হিরোশিমায় পারমাণবিক হামলার ৮০ বছর
বিশ্ব আজ স্মরণ করছে মানবজাতির ইতিহাসে বিভীষিকাময় এক দিন। জাপানের হিরোশিমায় প্রথম পারমাণবিক বোমা হামলার ৮০ বছর। ১৯৪৫ সালের এই দিনে, স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি বি-২৯ বোমারু বিমান হিরোশিমা শহরের উপর ফেলে ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বোমা। মুহূর্তেই শহরটি পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।
প্রাথমিক বিস্ফোরণে প্রাণ হারান হাজার হাজার মানুষ। সেই বছরের শেষ নাগাদ নিহতের সংখ্যা পৌঁছায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজারে। বেশিরভাগই তীব্র তাপ, আহত অবস্থায় চিকিৎসার অভাব এবং বিকিরণজনিত কারণে মারা যান।
এর ঠিক তিন দিন পর, ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে ফেলা হয় দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা। দুটি হামলার ভয়াবহতার চাপে জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।
হামলার আট দশক পরেও ক্ষত শুকায়নি। যারা বেঁচে আছেন তারা 'হিবাকুশা' নামে পরিচিত। এখনও তারা লড়ছেন নানা জটিল রেডিয়েশন-সম্পর্কিত রোগের সঙ্গে, যার মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার, পঙ্গুত্ব এবং মানসিক ট্রমা।
একজন হিবাকুশা জানান, 'ছোটবেলা থেকেই আমি শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলাম। আমার স্ট্রোক হয়েছিল, ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ে। দু’বার স্তন ক্যান্সারের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।'
আরেকজন বলেন, 'যেদিন বোমা পড়েছিল, আমি তখন এই বাড়িতেই ছিলাম। আমরা কয়েকজন বেঁচে গিয়েছিলাম, বাকিরা সবাই মারা যায়।' আরও অনেকে জানিয়েছেন একাধিকবার অস্ত্রোপচারের অভিজ্ঞতা এবং হাসপাতাল জীবনের ক্লান্তিকর লড়াইয়ের কথা।
হিরোশিমার সেই সময়কার মৃতদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ ছিলেন কোরীয় যাদের জোর করে জাপানে আনা হয়েছিল উপনিবেশিক আমলে। সে সময় হিরোশিমায় বসবাসরত কোরীয়দের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার।
১৯৪৯ সালে হিরোশিমাকে 'শান্তির শহর' হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং গড়ে তোলা হয় ‘হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্ক’। প্রতি বছর এখানে জড়ো হন হাজারো মানুষ—নিহতদের স্মরণে এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে সোচ্চার হতে।
এই বছর, ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজনটি পেয়েছে বিশেষ আন্তর্জাতিক গুরুত্ব। অংশ নেন শান্তিকর্মী, বিশ্বনেতা ও সাধারণ মানুষ। তাদের একটাই দাবি, বিশ্ব যেন আর কখনো পারমাণবিক ধ্বংসের সাক্ষী না হয়।
বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বার্তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, হামাস-ইসরায়েল সংঘাত, ইরানের পারমাণবিক উত্তেজনা এবং ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা এই সবকিছুই পারমাণবিক বিপদের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, 'ইতিহাস আবার ফিরে আসবে কিনা, সেই ভয় এখনই পেয়ে বসেছে। ইউরোপের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়—যেকোনো মুহূর্তে নতুন যুদ্ধ শুরু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্বে উত্তেজনা প্রশমনে দায়িত্ব না নেয়, তাহলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।'
এমন ভয়াবহ ঘটনার পরও যুক্তরাষ্ট্র এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি, যা অনেক জাপানির কাছে রয়ে গেছে এক গভীর অপূর্ণতা হিসেবে।
আজ হিরোশিমায় যখন ঘণ্টা বাজিয়ে, পুষ্পস্তবক অর্পণ করে, এবং নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে নিহতদের স্মরণ করা হচ্ছে, তখন একটাই বার্তা ঘুরে ফিরে আসছে, আর কখনো নয়।'
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে