ফিরে দেখা: ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বময় কৃতিত্ব
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর সংঘটিত ১৭ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, সেই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এই যুদ্ধকে ‘দ্বিতীয় কাশ্মীর যুদ্ধ’ও বলা হয়। এ যুদ্ধে বাঙালি-প্রাধান্যকৃত প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈনিক এবং পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বাঙালি বিমানসেনা বিশেষত পাইলটদের বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ সামরিক কৃতিত্ব (নন-মার্শাল রেস থিওরির ধারণা ভেঙে দিয়ে) সামরিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিল। একই সঙ্গে, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যে অত্যন্ত অরক্ষিত-এই বিষয়টি ব্যাপকভাবে তখন আলোচনায় আসে। এই নিবন্ধে মূলত বাঙালি সৈনিকদের বীরত্ব ও কৃতিত্বের কথা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
এক মর্মস্পর্শী বিদায় উৎসব- আগস্ট, ১৯৪৭
ভারতের মাটিতে ইংরেজরা খুব যত্ন করে যে কটি প্রতিষ্ঠান গড়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে আদরের ধন ছিল বোধহয় ‘ভারতীয় সেনাবাহিনী’ বা ‘ইন্ডিয়ান আর্মি’। ১৯৪৭ এর মধ্য আগষ্টে সেই সেনাবাহিনী দুই দেশ অর্থাৎ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। দেশময় যেখানে যত সেনানিবাস আর ছাউনি আছে সর্বত্রই তখন হিন্দু, শিখ ও মুসলমান অফিসারদের মধ্যে বিদায়বেলার, কোলাকুলি শুরু হয়ে গেছে। সবাই সবাইকে শেষ নমস্কার-সালাম জানাচ্ছে। চলছে বিশাল ‘বড় খানা’, একত্রে কুচকাওয়াজ, ভাঙড়া নাচ...। রাওয়ালপিন্ডিতে এমন বড় একটা মিলনোৎসব অনুষ্ঠিত হলো।
তবে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বিদায় উৎসব অনুষ্ঠিত হলো দিল্লি জিমখানা ক্লাবের বলরুমে। অবশেষে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি পর্ব এগিয়ে গেল। সেদিন পার্টিতে সবাই এমনভাবে মিলেমিশে গিয়েছিল যে বোঝা যায়নি-ওরা ভারত ও পাকিস্তানে পৃথক হতে চলেছে। আবেগে উচ্ছসিত হয়ে পরস্পরকে মনে করিয়ে দিয়েছে পরবর্তী কোন আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের কথা। ‘তাহলে সেপ্টেম্বরের শিকারের সময় দেখা হচ্ছে তো। অথবা লাহোরের পোলো খেলার কথা ভুলোনা কিন্তু। কিংবা এবার কিন্তু কাশ্মীরে গিয়ে বুনো ছাগল শিকার করতেই হবে।’ এভাবে সেই সময়ের বিদায়ী পার্টির বর্ণনা দিয়েছেন, লেখক-ল্যারি কলিন্স ও ডোমিনিক ল্যাপিয়ার তাদের বিখ্যাত ‘ফ্রিডম অ্যাট মিড নাইট’ গ্রন্থে।
পোলো গ্রাউন্ড নয়, তাদের দেখা হলো কাশ্মীরের রণাঙ্গনে
এদিকে বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠেছে। ডায়াসের ওপর দাঁড়িয়ে হিন্দু ব্রিগেডিয়ার কে এম কারিয়াপ্পা (পরে ভারতের সেনা প্রধান, ফিল্ড মার্শাল) বললেন- ‘আমরা চিরকাল সহোদর ভাই এবং যেখানেই থাকি ভাই হয়েই থাকবো। আমরা কখনো সেই মহান দিন গুলোর কথা ভুলবনা, যখন আমরা এক হয়ে বাস করেছি।’ আবেগের সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার কারিয়াপ্পা রুপোর ট্রফি তুলে দিলেন মুসলিম ব্রিগেডিয়ার আগা রাজার হাতে। অর্কেস্ট্রায় তখন স্কটিশ বিদায় সংগীত ‘ওল্ড লং সিনস’ বা পুরোনো সেই দিনের কথার সুর বেজে উঠলো; কিন্তু এর মাত্র ১৪ মাস পর, ১৯৪৮ এর অক্টোবরে তাদের সাক্ষাৎ হবে দুঃখজনক এক পরিস্থিতিতে। ঘুণাক্ষরেও দুপক্ষ সেদিন তা আঁচ করতে পারেনি। লাহোরের পোলো খেলার মাঠ নয়, তাদের (দুই সেনাবাহিনীর) সাক্ষাৎ হলো কাশ্মীরের রণাঙ্গনে। এর ১৭ বছর পর (১৯৬৫) আবার তাদের দেখা হবে। কাশ্মীর, লাহোর, শিয়ালকোট রণাঙ্গনে...।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের পর ক্যাপ্টেন আব্দুল গনিসহ (পরবর্তীতে মেজর) সেই সময়ের কয়েকজন বাঙালি মুসলমান সেনা কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের জন্য একটি ‘রেজিমেন্ট’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যার নামকরণ করা হয় ‘দি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকার কুর্মিটোলায় (দারোগা বাগিচা) ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন- ‘১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ‘সিনিয়র টাইগার্স’ নামে পরিচিত। সাধারণভাবে এটি ‘ফাস্ট বেঙ্গল’ নামেও ব্যাপকভাবে পরিচিত। এর প্রথম অধিনায়ক ছিলেন- লে. কর্নেল ভি জে ই প্যাটারসন।
বেদিয়ান এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থানে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল
১৯৬৫ সালে ১ম ইস্ট বেঙ্গল লাহোর সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। তখন এর অধিনায়ক ছিলেন চৌকস বাঙালি সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল আবু তাহের খায়রুল হক সংক্ষেপে এ টি কে হক, পিএসসি (পরে কর্নেল, ‘সিতারায়ে জুরাত’)। কর্নেল এ টি কে হক পরবর্তীতে বার্মায় পাকিস্তানের ‘ডিফেন্স অ্যাটাশে’ নিয়োজিত ছিলেন এবং ১৬ এপ্রিল, ১৯৬৮ সালে রেঙ্গুনে মৃত্যুবরণ করেন। ব্যাটালিয়নের উপাধিনায়ক ছিলেন দেশের রাখাইন জাতি গোষ্ঠির একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান মেজর মঙ ক্য উ (পরে লে. কর্নেল)। স্বাধীনতার পর লে. কর্নেল মঙ ক্য উ ঢাকার স্টেশন কমান্ডার ছিলেন (১৯৭২-৭৩) এবং পরবর্তীতে বিআরটিসিতে নিযুক্ত হয়েছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমান (পরে লে. জেনারেল, বীর উত্তম, সেনাপ্রধান, প্রেসিডেন্ট) ছিলেন এ বা আলফা কোম্পানীর ‘কোম্পানী কমান্ডার’। সুবেদার মেজর ছিলেন মো. খুরশীদ। এই সময় ইউনিটের জনবল ছিল প্রায় ৭৫০ এর কাছাকাছি। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২ জন ছাড়া সবাই ছিলেন বাঙালি।
পাকিস্তান ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ‘বিরোধপূর্ণ’ কাশ্মীরে ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ নামে গোপন অভিযান শুরু করে। এই সময় সশস্ত্র গেরিলাদের জম্মু ও কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করানো হয়। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল শুধু কাশ্মীর অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে স্থানীয় যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ ব্যর্থ হওয়ায়, ১ সেপ্টেম্বর তারিখ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কাশ্মীরে ‘অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যাম’ শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে, ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের পাঞ্চাব প্রদেশে আক্রমণ করলে পূর্ণমাত্রায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের শুরু থেকে ভারতীয় বাহিনী প্রাধান্য দেখিয়ে লাহোরের দিকে এগিয়ে যায়। পাকিস্তান কাশ্মীর ফ্রন্টে অধিকতর গুরুত্ব দেয়ায় লাহোর ও শিয়ালকোট ফ্রন্টে মোকাবিলার জন্য তেমন প্রস্তুত ছিল না।
ভারতীয় বাহিনীর লাহোর অঞ্চলে আক্রমণের (অপারেশন রিডল) পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে, ৪ সেপ্টেম্বর রাতে ১ম বেঙ্গল লাহোরের প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে কাসুর জেলার বেদিয়ান এলাকায় (খেমকরন সেক্টর) প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। ১ম ইস্ট বেঙ্গল ছিল, লাহোর সেনানিবাসের ১১ পদাতিক ডিভিশনের আওতাধীন ১০৬ পদাতিক ব্রিগেডের অংশ। এই ব্রিগেডের ‘কমান্ডার’ ছিলেন ব্রিগেডিয়ার নওয়াজিস আলি। ভারতের পূর্বে পাঞ্জাব থেকে লাহোরে আসার ৩টি রাস্তা বা এপ্রোচের অন্যতম হলো: খেমকরন-ফিরোজপুর-কাসুর-লাহোর। এই এপ্রোচটি রক্ষার দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিল ১১ পদাতিক ডিভিশন। এদিকে, ভারতের অমৃতসর থেকে ওয়াগা হয়ে লাহোর শহরমুখী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড বা জিটি রোডের রক্ষার দায়িত্বে ছিল ১০ পদাতিক ডিভিশনের। ভারতের ৪ মাউন্টেন ডিভিশন খেমকরণ-কাসুর অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করছিল।
অধিনায়ক লে. কর্নেল এটিকে হক, ব্যাটালিয়নের ৪টি রাইফেল কোম্পানিকে কোন গভীরতা না রেখে বিস্তৃত এলাকা ধরে বেদিয়ান-ওয়াইজল এলাকায় ‘বিআরবি ক্যানেল’ (বাম্বাওয়ালি-রাভি-বেদিয়ান ক্যানেল) এর পশ্চিমতীরে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। বিআরবি ক্যানেল বা খালের কয়েকশত গজ আগেই দুই দেশের সীমান্ত রেখা। ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন করা হয় ইব্রাহিমাবাদে।
উল্লেখ্য, এই ব্যাটালিয়ন ১৯৬৫ সালের জুনে জরুরি অবস্থার সময় (অপারেশন স্পেয়ার হেড) কাসুরের নিজ অপারেশন এলাকায় মোতায়েন ছিল। আভিযানিক এলাকার সঙ্গে ভালো পরিচিতি থাকায় প্রকৃত যুদ্ধের খুব অল্প সময়ে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি ও অপারেশন পরিচালনা সহায়ক হয়েছিল।
ভারতীয় আক্রমণ ও বীরোচিত প্রতিরোধ
৬ সেপ্টেম্বর ভোর ৪ টায় ভারতীয় বাহিনী পদাতিক, ট্যাংক ও বিমানবাহিনীর সাহায্যপুষ্ট হয়ে ১ম বেঙ্গলের বেদিয়ান হেডওয়ার্কস (ছোট ব্যারেজ) এলাকায় আক্রমণ করে; কিন্তু অতন্ত্র প্রহরীর মতো প্রতিরক্ষায় অবস্থানরত বঙ্গশার্দুলদের সহযোগিতায় ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করা হয়। দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা পর ভারতীয় বাহিনী পিছু হটে। এই সংঘাতে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কয়েক ঘণ্টা বিরতির পর ৬ সেপ্টেম্বর সমস্ত দিন এমনকি রাত পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনী এই ইউনিটের প্রতিরক্ষা এলাকা দখল করতে পুনঃ পুনঃ আক্রমণ চালায়; কিন্তু প্রতিবারই তারা যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
তৎকালীন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন ছিলেন তখন ব্যাটালিয়নের ‘অ্যাডজুট্যান্ট’। অনেক বছর পরে, এই যুদ্ধ শুরুর পরিবেশ পরিস্থিতি তার কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়। এই যুদ্ধ নিয়ে এক আলাপচারিতায় লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন এই নিবন্ধকারকে বলেন- ‘৬ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে, আনুমানিক ৩:৪০ এর দিকে আমাদের ব্যাটালিয়নের সামনে (পূর্বে) অবস্থানকারী সীমান্তরক্ষী ‘সাতলেজ রেঞ্জার্স’ এর দায়িত্বরত পোস্ট কমান্ডার আমাকে ভারতীয় আক্রমণের কথা জানান। আমি ঘটনাটি সঙ্গে সঙ্গে ১০৬ ব্রিগেডের ‘ব্রিগেড মেজরকে’ জানাই। এর পর পরই আমাদের ব্যাটালিয়নের উপর ভারতীয় আর্মির ‘শেলিং’ শুরু হয়’’।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে অধিনায়ক ১ম বেঙ্গল, একটি উদ্ভাবনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেন। তারা সুকৌশলে বেদিয়ান হেডওয়ার্কসের স্লুইস গেট ব্যবহার করে ব্রিটিশ আমলে তৈরি (তখন অব্যবহৃত) ‘আপার বারি দোয়াব ক্যানেলে’ (ইউবিডিসি) পানি প্রবাহিত করে। ফলে ক্যাথানওয়ালা এলাকা পানিতে ডুবে যায় ও ভারতীয় আক্রমণকারীদের জন্য পানির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
একটি বাইনোকুলার...
সিলেট নিবাসী হাবিলদার লুৎফর রহমান চৌধুরী (পরবর্তীতে অনারারী ক্যাপ্টেন) তখন আলফা কোম্পানীতে কর্মরত ছিলেন। একদিন গভীর রাতে ব্যাটালিয়নের সামনে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি রেকি (অনুসন্ধান) টহল, প্রতিরক্ষা এলাকার সামনে (আখক্ষেতে) গোপনে তথ্য সংগ্রহ করতে এলে তারা ১ম ইস্ট বেঙ্গলের একটি টহল দলের মুখোমুখি হয়। ফাস্ট বেঙ্গলের চৌকস টহল দলটি অত্যন্ত কৌশল ও সাহসিকতার সঙ্গে ভারতীয়দের আটক করে ও ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসে। এই দলের অন্যতম সাহসী সদস্য, লুৎফর রহমান চৌধুরী ইউনিট কর্তৃপক্ষের কাছে ভারতীয় টহল প্রধানের ‘বাইনোকুলারটি’ তাকে প্রদানের আরজ করেন। কর্তৃপক্ষ তার অদ্ভুত অনুরোধটি রক্ষাও করেছিলেন! এর বহু বছর পর, ২০০২ সালে সিলেট সেনানিবাসে অনারারি ক্যাপ্টেন লুৎফর রহমান চৌধুরী যুদ্ধের স্মৃতিচারণ কালে ঘটনাটি এই নিবন্ধকারকে জানান। বহুদূরের বিআরবি ক্যানেলের বেদিয়ান প্রান্তরে প্রাপ্ত ‘বাইনোকুলারটি’ সুরক্ষিত রইলো সুরমা তীরবর্তী সিলেট শহরে।
১৭ দিনের যুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যর্থতার পরও ভারতীয় বাহিনী ব্যাটালিয়নের ওপর কয়েকবার আক্রমণ চালিয়েছিল; কিন্তু দুর্ধর্ষ বঙ্গ শার্দুল বাহিনী প্রতিবারই তাদের প্রতিহত করে পিছু হটিয়ে দেয়। ভারতীয় বাহিনী কখনোই বিআরবি ক্যানেল অতিক্রম করতে পারেনি।
যুদ্ধে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্ব ও কৃতিত্ব
উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকার বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে একটি ‘রেজিমেন্ট’ (পল্টন) গঠনের উদ্যোগ নেয়। এরই প্রেক্ষিতে, ১৯১৭ সালের ২৬ জুন রেজিমেন্টের প্রথম বাঙালি ব্যাটালিয়ন ‘৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট’ বা ‘৪৯তম বেঙ্গলিজ’ গঠন করা হয়। করাচি থেকে এই ইউনিট পরবর্তীতে মেসোপোটেমিয়া ও কুর্দিস্তানে (ইরাকে) যুদ্ধ করতে যায়। উল্লেখ্য, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই ব্যাটালিয়নে (করাচিতে) প্রায় ৩০ মাস চাকরি করেন। তার সর্বশেষ পদবি ছিল ‘হাবিলদার’। ৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ইরাকে গেলেও কবি নজরুল ইরাকে যাননি। তার কর্মস্থল ছিল করাচিতে। নজরুলই প্রথম বাংলা সাহিত্যে যুদ্ধের বাস্তব সম্মত বর্ণনা প্রদান করেন।
বিশ্বযুদ্ধ শেষে, ১৯২০ সালের অক্টোবরে পল্টনটিকে ভেঙে দেওয়া হয়। ইরাকে দায়িত্ব পালনকালে পল্টনের অনেক সৈনিকের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা গিয়েছিল। সীমিত প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, নেতৃত্বের দুর্বলতা, শৃঙ্খলাজনিত কিছু সমস্যা ও আরও কিছু কারণে পল্টনটি যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য সামরিক কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, সেই সময়ের প্রবল একটি সামাজিক আন্দোলনের ফসল ছিল এই বাঙালি পল্টন। এ বিষয়টি নিয়ে লে. কর্নেল মুহাম্মদ লুৎফল হক লিখেছেন অসামান্য এক গ্রন্থ- ‘বাঙালি পল্টন: ব্রিটিশ ভারতের বাঙালি রেজিমেন্ট’ (২০১২)। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত এই ‘৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট’ যুদ্ধক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য প্রদর্শন না করতে পারলেও ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ তথা ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেদিয়ান-খেমকরণ’ রণাঙ্গনে অসাধারণ বীরত্বের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল।
অনারারি ক্যাপ্টেন আবুল হাসেম-বীর বিক্রম, টিজে
এই যুদ্ধে ‘ফাস্ট বেঙ্গলের’ বিভিন্ন পদবির ১৫জন সেনা সদস্য শাহাদত বরণ করেন। তাদেরকে লাহোর সেনানিবাসের কবরস্থানে (লাহোর মেমোরিয়াল) সমাহিত করা হয়। এই যুদ্ধে সিপাহী (পরে অনারারী ক্যাপ্টেন) আবুল হাসেম সাহসীকতার স্বীকৃতি স্বরূপ ‘তঘমায়ে জুরাত’ বা ‘টিজে’ খেতাব লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য ‘বীর বিক্রম’ খেতাব প্রাপ্ত হন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে তিনি ছিলেন ডি কোম্পানীর ট্যাংক-বিধ্বংসী রিকয়েলেস রাইফেলের (আরআর) দায়িত্বে। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বর্তমানে বসবাস করছেন প্রবীণ অনারারি ক্যাপ্টেন আবুল হাসেম। অস্তরাগে তার স্মৃতিতে এখন সমুজ্জল... বেদিয়ানে প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ক্রমাগত ভারতীয় ট্যাংক ও বিমান আক্রমণ, বৃষ্টির মতো গুলি, রণাঙ্গনে মৃত্যুর বিভীষিকা ও বাঙালি সৈনিকের বীরত্ব...।
কর্নেল এম এ জি ওসমানী (পরে জেনারেল ও মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ) তখন রাওয়ালপিন্ডির সেনাসদরে ‘ডেপুটি ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশন’। জানা যায় যে, যুদ্ধের এক পর্যায়ে কর্নেল ওসমানী বেদিয়ান অঞ্চলে এসেছিলেন। ফাস্ট বেঙ্গলের একদল অফিসার ও সৈনিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন- ‘এটা তোমাদের জীবনের চরম সুযোগ। তাদের দেখাও তোমরা কি ধাতুতে গড়া’। কর্নেল ওসমানীর কথা রেখেছিলেন ফাস্ট বেঙ্গলের দুর্ধর্ষ সৈনিকরা। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের সকল ইউনিটের মধ্যে ১ম বেঙ্গল ১৫ টি বীরত্বসূচক খেতাব লাভ করে, যা ছিল সর্বোচ্চ।
এই সময় তরুন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন (পরে লে. কর্নেল, বীর উত্তম) ‘অ্যাডজুট্যান্ট’ হিসেবে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন সাদেকুর রহমান চৌধুরী (পরে মেজর জেনারেল) অসাধারণ দক্ষতার জন্য ‘টিকিউএ’ বা ‘তঘমায়ে কায়েদে আজম’ খেতাব লাভ করেন। এর প্রায় ১০ বছর পর এই দুই ‘ক্যাপ্টেনের’ দেখা হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের (বান্দরবান) রণাঙ্গনে। তবে তখন দুইজন দুই বিপরীত বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন। সে এক অদ্ভুত ইতিহাস। ব্যাটালিয়নের সবচেয়ে কনিষ্ঠ অফিসার ছিল আলফা কোম্পানীতে কর্মরত সেকেন্ড লে. মাহমুদুল হাসান (পরে মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত)। তিনিও এই যুদ্ধে দারুণ সাহস ও দ্ক্ষতার পরিচয় দেন।
মেজর জেনারেল সাদেকুর রহমান চৌধুরী ১৯৮২ সালে সেনাবাহিনীর ‘অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল’ হিসেবে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে এসে এক বক্তৃতায় ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ-অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। একজন ক্যাডেট হিসেবে তখন এই ভ্যাটেরানের কাছ থেকে এই যুদ্ধের কথা শোনার সুযোগ হয়েছিল।
একজন সাহসী ‘কোম্পানি কমান্ডার’
এই যুদ্ধ নিয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান লেখেন- ‘সে সময়ে আমি ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার। খেমকারান রণাঙ্গনের বেদিয়ানে তখন আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়ন বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিল। ব্যাটালিয়নের পুরস্কার বিজয়ী কোম্পানী ছিল আমার কোম্পানী। পাকিস্তানীরা ভাবতো বাঙালীরা ভালো সৈনিক নয়। খেমকারানের যুদ্ধে তাদের এই বদ্ধমূল ধারনা ভেঙ্গে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেছে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর বাঙালী পাইলটরাও অর্জন করেছিল প্রচুর সুনাম। বাঙালি সৈনিকের বীরত্ব্ ও দক্ষতার প্রশংসা হয়েছিল তখন বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নাম’’। (একটি জাতির জন্ম, বিচিত্রা, ২৬ মার্চ, ১৯৭৪)। এই যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য, একটি ঘটনা হলো মেজর জিয়াউর রহমানের এ কোম্পানী নিজেদের গোলায় বিধ্বস্ত ট্যাংক উদ্ধার করে রণক্ষেত্র থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। বর্তমানে এই ট্যাংকটি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে রক্ষিত আছে।
পদাতিক ও বিমান যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে তখন ট্যাংক যুদ্ধও ছিল অত্যন্ত আলোচিত বিষয়। বাঙালি সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল এম আই করিম (পরে মেজর জেনারেল) খেমকরন সেক্টরে একটি ট্যাংক ইউনিটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
মোগলহাট অঞ্চলে সীমান্ত-সংঘর্ষ
এই যুদ্ধ মূলত পশ্চিম পাকিস্তানেই সীমিত ছিল। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ আঁচ পূর্ববাংলার মানুষের গায়ে লাগেনি। শুধুমাত্র ঢাকা বিমান ঘাঁটি থেকে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের পশ্চিম বঙ্গের ‘কালাইকুন্ডা’ বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। ভারত থেকে এ অঞ্চলে কোন আক্রমণ পরিচালনা করা হয়নি। তবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রংপুর জেলার (বর্তমানে লালমনিরহাট জেলার) মোগলহাট সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষীর সঙ্গে তৎকালীন ইপিআর ও ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের মধ্যে সীমিত পর্যায়ে গোলাগুলি, মর্টার আক্রমণ ও সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছিল। এই সময় লালমনিরহাট অঞ্চলে ইপিআরের ৯ নং উইং (ব্যাটালিয়ন) এর অধিনায়ক ছিলেন মেজর এম, এ হামিদ (পরবর্তীতে লে. কর্নেল)। এ বিষয়টি লে. কর্নেল এম, এ হামিদ তার গ্রন্থ- ‘ফেলে আসা সৈনিক জীবন’ এ উল্লেখ করেছেন।
আকাশ যুদ্ধে বাঙালি বিমান সেনাদের গৌরবজনক ভূমিকা
সংখ্যার দিক থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনী এগিয়ে থাকলেও বিমান ও পাইলটের মানে পাকিস্তান বিমানবাহিনী এগিয়ে ছিল। আকাশ যুদ্ধে বাঙালি ফাইটার পাইলটরা অসাধারণ দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। স্কোয়াড্রন লিডার এম এম আলম (পরে পাকিস্তানে এয়ার কমডোর) ৭ সেপ্টেম্বর ৫টি ভারতীয় বিমান ধ্বংস করে রীতিমতো ‘নায়কে’ পরিণত হয়েছিলেন। এই ‘উর্দুভাষী’ বাঙালি পাইলট তখন বিশ্বের ‘দ্রুততম জেট ACE’ খেতাবপ্রাপ্ত হন। সাহসিকতার জন্য এম এম আলম ছিলেন পাকিস্তানি এয়ারফোর্সের সর্বাধিক উচ্চারিত নাম। বাঙালি পাইলটদের (১৪ জন) সঙ্গে সঙ্গে বিমানবাহিনীর বাঙালি নেভিগেটররাও (৯ জন) অসাধারণ দক্ষতা ও পেশাগত মানের পরিচয় দিয়েছিলেন। সে এক অন্য ইতিহাস।
স্কোয়াড্রন লিডার আলাউদ্দিন আহমেদ, ফ্লাইট লে. সাইফুল আজম (পরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন), উইং কমান্ডার গোলাম মোহাম্মদ তাওয়াব (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল ও বিমানবাহিনীর প্রধান), ফ্লাইট লে. এম শওকাত-উল-ইসলাম (পরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন) ও ফ্লাইট লে. মমতাজ উদ্দিন আহমেদসহ (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল ও বিমানবাহিনী প্রধান) ১৪ জন বাঙালি পাইলট বিমান যুদ্ধে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন।
বিমানবাহিনীর তরুণতম ফ্লাইং অফিসার জিয়া উদ্দিন হাসান ছিলেন বিমান যুদ্ধে ‘সিতারায়ে জুরাত’ এর গৌরবধারী সবচেয়ে কনিষ্ঠ বিমানবাহিনী কর্মকর্তা। এই সাহসী বিমান সেনা ১৯৭১ এর মার্চে (তখন ফ্লাইট লে.) মৌরিপুরে এক বিমান দূর্ঘটনায় মারা যান। এদিকে ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তারই অনুজ সেকেন্ড লে. জামিল ডি আহসান (পরে বীর প্রতীক, মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত) সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
অবিশ্বাস্য এক যাত্রা: এক জঙ্গি বৈমানিকের রোমাঞ্চকর কাহিনি
গ্রুপ ক্যাপ্টেন শওকাত-উল-ইসলাম তার স্মৃতি কথামূলক গ্রন্থ ‘My Incredible Journy’ এর বাংলা অনুবাদ ‘অবিশ্বাস্য এক যাত্রা-এক জঙ্গী বৈমানিকের রোমাঞ্চকর কাহিনি’ বইতে এই যুদ্ধের চমৎকার স্মৃতিচারণ করেন। তিনি সেই সময় বিখ্যাত ১১নং স্কোয়াড্রনের সদস্য ছিলেন। যা সেই সময় সারগোদায় অবস্থিত ছিল। যুদ্ধের সময় বিখ্যাত পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার এম এম আলম ছিলেন এই স্কোয়াড্রনেরই পাইলট। এই যুদ্ধে লেখকের পরিচালিত মিশনগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল মমতাজ উদ্দিন আহমেদ তার গ্রন্থ ‘কন্সপিরেসি বিহাইন্ড দি ককপিট: ওডেসি অব এ ফাইটার পাইলট’ এ ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তরুন মমতাজ উদ্দিনের প্রথম মিশন ছিল ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে লাহোরের পূর্ব দিকে ওয়াগা সীমান্তে অগ্রসরমান ট্যাংকে আক্রমণ পরিচালনা করা।
যুদ্ধে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা
এই যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল যুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তান সরকারের ব্যাপক প্রচারণা। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া বেতার ভাষণে দেশবাসী প্রথম বিষয়টা জানতে পারে। ভাষণে ভারতকে ‘আক্রমণকারী’ হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। এই যুদ্ধ কেন্দ্র কবে উভয় অংশে এক ধরণের ‘ধর্মীয় জোস’ সৃষ্টি করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো (পরে প্রধানমন্ত্রী) জাতিসংঘে ভারতের বিরুদ্ধে ‘হাজার বছর ধরে যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী রাজনীতিকরা এ সময় দলমত নির্বিশেষে ভারতীয় হামলার নিন্দা করেন এবং আক্রমণ মোকাবিলায় সরকারী পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরদিন একবার এবং যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হওয়ার পর আরেকবার মোট দুবার নুরুল আমীন, আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিরোধী নেতৃবৃন্দ গভর্নর মোনায়েম খানের আমন্ত্রণে গভর্নর হাউজে তার সঙ্গে দেখা করে যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে মত বিনিময় করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের লেখক বুদ্ধিজীবিরা ভারতীয় হামলার নিন্দা ও সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টার সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করে বিবৃতি দেন।
‘যুদ্ধ চলল রেডিও মারফত’
লেখক-গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান তার ‘স্বাধীনতার পটভূমি ১৯৬০ দশক’ গ্রন্থে-১৯৬৫ সালের যুদ্ধের প্রচার প্রচারণা নিয়ে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। কবি লেখকদের অনেকেই এ সময় পত্র পত্রিকা ও রেডিও টেলিভিশনে ভারত বিরোধি প্রচার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এ উপলক্ষে অজস্র কবিতা গান, গল্প ও নাটিকা ইত্যাদি রচিত হয়। এ প্রসঙ্গে আতাউর রহমান খান লিখেছেন- ‘‘পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ চলল রেডিও মারফত। কবিতা, গল্প, গান, নাটক, কথিকা, জারী প্রচার হতে লাগলো তুফানের বেগে। বহু আজগুবি গল্পও প্রচার হতে লাগল-রেডিও মারফত। সবই দেশাত্মবোধক’’। (আতাউর রহমান খান, স্বৈরাচারের দশ বছর)। জনসাধারণের একটা অংশ তা বিশ্বাসও করে ।
যুদ্ধ সাহিত্যের সন্ধানে
যুদ্ধ অবসানে পূর্ব পাকিস্তানি লেখক-সাংবাদিক একটি দল পম্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং পাকিস্তানী সৈন্যদের বীরত্বগাথা নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। এরকম দুটি গ্রন্থ হলো হাসান হাফিজুর রহমানের ‘সীমান্ত শিবির’ এবং মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক ও রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘রণাঙ্গন’ (১৯৬৬)। এসব লেখালেখি ও প্রচারণা নিয়ে মোরশেদ শফিউল হাসান লিখেন ‘‘ভবিষ্যতে কোন গবেষক কতৃক, সে গল্পগুলো সংগ্রহীত, সংকলিত ও বিশ্লেষিত হলে তা ‘যুদ্ধ সাহিত্য’ বা ‘প্রচারণা সাহিত্যের’ এক অত্যুৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের অনেক কৌতুহল নিবৃত্ত করতে পারবে (স্বাধীনতা পটভূমি ১৯৬০ দশক)।
পশ্চিম পাকিস্তানি কবি আগা শোরেশ কাশ্মীরি এ সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীরত্বের প্রশংসা করে কবিতা রচনা করেন। কাসুরে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত গায়িকা ও অভিনেত্রী নূর জাহান তার গানে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বের প্রশংসা করেন এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। যুদ্ধে বাঙালীর বীরত্ব পূর্ব বাংলার মানুষকে উদ্দীপ্ত করে। যুদ্ধ শেষে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। লাহোর রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য ১ম ইস্ট বেঙ্গলকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। যুদ্ধে বাঙালির এই বীরত্ব, আরও বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষে তার স্বীকৃতি, এই অঞ্চলের মানুষকে উদীপ্ত করে। তবে যুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই সরকারী মহল এ যুদ্ধকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ বা প্রচারণার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এই যুদ্ধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঙালির সামরিক ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তখনও প্রচলিত ছিল বাঙালিদের সম্পর্কে তথাকথিত 'নন-মার্শাল রেস' তত্ত্ব, বা ‘অযোদ্ধা জাতিতত্ত্ব’ যেখানে বলা হতো বাঙালিরা সামরিক অভিযানে যোগ্য নয়; কিন্তু বাস্তবে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা ও বাঙালি বিমানসেনাগণ সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে সেই ভ্রান্ত ধারণাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেন। এই যুদ্ধের পর এই অপবাদ থেকে বাঙালি সৈনিকদের মুক্তি ঘটে। এই দ্ক্ষতা ও কৃতিত্ব পাকিস্তানী কমান্ড কাঠামোর ভিতর থেকেও বাঙালিদের সক্ষমতার স্বীকৃতি আদায় করে নেন। যুদ্ধ-পরবর্তী পাকিস্তানি সামরিক মূল্যায়ন রিপোর্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লড়াই বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল-যা ছিল বাঙালিদের জন্য এক ঐতিহাসিক স্বীকৃতি।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সামরিক বাহিনীতে অধিক সংখ্যক বাঙালি তরুনদের নিয়োগের দাবি জানান। ১৯৬০-দশকের শেষের দিকে তিন বাহিনীতে বাঙালি তরুনদের যোগদানের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। গাজীপুরে একটি ‘সমরাস্ত্র কারখানার’ কাজ শুরু হয়। ঢাকায় গড়ে ওঠে ‘ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার’।
এ যুদ্ধের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার দুর্বলতা। পশ্চিম পাকিস্তান যখন ভারতের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে ব্যস্ত, তখন ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চল কার্যত অরক্ষিত ছিল। ভারতীয় সেনারা যদি পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে আক্রমণ চালাত, প্রতিরোধ করার মতো শক্তি ছিল না। এই বাস্তবতাই পূর্ববাংলায় রাজনৈতিক মহলে ও জনমনে গভীর প্রশ্ন তুলেছিল -আমরা কি শুধু পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য রক্ত দেব, অথচ আমাদের ঘরবাড়ি থাকবে অরক্ষিত?" এই প্রশ্ন পরবর্তীকালে বাঙালির আত্মনির্ভরতার বীজ বপনে ভূমিকা রাখে। অনেকে এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উদ্বেগের জবাবে তাদের পুরোনো বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করতে শোনা যায়। ‘‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে।’’ ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ এ অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে বলা যায়, এক গভীর ও সুদূর প্রসারি প্রভাব ফেলে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের আত্মবিশ্বাসকে নতুন মাত্রা দেয়। এই আত্মবিশ্বাসই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্র প্রতিরোধে রূপ নেয়।
প্রথম বেঙ্গল ও বিমানবাহিনীর পাইলট, নেভিগেটর ছাড়াও তিন বাহিনীর অনেক বাঙালি সদস্য বিভিন্ন ফ্রন্টে বীরত্ব ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ফলে সামগ্রীকভাবে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের মান মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায়। এটি বলা যায় যে, এই মনোবল ও স্পিরিট ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে দারুনভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো।
অতএব, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ কেবল পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়; এটি ছিল বাঙালির সামরিক সক্ষমতা ও আত্মপরিচয়ের এক মোড় ঘোরানো অধ্যায়। বাঙালি সৈনিকদের রক্ত ও বীরত্ব ভবিষ্যতের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অমূল্য ভিত্তি তৈরি করেছিল।
স্মরণ
এই যুদ্ধে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের ১৫ জন সদস্য শাহাদাতবরণ করেন। তাঁদের লাহোর সেনানিবাহে দাফন করা হয়। ১৯৬৫ এর পর চট্টগ্রামের ইবিআরসি সেন্টারে নির্মিত মসজিদের ফলকে ১ম বেঙ্গলের এই সৈনিকদের স্মরণ করা হয়েছে। এই যুদ্ধে ১ম ইস্ট বেঙ্গল ছাড়াও অন্য ইউনিট, সার্ভিসেরও বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার ও সৈনিক মৃত্যুবরণ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন- ১৯৫২ সালে কমিশনপ্রাপ্ত-শহীদ মেজর শেখ মোবারক আলী (১৬ পাঞ্জাব এর কোম্পানী কমান্ডার)। তিনি ১০ সেপ্টেম্বর ওয়াগা সেক্টরে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেন। শহীদ মেজর শেখ মোবারক আলীর কন্যা শাহিন আলী এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- ‘‘REMEMBERING MY FATHER SHAHEED MAJOR SHEIKH MOBARAK ALI’’ নামক প্রবন্ধে। (বাঁধন, ২০১৯, ঢাকাস্থ বনানী ডিওএইচএস কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিকি)। বিমানবাহিনীর মেধাবী কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লীডার আলাউদ্দিন আহমেদ আকাশ যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন।
শেষের কথা
৬০ বছর পূর্বে সংঘঠিত এই যুদ্ধের যেসব অফিসার ও সৈনিক যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি-তাঁরা এই জাতীর জন্য অনেক সম্মান এনেছিলেন। এই যুদ্ধ নিয়ে পরবর্তীতে (১৯৬০ এর দশকে) অনেক বই ও প্রবন্ধ লেখা হয়েছে; কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অধিকাংশ লেখাই অতিরঞ্জিত, প্রচারণামূলক, আবেগ পূর্ণ ও একপেশে। এখন প্রয়োজন হলো, এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের গবেষণা ধর্মী ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ-যেখানে উঠে আসবে এই যুদ্ধে বাঙালি সৈনিকদের অসাধারণ বীরত্বের কথা ও একটি সুসংহত চিত্র।
যতদূর জানা যায়, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ বাঙালি সামরিক সদস্যই মৃত্যুবরণ করেছেন। বিমানবাহিনীর কয়েকজন পাইলট ও নেভিগেটর এখনও আমাদের মধ্যে রয়েছেন; কিন্তু, কিছুদিন পর গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধের কথা বলার মতো আর কেউ থাকবেন না। আমাদের সামরিক ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কি কালের গর্ভে হারিয়েই যাবে?
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি: অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, গবেষক ও বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে