Views Bangladesh Logo

পাচারের জালে ইলিশ: সরবরাহ বাড়লেও নাগালের বাইরে

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ এখন শুধু খাদ্যই নয়, গত কয়েক দশক ধরে একে রাজনৈতিক মাছ হিসেবেও চিহ্নিত করা হচ্ছে। কখনো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করতে আবার কখনো বিশেষ রাষ্ট্রপ্রধানের মন জয়ের উপকরণ হিসেবে ইলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে ‘উপহার টোকেন’ হিসেবে।

কিন্তু এ মাছের প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। ভরা মৌসুমে নদীতে জেলেদের জালে রুপালি এ মাছ ধরা পড়লেও বাজারে গিয়ে দেখা যায় ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। সরবরাহ বেড়েছে ঠিকই; কিন্তু মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে জাতীয় মাছ। তাছাড়া সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বহুমুখী কৌশলে পাচার এবং সাপ্লাই চেইনের অতিরিক্ত খরচের কারণে ইলিশ মানুষের কাছে ‘স্বপ্নের মাছ’-এ পরিণত হয়েছে।

বাজারে আগুনঝরা দাম
সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশের ভরা মৌসুমেও বাজারে দাম অনেক বেশি। দাম এত বেশি যে সাধারণ ভোক্তার পক্ষে কেনা প্রায় অসম্ভব। খুচরা বাজারে এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। ৫শ-৭শ গ্রাম ইলিশ মিলছে ১ হাজার ৫০০ টাকায়, এক কেজির কিছু কম ওজনের ইলিশ ১৮শ থেকে ২ হাজার টাকায় এবং বড় ইলিশ (২ থেকে ২.৫ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশের বেশ কিছু বাজারেও দেখা গেছে ইলিশের ঊর্ধ্বমুখী দাম।

বিক্রেতারা বলছেন, পরিবহন খরচ, বরফ, আড়তের কমিশন ও মধ্যস্বত্বভোগীদের মার্জিন যোগ হয়ে ঢাকায় এসে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। কারওয়ানবাজারের এক বিক্রেতা ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, ‘মৌসুমে মাছ আসছে বটে; কিন্তু দাম এত বেশি যে অনেকেই কিনতে সাহস পাচ্ছেন না।’

অন্যদিকে নিউমার্কেটের এক ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ইলিশের মৌসুমে যদি ইলিশই খেতে না পারি তাহলে লাভটা আসলে কার হচ্ছে?’

পাচারের বহুমুখী কৌশল
ইলিশকে ঘিরে দেশের ভেতরে যেমন প্রবল চাহিদা, তেমনি বিদেশেও রয়েছে ব্যাপক কদর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইলিশ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণের পরও নানা পথ ঘুরে বিপুল পরিমাণ ইলিশ পাচার হচ্ছে দেশের বাইরে।

জানা যায়, অভিনব কৌশলে স্থল-নৌ ও আকাশপথে ইলিশ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন পাচারকারীরা। যশোর, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর ও কক্সবাজার-টেকনাফ স্থল সীমান্ত দিয়ে ভারত ও মিয়ানমারে পাচার হয় ইলিশ। অন্যদিকে মাছ ধরার ট্রলার ও কার্গো জাহাজে গভীর সমুদ্র থেকে সরাসরি বিদেশি জাহাজে তোলা হয়। অনেক সময় রপ্তানির চালানে ঘোষণা করা হয় ‘অন্য মাছ’; কিন্তু এর ভেতরে থাকে ইলিশ। এছাড়াও বিদেশগামী যাত্রীরা লাগেজ বা কুরিয়ারের মাধ্যমে আকাশপথে ‘উপহার’ বা ‘খাবার’ নামে প্রচুর ইলিশ নিয়ে যাচ্ছেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরেই কোল্ডস্টোরেজের ছত্রছায়ায় মজুত করা ইলিশ অন্য মাছের চালানের সঙ্গে বিদেশে পাঠানো হয়।

পাচারের কারণ
বিদেশি বাজারে ইলিশের বিপুল চাহিদা এবং উচ্চমূল্যে বিক্রির সুযোগ পাচারকারীদের বড় প্রলোভন হিসেবে কাজ করছে। সূত্র জানিয়েছে, ভারতে পাচারের ক্ষেত্রে টাকার সঙ্গে রুপির বিনিময় পার্থক্যে উচ্চ মুনাফার লোভ কাজ করছে। এছাড়া ভারতের উৎসব ও সামাজিক চাহিদা মেটাতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহও আছে। স্থানীয় দাদন শোধ করতে অনেক সময়ই আড়তদাররা পাচারের পথ বেছে নেন।

ফলে স্থানীয় বাজারে এ মাছ সরবরাহে সংকট তৈরি হচ্ছে, দাম বাড়ছে এবং সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।

জানা গেছে, একসময় জাতীয় পার্টির এরশাদ আমলে টিপু-শাহজাহান গোষ্ঠী ইলিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী শাহজাহান খানের ঘনিষ্ঠজনদের হাতে। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এই নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চলে গেছে বিএনপি ঘরানার ব্যবসায়ীদের কাছে।

গত কয়েকদিন ধরে কারওয়ানবাজার, যাত্রাবাড়ী ও টঙ্গী মার্কেটের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- ঢাকার অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাই এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে কার্যত তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

খুলনার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সুন্দরবন গ্রুপের এক কর্ণধার নাম না প্রকাশের শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রতি বছর মাছের এই বাজারে কয়েক লাখ কোটি টাকার লেনদেন হয়, যার কোনো হিসাব সরকারের কাছে নেই।’

খুলনার ধুবলার চরের ব্যবসায়ী মহিদুল জানান ভিন্ন এক কথা। তিনি বলেন, ‘আজকে যে মাছ বাজারে দেখছেন, সেগুলো বিক্রি হয়ে গেছে এক বছর আগেই। দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে বেচাবিক্রির সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হয় ঢাকার বড় হোটেলগুলোতে।’ তিনি জানান, ‘তাদের প্রতিদিন গড়ে ১২টি ট্রলারে ১০০ থেকে ১২০ টন মাছ সংগ্রহ করা হয়।’

এ বিষয়ে কারওয়ানবাজারের ‘মা মৎস্য আড়ত’-এর রহিম শেখ সরাসরি মন্তব্য না করলেও ইঙ্গিত দেন, কারওয়ানবাজারে আসা মাছের সিংহভাগই নানা পথ ঘুরে শেষ পর্যন্ত পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে।

রপ্তানি ও সরকারের অবস্থান
সরকার সম্প্রতি ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে নির্দিষ্ট কোটা ও ন্যূনতম মূল্য (প্রতি কেজি ১২.৫ মার্কিন ডলার) নির্ধারণ করে। তবে গতবারের তুলনায় এবার অনুমোদিত রপ্তানির পরিমাণ অর্ধেক। গত বছর দুর্গাপূজার জন্য প্রথমে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়া হয়েছিল, পরে তা কমিয়ে ২ হাজার ৪২০ টন করা হয়। এবার অনুমোদিত পরিমাণ আরও কমিয়ে দিয়ে ১ হাজার ২০০ টন দেয়া হয়েছে।

আর রপ্তানির এই ঘোষণায় প্রভাব পড়েছে বাজারে- চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ সংকট তৈরি হচ্ছে আর দামও ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। একদিকে অবৈধ পাচার অন্যদিকে বৈধ রপ্তানি- সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের পাতে ইলিশ এখন অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। জেলেরা পাচ্ছেন না ন্যায্য দাম, ভোক্তারা পাচ্ছেন না সহজে মাছ আর পাচারকারীদের হাতেই জমছে অবৈধ মুনাফা।

সরকার জানিয়েছে, অনুমোদিত পরিমাণের বেশি ইলিশ রপ্তানি করা যাবে না। অনুমতি হস্তান্তর করা অথবা অনুমোদিত রপ্তানিকারক ছাড়া সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে রপ্তানি করা যাবে না। প্রয়োজনে সরকার যে কোনো সময় রপ্তানি বন্ধ করতে পারবে।

পাইকারি ও খুচরা বাজারে অস্থিরতা
বরিশালের পোর্ট রোডের পাইকারি বাজারে মেঘনার ইলিশের দাম এখন কেজিপ্রতি ১ হাজার ৯০০ টাকা। খুচরায় গেলে তা দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকায়। বড় আকারের ইলিশের দাম ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে আর ছোট ইলিশ (তিনটি মিলে ১ কেজি) পাওয়া যাচ্ছে ৭০০ টাকায়। তবে সাগরের ইলিশের দাম তুলনামূলকভাবে কম হলেও ঢাকায় পৌঁছাতে পরিবহন, বরফ, ক্ষয়ক্ষতি এবং আড়তের কমিশন মিলিয়ে প্রতি কেজিতে ৩৫০ থেকে ৫৫০ টাকা বেড়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকা হয়।

লেবেল প্রতারণা ও জেলেদের লাভ-লস
কলাপাড়া, পাথরঘাটা ও তালতলীর আড়তদাররা জানান, দাম বাড়ানোর প্রধান কৌশল হলো ইলিশের আকার ও লেবেলে। ছোট ইলিশের সরবরাহ বেশি তাই দাম তুলনামূলকভাবে কম থাকে। বড় ইলিশের চাহিদা সবসময় বেশি; কিন্তু সরবরাহ কম হওয়ায় দাম স্থিতিশীল থাকে না। এছাড়া, সস্তা সাগরের ইলিশকে ‘পদ্মার ইলিশ’ লেবেল লাগিয়ে খুচরায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা হচ্ছে।

জাতীয় মৎস্য শ্রমিক অধিকার ফোরামের এস এম জাকির হোসেন বলেন, ‘ক্রেতাদের মনে মৌসুমের শুরুতে ৩ হাজার ৫০০ টাকায় ইলিশ কেনার স্মৃতি থেকে যায়। পরে দাম কমলেও তারা মনে করেন দাম যথেষ্ট নেমেছে। বিক্রেতারা এই মানসিকতাকে কাজে লাগাচ্ছেন।’ অন্যদিকে মেঘনা ও পদ্মা নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও জেলেরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। তারা অভিযোগ করছেন, আড়তদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরাই আসল লাভবান হচ্ছেন।

সাগরের ইলিশের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বরগুনার ট্রলার মালিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, একটি ট্রলার তৈরি করতে লাগে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা যার আয়ুষ্কাল প্রায় ১০ বছর। প্রতি সমুদ্রযাত্রায় তেল, বরফ, বাজার এবং দাদনের জন্য খরচ হয় ৬-৭ লাখ টাকা।

তিনি জানান, একটি ট্রলার বছরে গড়ে ৪-৫ বার সমুদ্রে যেতে পারে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে ট্রলারের ডোবার ঝুঁকি সবসময় থাকে। এছাড়া ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যায় না, জাল ও ট্রলারের কোনো বীমাও নেই। ফলে এসব খরচ পুষিয়ে নিতে ইলিশের দাম বাড়িয়ে ধরা হয়।

‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর গবেষণা বলছে, গত কয়েক দশকে মাছের উৎপাদন ৪-৫ গুণ বেড়েছে। অথচ জেলেদের জীবনমানের কোনো উন্নতি হয়নি। বরং দাদন আর উচ্চ সুদের ঋণের ফাঁদে পড়েছেন তারা।

৪০ বছরের অভিজ্ঞ জেলে নজরুল মাঝি বলেন, ‘আমরা সবাই শূন্য ভাগি। এই বচ্ছর তিন খ্যাপে গেছি, একবারও বাজার খরচ ওঠেনি। মাছ না পেয়ে ঘাটে ফেরত আসলে মনে হয় ঘরে কী মুখ দেখাবো। বাচ্চারা আশা করে বাবা মাছ ধরেছে, টাকা আনবে; কিন্তু খালি হাতে ফেরত আসতে হয়।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশের বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য প্রথমত সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। জেলেদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা দাদন বা মধ্যস্বত্বভোগীর চাপ ছাড়া মাছ বিক্রি করতে পারে। এছাড়া, পাচার ও অবৈধ রপ্তানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

তারা মনে করেন, কোল্ডস্টোরে মজুত ও দামের কৃত্রিম স্থিতিশীলতা প্রতিরোধ করতে সরকারকে বাজার পর্যবেক্ষণ ও নীতি প্রণয়ন করতে হবে। রপ্তানি নীতিকে স্থানীয় বাজারের সরবরাহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা জরুরি, যাতে সাধারণ মানুষ মৌসুমে ইলিশ খেতে পারে। জেলেদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং ঋণ ব্যবস্থাও শক্তিশালী করতে হবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ