যায় না।
সে কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে অবশ্যই তার ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করবেন। তবে অযৌক্তিক চাহিদা পূরণ করা ঠিক হবে না। যৌক্তিক চাহিদা নির্ধারণ করতে হবে এবং তা পূরণের জন্য সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, মনোচিকিৎসক, মনোশিক্ষাবিদ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ