Views Bangladesh Logo

যেভাবে অতুলপ্রসাদ সেনের বাড়িটি হয়ে গেছে মুন্সিবাড়ি

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

‘অতুলপ্রসাদ সেন’- নামটি বাঙালি সংস্কৃতি, সংগীত ও কাব্যের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। বাংলা গানের প্রবাদপ্রতিম এই সুরকার ও গীতিকারের জন্ম শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার বিঝারী ইউনিয়নের মগর গ্রামে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জোগানো কালজয়ী গান ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা’র স্রষ্টার জন্ম যে বাড়িতে, তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে যে বাড়িতে সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি আজ পরিচিত হয়ে উঠেছে ‘মুন্সিবাড়ি’ নামে।

কিন্তু কীভাবে এই বাড়িটি হাতবদল হয়ে পরিণত হলো মুন্সিবাড়িতে? কবেই বা ঘটলো এই হাতবদলের ঘটনা? আর সরকারের ভূমিকাই বা কী? ভিউজ বাংলাদেশের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সেসব প্রশ্নের উত্তর উঠে এসেছে। জানা গেল, বাড়িটির বর্তমান মালিক এই মুন্সিরাই বা কীভাবে পেলেন এর মালিকানা আর এ নিয়ে স্থানীয়দের ভাবনা কী।

যে বাড়ির পরতে পরতে অতুলপ্রসাদের স্মৃতি রয়ে গেছে, সেটির মালিকানা হাতবদল হওয়ার ঘটনা জানতে হলে যেতে হবে প্রায় দেড়শ বছর পেছনে, ১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর। এই দিনে পুরান ঢাকায় তার মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন এই বিশিষ্ট সংগীতবিদ। তবে তার পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি ছিল শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার পঞ্চপল্লীতে। নদীমাতৃক অঞ্চলের এই শান্ত গ্রামেই ছিল তাদের জমিদার বাড়ি- সুবিশাল দালান, উঁচু বারান্দা, বাগানঘেরা প্রাঙ্গণ আর পদ্মার কোলঘেঁষে বিস্তৃত মাঠ। এই বাড়িতেই অতুলপ্রসাদের বাবা দুর্গামোহন সেন একসময় বসবাস করতেন আর এখানেই কাটে অতুলপ্রসাদ সেনের শৈশব আর কৈশোর। ১৯ শতকের শেষের দিকে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন অতুলপ্রসাদের পৈতৃক বাড়িটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ভাঙনের আশঙ্কায় পরিবারটি কলকাতায় স্থায়ীভাবে চলে যায়। ১৮৯০ সালে অতুলপ্রসাদ প্রবেশিকা পাশের পর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন এবং এরপর আইন শিক্ষা নিতে চলে যান লন্ডনে। ১৮৯৪ সালে তিনি বাংলায় ফিরে এলেও, এপার বাংলায় অর্থাৎ বাংলাদেশের মাটিতে আর পা রাখা হয় না তার। তবে শোনা যায়, জীবনের শেষদিকে একবার মগর গ্রামের (বর্তমানে পঞ্চপল্লী) এই পৈতৃক বাড়িতে আসতে চেয়েছিলেন তিনি, সে লক্ষ্যে চাঁদপুর পর্যন্ত আসার পর গ্রামে বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তিনি চাঁদপুর থেকেই ফেরত চলে যান। এর পর আর কখনই ফেরা হয়নি তার। তবে ততদিনে তাদের জমিদারি প্রায় লুপ্তপ্রায়। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে বাড়িটি পড়ে ছিল প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায়।

কিন্তু এই পরিত্যক্ত বাড়িটি ‘মুন্সি বাড়ি’ হয়ে উঠল কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে বাড়িটির বর্তমান মালিকদের একজন নান্নু মুন্সি বলেন, ‘আমার বাবার মুখে শুনেছি, হিন্দু জমিদাররা অনেক আগেই চলে গিয়েছিল। পরে বাড়ির জমি সরকারের খাস তালিকায় উঠলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে এই ভূমিটি নিলাম সম্পত্তি হিসেবে বন্দোবস্ত নেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। পরবর্তীতে রোজিনা বেগম গংদের থেকে সেটি ক্রয় করেন আমার বাবা আলী আজ্জম মুন্সি।’ বর্তমান বাড়ির মালিক নড়িয়া ভূমি অফিসের ভেন্ডার নান্নু মুন্সি ভিউজ বাংলাদেশকে আরও জানান, তারা তৃতীয়তম মালিক হিসেবে এখন বসবাস করছেন। তারা সরকারকে নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করে এই সম্পত্তিতে বসবাস করছেন।

তবে, অতুলপ্রসাদের বাড়ির বিষয়ে গ্রামের লোকজন ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, এই বাড়িটি কিনে নয় বরং দখল করে পাকিস্তান আমল থেকে নান্নু মুন্সিরা ৪ ভাই বসবাস করছেন। স্থানীয় প্রবীণ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশভাগের পর অতুলপ্রসাদের ভাই বসন্ত কুমার সেন বাড়িটি তাদের কোনো এক পরিচিত ব্যক্তির কাছে দিয়ে চলে যান। অতুলপ্রসাদ সেন নিঃসন্তান ছিলেন আর তার ভাই বসন্ত কুমার সেনের সন্তানরা দেশভাগের সময় কলকাতা ও দিনাজপুরে চলে যান। কলকাতার সূত্র মতে, তারা এখন কালীঘাট ও দক্ষিণ কলকাতায় বসবাস করছেন। কেউ ডাক্তার, কেউ আইনজীবী, কেউ বিদেশে। পৈতৃক ভিটায় তাদের সরাসরি কোনো দাবি নেই বলে জানান স্থানীয়রা।

নড়িয়া ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৫ সালের পর খাস-খতিয়ানভুক্ত হওয়া বাড়িটির বেশিরভাগ অংশ স্থানীয় এক মুসলিম পরিবার বন্দোবস্ত হিসেবে নেয়। পরবর্তীতে এটি স্থানীয় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মুন্সি পরিবারের মালিকানায় আসে। সেই সময় থেকেই ‘মুন্সিবাড়ি’ নামটি চালু হয়। যদিও মৌখিকভাবে সবাই এটিকে ‘মুন্সিবাড়ি’ বলে থাকেন, তবে সরকারি কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায় বাড়িটির কিছু অংশ এখনো সেই 'পুরাতন জমিদার বাড়ি’ হিসেবে চিহ্নিত। কাগজ-কলমে যাই হোক, বর্তমানে বাড়িটিতে জমিদারদের স্মৃতি বলতে রয়ে গেছে অতুলপ্রসাদের থাকার ঘরটি। যদিও সেটি কয়েকবার ভাঙনের মুখে পড়ার পর উপরের ঢালাই করা ছাদটি ভেঙে সেখানে টিনের চাল করা হয়েছে। ১৮ শতকের তৈরি এই বাড়িটিতে নতুন করে রং করা হয়েছে।

ঢাকা থেকে শরীয়তপুর হয়ে ভোজেশ্বর ইউনিয়নের পঞ্চপল্লীতে অতুল প্রসাদের বাড়িতে গিয়ে কার্যত এই বিখ্যাত কবির কোনো স্মৃতিচিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেখা যায়, নান্নু মুন্সির ছোট ভাই রফিক মুন্সি বর্তমানে কবির মূল ঘরে বসবাস করেন। তাদের প্রবাসী ছোট দুই ভাই দোলন মুন্সি ও মহিবুল মুন্সি ইতালি এবং ফ্রান্সে থাকেন। কবির বসার ঘরের জায়গায় তৈরি হয়েছে নতুন ভবন। মুছে দেয়া হয়েছে কবির শেষ স্মৃতিচিহ্নও। ভেঙে পড়েছে কবির ছোটবেলার গোসলের শান বাঁধানো পুকুরপাড়; কিন্তু শত বছরের পুরোনো পুকুরটি এখনো রয়েছে স্মৃতির সাক্ষী হয়ে।

গ্রামের সুমন (ছদ্ম নাম) নামে এক তরুণ বলেন, মুন্সিবাড়ির লোকজন পরিকল্পিতভাবে কবি পরিবারের সব স্মৃতি মুছে ফেলতেই সব ভেঙে ফেলেছে। তবে, এলাকার বেশিরভাগ তরুণই জানে না যে এই কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ এই গ্রামের সন্তান। সত্যটা জানার পরে, তারা দাবি করেন, ‘যদি সত্যিই ওনার বাড়ি হয় তাহলে সরকার যেন সেটা সংরক্ষণ করে।’ স্থানীয় স্কুল শিক্ষক লিপি সরকার (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমরা অতুল প্রসাদের গান শুনি; কিন্তু উনি যে আমাদেরই গ্রামের এটা অনেকেই জানেন না। স্কুলে তার স্মৃতিফলক রয়েছে তবে বাড়ির সামনে চিহ্নও নেই যে এখানে এমন একজন মানুষ জন্মেছিলেন।’

সরেজমিন গিয়ে নড়িয়া উপজেলা পরিষদের তথ্যকেন্দ্রেও অতুল প্রসাদের কোনো স্থায়ী স্মারক বা প্রদর্শনী দেখা যায়নি। যদিও কয়েক বছর আগে গ্রাম পর্যায়ে তার নামে একটি মেলা অনুষ্ঠান হয়; কিন্তু সেটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এই মেলার উদ্যোক্তা শরীয়তপুরের সাবেক ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) রাম চন্দ্র দাস। তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, কবির স্মৃতি সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে করিব প্রতিষ্ঠিত পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে মেলার আয়োজন শুরু করেছিলেন। যাতে করে করিব স্মৃতি সংরক্ষণ হয়। কিন্তু ২ বছর চলার পর কোনো এক অজানা কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। সাবেক এই ডেপুটি কমিশনার আরও বলেন, তিনি করিব পৈতৃক এই সম্পত্তি উদ্ধারের উদ্যোগও নিয়েছিলেন; কিন্তু জেলা থেকে বদলির কারণে সেটি তখন আর সম্ভব হয়নি।

গ্রামের এক যুবক বলেন, রাম চন্দ্র থাকলে হয় তো এতদিনে কবির বাড়িটি উদ্ধার হয়ে এটি সংরক্ষিতভাবে সাধারণের জন্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা হতো। তিনি আরও বলেন, এই স্থানটিকে সরকারের পক্ষ থেকে একটি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক স্থানে রূপান্তর করার দরকার, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানে- এই মাটিতে এমন একজন মনীষী জন্মেছিলেন। ১৯৬৫ সালে বন্দোবস্ত পাওয়া বাড়ি নিয়ে হঠাৎ এত বছর পরে কেন প্রশ্ন উঠল, এর জবাবে অনেকেই জানান, ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ার ফলে মুন্সিদের ওপরে স্থানীয়দের যে সুপ্ত ক্ষোভ ছিল, তার ফলেই নতুন করে আলোচনায় বাড়িটি। এ ব্যাপারে সাবেক এই ডেপুটি কমিশনার বলেন, 'এটি গ্রামের সাধারণ মানুষের বিষয় নয়, কবির বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনকেই উদ্যোগ নিতে হবে।'

এ বিষয়ে ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে গত বুধবার কথা হয় বর্তমান ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিনের। তিনি জানান, অতুল প্রসাদের কোনো উত্তরাধিকারী যদি এই সম্পত্তির অধিকারের জন্য আসতো কিংবা কোনো মহল থেকে বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি উঠতো তা হলে প্রশাসন সে হিসেবে ব্যবস্থা নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করত। তার কাছে এমন কোনো দাবি কখনই আসেনি বলে জানান তিনি। এদিকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর) মো. আব্দুল মোক্তাদের ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, এই বিষয়টি তাদের নজরে এখনো আসেনি। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিবে বলেও জানান তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মোহন রায়হান এক আবেগঘন প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এটা শুধু একটা বাড়ি নয়, এটা বাঙালির আত্মার ঠিকানা। অথচ সেই আত্মার ঠিকানাটা আজ পর হয়ে গেছে। খুব ব্যথা লাগে- আমরা কীভাবে আমাদের শেকড় ভুলে যেতে পারি? অতুল প্রসাদের মতো মানুষদের বাড়ি যদি সংরক্ষণ না থাকে তবে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাহিত্য একদিনে তৈরি হয় না। অতুল প্রসাদের মতো মানুষদের জন্মভূমি সংরক্ষণ করেই আমরা আমাদের সাহিত্যচর্চাকে গভীর করতে পারি।’

বাংলাদেশ কবিতা পরিষদের সভাপতি আরও বলেন, ‘অতুল প্রসাদ কেবল সংগীতশিল্পী নন, তিনি আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। তার বাড়িটি সংরক্ষণ না করা মানে, আমাদের ইতিহাসকেই অস্বীকার করা।’ স্থানীয় এবং বিশিষ্টজনের বক্তব্য অনুযায়ী এ মুহূর্তে বাড়িটি সংরক্ষণ করে সরকারিভাবে এটিকে সংস্কৃতি ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। একই সঙ্গে বাড়ির সামনে তথ্যফলক ও স্মৃতিফলক স্থাপন করে পর্যটকদের আগ্রহ বাড়ানো সম্ভব হবে। এছাড়াও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার্ষিক ‘অতুল প্রসাদ স্মরণ উৎসব’ আয়োজন চলমান রাখার কথাই বলছে স্থানীয়রা। স্থানীয় স্কুলগুলোতে অতুল প্রসাদের জীবন ও সাহিত্যচর্চা অন্তর্ভুক্ত করা হলে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হবে পঞ্চকবির একজন অতুল প্রসাদের স্মৃতি।

যেখানে বিশ্বজুড়ে মনীষীদের স্মৃতি রক্ষা করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়, সেখানে অতুল প্রসাদের মতো একজন সাংস্কৃতিক রত্নের ভিটেমাটি ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে। স্থানীয়রা বলছেন, ‘মুন্সি বাড়ি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা এই জায়গাটি এখনই সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে না- কীর্তিমান অতুল প্রসাদের সঙ্গে এই মাটির বন্ধন কতটা গভীর ছিল। এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে, মুন্সিরাও বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যাপারে একমত হন। তারা বলেন, সরকার বিকল্প ব্যবস্থা করে দিলে তাদের আপত্তি থাকার কথা নয়।

সাহিত্য অনুরাগীরা বলছেন, বাংলাদেশে অনেক মনীষীর পৈতৃক ভিটা সময়ের স্রোতে মুছে গেছে। অতুলপ্রসাদের বাড়িটি তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। কোনো রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় ও সরকারি পদক্ষেপের অভাবে এই জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে কালের অতল গহ্বরে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ