আসাদের পতনের ছয় মাস পরও সিরিয়ায় ন্যায়বিচারের আশা ম্লান: জিআইজেএন
বাশার আল-আসাদ সরকারের আকস্মিক পতনের ছয় মাস পরও সিরিয়ায় পুরোনো শাসকদের মতোই নতুনদের কাছ থেকেও তথ্যপ্রাপ্তি আর ন্যায়বিচারের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে বলে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও স্বাধীন তদন্তকারীরা। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নতুন অধ্যায় শুরুতে সিরিয়ান ও পর্যবেক্ষকদের আশাবাদ পূরণ হয়নি বলেও মনে করছেন তারা।
চলতি মাসের শুরুতে হামবুর্গে ২০২৫ সালের নেটজওয়ার্ক রিসার্চ বার্ষিক সম্মেলনে সিরিয়ার আসাদ-পরবর্তী বাস্তবতা তদন্তের পর তাদের এসব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সিরিয়ান সাংবাদিক আমের মাতার, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী মারিয়ানা কারকোটলি এবং এআরডির কায়রো ব্যুরো প্রধান আনা ওসিয়াস। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের মাঝে অপরাধ নথিভুক্ত করার চ্যালেঞ্জগুলোও।
অনুসন্ধানী গণমাধ্যম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (জিআইজেএন) জানায়, সম্মেলনটির বক্তাদের অভিমত, সিরিয়ায় এখনো আটক-নির্যাতনের একই নৃশংস অনুশীলন দেখা যাচ্ছে, যা দমন-পীড়নের বিরক্তিকর ধারাবাহিকতাকে বহন এবং ন্যায়বিচারের আশাকে ক্রমশ ম্লান করে দিচ্ছে।
একের পর এক হামলার পর গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সশস্ত্র বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্কের দখল নিলে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। কয়েক দশক পর প্রথমবারের মতো নিজ দেশে ফিরতে সক্ষম হন দেশটির বহু নির্বাসিত নাগরিক, ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক আর সাধারণ মানুষ ।
তারা যখন সীমান্ত পার হয়ে দেশে ঢুকছিলেন, স্বাধীনতা উদযাপন করছিলেন তখন তাদের সামনে আসাদ শাসনের ছেড়ে যাওয়া নানা ধরনের অবকাঠামো উন্মোচিত হয়। যেমন, ভয়ের প্রতীক হিসেবে কুখ্যাত প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ কিংবা কারাগারগুলো। স্বৈরশাসন ও গৃহযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত অপরাধ অনুসন্ধানে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের কাছে এটি ছিল সত্য উন্মোচনের সুবর্ণ সুযোগ।
সেডনায়া কারাগারের ভেতর থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায়, মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে আছে পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট। ঘরে পড়ে আছে পরিত্যক্ত জুতো ও পোশাক। আর প্রিয়জনের খোঁজে স্বজনেরা ধ্বংসাবশেষের ভেতর খুঁজে বেড়াচ্ছেন কোনো সূত্র বা চিহ্ন।
জিআইজেএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তবে, আসাদ মস্কোতে পালিয়ে যাওয়ার পর পরই সিরিয়ার অভ্যন্তরে ভ্রমণকারী সাংবাদিক এবং কর্মীদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত দেয়, প্রবেশগম্যতা ও জবাবদিহির ওই সংক্ষিপ্ত জানালাও দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
২০১২ সাল থেকে জার্মানিতে নির্বাসিত আইসিস প্রিজনস মিউজিয়ামের পরিচালক মাতার স্বৈরশাসক আসাদের পালিয়ে যাওয়ার সময় যে ধাক্কা ও আশা অনুভব করেছিলেন, সেগুলোকে স্মরণ করেন নেটজওয়ার্ক রিসার্চ বার্ষিক সম্মেলনে। বলেন, ‘সিরিয়াকে বাশার আল-আসাদের হাত থেকে মুক্ত করাই ছিল আমার জীবনের বড় স্বপ্ন’।
সিরিয়ায় ফিরে মাতার ও তার দল থ্রি-ডি ক্যামেরায় পরিত্যক্ত কারাগারগুলোকে ধারণ ও নথিভুক্ত এবং সেগুলোর ভার্চ্যুয়াল মডেল তৈরি করেছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কুখ্যাত সেদনায়া সামরিক কারাগার, যেখানে কয়েক দশক ধরে অসংখ্য বন্দি নির্যাতন এবং অন্তর্ধানের সম্মুখীন হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল থাকায় মাতার ও তার দল ৭০টিরও বেশি কারাগারের ছবি তুলতে সক্ষম হন, যেগুলোর দেয়ালে বন্দিদের নাম ও নৃশংসতার প্রমাণ খোদাই করা হয়েছিল; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলোই ফের সিল করে দেয়া বা নতুন শাসন ব্যবস্থার অধীনে পুনর্নির্মিত হয়েছিল।
দামেস্কের আল-খতিব কারাগারে ২০১১ সালে আটক ও নির্যাতন করা হয়েছিল মাতারকে। সেটি পরিদর্শনে এখনো একই নৃশংস অনুশীলন দেখতে পান তিনি, যা দমন-পীড়নের বিরক্তিকর ধারাবাহিকতাকে তুলে ধরে।
মাতার বলেন, ‘তারা আবারও ভয়ঙ্কর কারাগারগুলো ব্যবহার করতে চায়’।
জবাবদিহির ক্ষেত্রে বিষণ্ণ আইনি পরিস্থিতির বর্ণনা দেন স্বাধীন আইনি তদন্তকারী মারিয়ানা কারকাউটলি। তার ব্যাখ্যা হচ্ছে, আসাদের পতনের ছয় মাস পরও ‘সিরিয়ায় যুদ্ধাপরাধের মামলা করার কোনো আইনি কাঠামো নেই। অন্তর্বর্তী সরকার অতীতের অপরাধের ন্যায়বিচার অর্জনে খুব কম আগ্রহ দেখায় এবং তথ্যের অ্যাক্সেসকে বাধা দেয়’।
‘তারা আক্ষরিক অর্থেই আমের এবং তার দল যা করছে, তার বিরুদ্ধে কাজ করছে... সহিংসতার চক্র পুনরুৎপাদন করছে’- বলেন কারকাউটলি।
তিনি আরও যোগ করেন, সিরিয়ার বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের প্রচেষ্টা স্থবির হয়ে পড়েছে। এটি অযৌক্তিক যে, আমরা ইউরোপের যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রসিকিউটরদের সঙ্গে কথা বলতে পারি; কিন্তু আমাদের নিজস্ব অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে নয়।’
আসাদের চলে যাওয়ার পর পরই সিরিয়া থেকে রিপোর্ট করা আনা ওসিয়াস দেশে প্রবেশের অবাস্তব অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলেন, ‘একজন ভারী অস্ত্রে সজ্জিত প্রহরী আমাদের হাসিমুখে স্বাগত জানান- ‘সিরিয়ায় স্বাগতম... সাংবাদিক, সাংবাদিক, হ্যাঁ, ভিতরে আসুন!’। তবুও, সেই প্রাথমিক মুহূর্ত থেকেই অস্বচ্ছ ভিসা প্রক্রিয়া ও অসম অনুমতিতে বিশেষ করে স্থানীয় সাংবাদিক ও মিডিয়ার জন্য প্রবেশগম্যতা ক্রমশ সীমিত হয়ে পড়েছে’।
ওসিয়াস উল্লেখ করেন, ‘সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ হলেও এখনো দৃঢ়ভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাকে সিরিয়ার নতুন রক্ষক হিসেবে প্রচার করছে এটি। নতুন সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতায়ও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করছে’।
সতর্ক আশাবাদী হয়ে অধিবেশনটি শেষ করেন অধিবেশনটির সঞ্চালক জার্মান গণমাধ্যম এসডব্লিউআরের সম্প্রচারকর্মী ক্রিস্টিন বেকার।
‘আপনি তদন্ত করছেন, নথিভুক্ত করছেন, প্রতিবেদন করছেন- এবং যতক্ষণ এটি ঘটছে, ততক্ষণ জিনিসগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে আর অন্ধকারে ঘটছে না’- বলেন তিনি।
‘সিরিয়ার বেদনাদায়ক সাম্প্রতিক অতীত উন্মোচনের জানালা সংকুচিত হলেও চলমান চ্যালেঞ্জের মধ্যে সত্য সংরক্ষণ এবং ন্যায়বিচারের সংগ্রামে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক এবং আইনি তদন্তকারীদের প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ’ বলেও উল্লেখ করেন ক্রিস্টিন বেকার।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে