অ্যালগরিদম থেকে আস্থার পথে
আর্থিক খাতে জালিয়াতি দমনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)
“প্রতারণা হলো এক ধরনের অস্বাভাবিক, সুচিন্তিত, সূক্ষ্মভাবে আড়াল করা, সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল এবং প্রায়ই অত্যন্ত সুসংগঠিত অপরাধ, যা নানান রূপে প্রকাশ পায়।” – ভ্যান ভ্লাসেলেয়ার প্রমুখ
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে প্রতারণা ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, এটি কোনোভাবেই আধুনিক সমাজের জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়— এমনকি এটি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অনেক প্রাণী প্রজাতিতেও এমন আচরণ দেখা যায়, যাকে প্রতারণামূলক বা ছলনামূলক বলা যেতে পারে। তবে “অপরাধ” বা “অন্যায়”-এর মতো ধারণাগুলো যেহেতু মূলত মানবসৃষ্ট, তাই এই আলোচনাটি মানুষের কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হলো।
প্রতারণার নতুন মুখ: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এখন ডিজিটাল উদ্ভাবনের কারণে এক নতুন ধরনের আর্থিক প্রতারণার মুখোমুখি। একসময় যেখানে প্রতারণা মানেই ছিল চেক জালিয়াতি, ঋণ কেলেঙ্কারি বা ভুয়া মুদ্রা প্রচলন, এখন সেখানে ঘটছে প্রযুক্তি-নির্ভর জটিল অপরাধ। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কার্ড জালিয়াতি বা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থায় সাইবার অনুপ্রবেশ—এসব ঘটনা নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আগে যেখানে জালিয়াতি ঘটতে সময় ও শারীরিক প্রচেষ্টা লাগত, এখন ডিজিটাল প্রতারণা ঘটে কয়েক সেকেন্ডে। এই দ্রুতগামী হুমকি আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করছে।
AI: এক দ্বিমুখী তরবারি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেমন প্রতিরক্ষা জোরদার করছে, তেমনি অপরাধীরাও এটি ব্যবহার করছে আরও সূক্ষ্ম ও ভয়াবহ প্রতারণার জন্য। জেনারেটিভ AI এখন বাস্তব মানুষের মতো কণ্ঠস্বর বা মুখ তৈরি করতে পারে (deepfake), আবার AI-নির্ভর ফিশিং টুলস ব্যক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে অত্যন্ত নিখুঁত প্রতারণামূলক বার্তা তৈরি করতে পারে। অপরাধীরা এমনকি মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে আর্থিক সিস্টেমের দুর্বলতা শনাক্ত করছে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে।
আজকের প্রতারণা আর স্থির কোনো ছলনা নয়—এটি বুদ্ধিমত্তা-চালিত গতিশীল প্রতারণায় রূপ নিয়েছে, যার পেছনে রয়েছে অ্যালগরিদমের শক্তি।
নতুন অস্ত্রভাণ্ডার: প্রতারণা শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধে AI
এই ডিজিটাল যুদ্ধ জিততে হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের প্রযুক্তিগত অস্ত্রভাণ্ডার হালনাগাদ করতে হবে। পুরনো, নিয়মভিত্তিক (rule-based) সিস্টেম দিয়ে আর চলবে না। এখন দরকার এমন প্রযুক্তি যা নিরবচ্ছিন্নভাবে শিখবে, বাস্তব সময়ে প্রতিক্রিয়া দেবে, এবং নতুন প্রতারণার ধরণ অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেবে—যা AI-এর মূল বৈশিষ্ট্য।
AI-চালিত প্রতারণা শনাক্তকরণ সিস্টেম প্রতি সেকেন্ডে হাজার হাজার লেনদেন বিশ্লেষণ করে; যেমন—লেনদেনের পরিমাণ, অবস্থান, ডিভাইস, সময়, ব্যবহারকারীর পূর্ব আচরণ, এমনকি খরচের প্রেক্ষাপট। কোনো অস্বাভাবিকতা (যেমন হঠাৎ বড় লেনদেন বা অচেনা ডিভাইস থেকে লগইন) হলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক সংকেত দেয়।
এছাড়া predictive modeling ও anomaly detection ব্যবহার করে AI ভুল শনাক্তের হার (false positives) কমিয়ে সঠিক ঝুঁকি নিরূপণ করে।
সবচেয়ে কার্যকরী হচ্ছে ensemble models, যেখানে একাধিক অ্যালগরিদম একসঙ্গে কোনো লেনদেন যাচাই করে, ফলে নির্ভুলতা ও স্থিতিস্থাপকতা দুটোই বাড়ে। তবে এই সিস্টেমগুলো কার্যকর রাখতে হলে দরকার মানসম্মত ডেটা ও ক্রমাগত পুনঃপ্রশিক্ষণ।
বৈশ্বিক শিক্ষা: বাস্তবে AI-এর প্রয়োগ
বিশ্বের শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে, কীভাবে AI প্রতারণা দমনে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে—
❖ Cognizant একটি AI-চালিত চেক জালিয়াতি শনাক্তকরণ ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যা স্ক্যান করা চেকের ছবি বিশ্লেষণ করে “confidence score” নির্ধারণ করে।
❖ JP Morgan Chase AI ব্যবহারের মাধ্যমে ভুল সতর্কতার সংখ্যা ৫০% কমিয়েছে এবং প্রকৃত প্রতারণা শনাক্তকরণ ২৫% বৃদ্ধি করেছে।
❖ Visa AI-নির্ভর নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ ব্যবহার করে প্রতারণা চক্রগুলোকে গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর আগেই থামিয়ে দেয়।
❖ American Express গভীর শিক্ষণ (deep learning) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর আচরণ ও ব্যয়ের ধরণ বিশ্লেষণ করে তাৎক্ষণিকভাবে অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করে।
এসব উদাহরণ দেখায়—AI এখন শুধু সহায়ক নয়, আর্থিক সততার প্রথম সারির রক্ষক।
বাংলাদেশের করণীয়
বাংলাদেশের আর্থিক খাত এখন এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং, পেমেন্ট ও ফিনটেক খাতে দ্রুত অগ্রগতি যেমন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে, তেমনি জালিয়াতির ঝুঁকিও বহুগুণ বাড়ছে। এখন প্রতিক্রিয়াশীল নয়, পূর্বাভাসনির্ভর (predictive) ও ডেটা-চালিত উদ্যোগের সময়।
বাংলাদেশে টেকসই ও নিরাপদ আর্থিক ইকোসিস্টেম গঠনে দরকার—
❖ ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মে AI-ভিত্তিক প্রতারণা শনাক্তকরণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন।
❖ ডেটা গভর্নেন্সে বিনিয়োগ, যাতে পরিস্কার, নির্ভরযোগ্য ও ইন্টারঅপারেবল ডেটাসেট গড়ে তোলা যায়।
❖ প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান—যাতে একত্রে প্রতারণার ধরণ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।
❖ রেগুলেটরি স্যান্ডবক্স শক্তিশালীকরণ, যাতে নতুন প্রযুক্তি ও প্রতারণা প্রতিরোধের মডেল নিরাপদভাবে পরীক্ষা ও বাস্তবায়ন করা যায়।
AI কেবল একটি প্রযুক্তি নয়—এটি ডিজিটাল আর্থিক আস্থার ভিত্তি। প্রতারকরা যেমন নতুন পদ্ধতি শিখছে, তেমনি আমাদের প্রতিরক্ষাও হতে হবে আরও স্মার্ট, দ্রুত ও অভিযোজনযোগ্য।বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে এখনই AI-চালিত প্রতারণা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে—গ্রাহকের নিরাপত্তা, প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও সার্বিক আস্থা বজায় রাখতে।
ডেটা-নির্ভর, AI-সক্ষম দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আমরা হারাব শুধু অর্থ নয়, বিশ্বাস—যা টেকসই ডিজিটাল রূপান্তরের প্রাণশক্তি। এখনই পদক্ষেপ না নিলে, অনিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল প্রতারণা অর্থনীতি ও খাতের সুনাম—দু’টিকেই বিপন্ন করবে।কিন্তু যদি আমরা প্রযুক্তি, নীতি ও নৈতিকতাকে একসঙ্গে আনি, তাহলে AI কেবল একটি অ্যালগরিদমিক প্রতিরক্ষা নয়—বরং বাংলাদেশের আর্থিক ভবিষ্যতের প্রতি আস্থার নিশ্চয়তা হয়ে উঠতে পারে।
ওবেদুর রশিদ বিন সাক্রাত কাদেরি:ব্যাংকার ও ডেটা সায়েন্স অনুরাগী
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে