শাকিব খান: ‘গুলিস্তান থেকে গুলশান’ কতটা সবার হয়ে উঠতে পারলেন
মেগাস্টার শাকিব খান কি সত্যি সত্যি গুলিস্তান থেকে গুলশান- সবার নায়ক হয়ে উঠতে পারলেন? গুলিস্তান থেকে গুলশান- সবার নায়ক হওয়ার এই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে খোদ শাকিব খানেরই কথায়। ‘বরবাদ’ সিনেমার সফলতা উদযাপন অনুষ্ঠানে শাকিব খান বলেছেন- তার সিনেমা এখন গুলিস্তান থেকে গুলশান- সব শ্রেণির দর্শকরা গ্রহণ করছেন।
শাকিব খানের সিনেমার ক্যারিয়ার ২৬ বছরের। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ২৫০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ক্যারিয়ারের ব্যাপ্তি ও সিনেমার সংখ্যাটা যে কোনো সিনেমা তারকার জন্য সত্যি বিস্ময়কর; কিন্তু আরও আগ্রহোদ্দীপক হচ্ছে শাকিব খানের শেষ কয়েক বছরের ক্যারিয়ার গ্রাফ। শাকিব খানের ক্যারিয়ারে মূলত দুটি ভাগ আছে: এই ভাগ দুটির বিষয় পরিষ্কার হলে শাকিব খানের ক্যারিয়ারের এই টার্নিংটা বোঝা সহজ হবে।
১৯৯৯ সালে সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত শাকিব খানের প্রথম সিনেমা ‘অনন্ত ভালোবাসা’ থেকে ২০২৫-এর মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘তাণ্ডব’ পর্যন্ত তার ক্যারিয়ারকে আমরা মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি:
প্রথম ভাগ: ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৬।
দ্বিতীয় ভাগ: ২০১৬ সাল থেকে অদ্যাবধি।
প্রথম ভাগের ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে শাকিব খানের সফলতা ও অর্জন অনেক। সেই ভাগের শেষের দিকে তিনি ততদিনে সুপারস্টার- তার একার নামেই সিনেমা চলে। ১৬ বছরে ক্যারিয়ারে ঝুলিতে জমা পড়েছে কোটি টাকার কাবিন, প্রিয়া আমার প্রিয়া, আমার প্রাণের স্বামী, নাম্বার ওয়ান শাকিব খানসহ অনেক অনেক দুর্দান্ত ব্যবসা সফল সিনেমা। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ মেরিল প্রথম আলো ও অন্যান্য সব ধরনের বেসরকারি পুরস্কার; কিন্তু তখনো শাকিব খান গুলশানের- মানে উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত দর্শকের নায়ক হয়ে উঠতে পারেননি। তারা শাকিব খানের সিনেমা যেমন দেখতে চাইতেন না, তেমনি নায়ক হিসেবে তাকে গ্রহণও করতেন না। শাকিব খানকে নিয়ে প্রচুর ট্রল ও মিম তৈরি হতো। স্টার সিনেপ্লেক্সসহ বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্স তার সিনেমা চালাত না- এই অজুহাতে যে, তাদের দর্শকরা শাকিব খানের সিনেমা দেখেন না। সেই অবস্থান থেকে বর্তমানে সিঙ্গেল স্ক্রিনে তো বটেই মাল্টিপ্লেক্সের সবচেয়ে ব্যবসা সফল সিনেমাগুলোর সবই এখন শাকিব খানের।
শাকিব খানের এই আমূল পরিবর্তনটি শুরু হয় ২০১৬ সালে “শিকারী” সিনেমা মুক্তির মাধ্যমে। “শিকারী” একটি যৌথ প্রযোজনার সিনেমা যা পরিচালনা করেছিলেন জয়দেব মুখার্জি। সিনেমাটি যৌথ প্রযোজনার হলেও নির্মাণ হয়েছিল কলকাতার পরিচালক ও কলাকুশলীদের দ্বারাই। এই সিনেমায় শাকিব খানকে প্রথম দেখা যায় একেবারে পুরোপুরি ভিন্নরূপে, পূর্বে শাকিব খানের উচ্চকিত অভিনয়-পোশাক-বাচনভঙ্গি এসব নিয়ে যে সমালোচনা হতো সেগুলোকে পুরোপুরি কাটিয়ে উঠে, “শিকারী” সিনেমা দিয়ে শাকিব খান স্মার্ট রূপে দর্শকের সামনে হাজির হয়ে প্রথম নজর কাড়েন উচ্চবিত্ত-শিক্ষিত দর্শকদের।
এর পর সম্রাট, বসগিরি, মেন্টাল, রংবাজ এসব বাংলাদেশি সিনেমায় আগের ও পরের দুই শাকিব খানের মিশেল পাওয়া যায়। কারণ এসব সিনেমার অনেকগুলোই ছিল পূর্বে নির্মাণ শুরু হওয়া অথবা পূর্বে পরিকল্পনা করা সিনেমা। এই সময় যৌথ প্রযোজনায় আরও দুটি সিনেমা মুক্তি পায়। ২০১৭ সালে মুক্তি পায় জয়দেব মুখার্জি পরিচালিত সিনেমা “নবাব”। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় একই পরিচালকের সিনেমা “চালবাজ” ও “ভাইজান এলোরে”। এ বছরই মুক্তি পায় রাজিব বিশ্বাসের সিনেমা “নাকাব”। এই সিনেমাগুলো শাকিব খানকে নতুনভাবে উপস্থাপন করলেও সব একই রকমের ব্যবসা সফল ছিল না। বরং ক্রমশ এসব সিনেমার ব্যবসার সফলতা কমতে শুরু করে। অন্যদিকে এসব সিনেমায় শাকিব খানের স্ক্রিন প্রেজেন্স বদলালেও দর্শকের মনে ইমেজ পরিবর্তন হয় না। কারণ এসব সিনেমার একই সঙ্গে মুক্তি পাচ্ছিল পাংকু জামাই, আমি নেতা হবো, ক্যাপ্টেন খান, বা মনের মতো মানুষ হইলাম না- এর মতো সিনেমা যা শাকিব খান ক্যারিয়ারের প্রথম ভাগের সিনেমার ধাঁচে নির্মিত। সেসব সিনেমার কোনোটা কোনোটায় শাকিব খানকে আগের রূপে মাঝে মাঝে দেখা যাওয়ায় ইমেজের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখা যাচ্ছিল না।
এই সময় শাকিব খানের বিয়ে ও সন্তানবিষয়ক বিভিন্ন স্ক্যান্ডাল, স্থায়ীভাবে আমেরিকায় চলে যাওয়ার খবর ও সর্বোপরি কোভিডের ফলে চলচ্চিত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া- শাকিব খানের ক্যারিয়ারকে এক প্রকার থামিয়েই দেয়। এই বিরতিতে একটি জোর সম্ভাবনা ছিল শাকিব খানের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার; কিন্তু সেটি না হয়ে সবাইকে অবাক করে শাকিব খান পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ান। কোভিডের সময় তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করে স্বাস্থ্য ঠিক করেন, দেশি-বিদেশি নানান সিনেমা দেখে সিনেমার রুচিকে সমৃদ্ধ করেন এবং সর্বোপরি সামনে কি ধরনের সিনেমা করবেন ও কোন কোন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করবেন তার একটি ছক কষেন।
এর ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে নিয়ে আসেন হিমেল আশরাফ পরিচালিত সিনেমা “প্রিয়তমা”। এই “প্রিয়তমা” শাকিব খানকে নতুন করে জন্ম দেয়। শাকিব খানের লুক ও স্ক্রিন প্রেজেন্সের পরিবর্তনটি ভারতীয় পরিচালক ও কলাকুশলীদের মাধ্যমে ঘটলেও এবার তা ঘটে বাংলাদেশের সিনেমা দিয়ে। প্রিয়তমার ফলে শুধু লুক নয়- শাকিব খানের ইমেজের পরিবর্তন হয়। বৃদ্ধ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে সুপারস্টার শাকিব খানের অভিনয় সত্ত্বা সবার সামনে উঠে আসে। প্রিয়তমা শুধু ব্লকবাস্টার হয়- তাই নয়- সিনেমার ব্যবসার সকল হিসাবও বদলে দেয়। এর মধ্যে শাকিব খানের পুরোনো কোনো সিনেমা না থাকায় শাকিব খান ভেবেচিন্তে নতুন সিনেমা হাতে নিতে থাকেন যেগুলো তাকে আরও বেশি করে নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে যেতে পারে।
২০২৪ সালে মুক্তি পায় শাকিব খানের তিনটি সিনেমা- রাজকুমার, দরদ ও তুফান। এর মধ্যে হিমেল আশরাফ পরিচালিত “রাজকুমার” সিনেমাটি দেশ ও বিদেশের প্লট, আমেরিকান নায়িকা, বিদেশে মানসম্পন্ন শ্যুট- সর্বোপরি ভালো গল্প এসব কারণে বাংলা কমার্শিয়াল সিনেমার জগতে একটি উল্লেখযোগ্য সিনেমা হিসেবে আখ্যা পায়; কিন্তু সিনেমাটি প্রিয়তমার মতো ততটা ব্যবসায়িক সফলতা পায়নি। তবে এই সময় শাকিব খানের হাতে ছিল রায়হান রাফি পরিচালিক “তুফান”-এর মতো সিনেমা যা সাউথ ইন্ডিয়ান মাসালা সিনেমার ফর্মুলায় নির্মিত হয়েছিল। তুফান সিনেমাটি সমালোচক মহলে প্রশংসিত না হলেও ব্যবসায়িকভাবে সফল হয় এবং শাকিব খানের অভিনয়ের ব্যাপক প্রশংসা হয়। এই সিনেমা দিয়ে শাকিব খান গুলশানের দর্শকের নায়ক হিসেবে জায়গা পোক্ত করেন।
এরপর চলে আসে জুলাই গণঅভ্যুত্থান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমির একটি বিরাট পরিবর্তন ঘটে। ফলে প্রায় ৫/৬ মাস নতুন সিনেমা মুক্তি বন্ধ হয়ে যায়। এই স্থবিরতা ভাঙে শাকিব খানের “দরদ” সিনেমা দিয়েই। অনন্য মামুন পরিচালিত যৌথ প্রযোজনার এই সিনেমাটি বোম্বেতে শ্যুট, হিন্দি সিনেমার নায়িকা, প্যান ইন্ডিয়া রিলিজ এসব নিয়ে অনেক হাইপ থাকলেও সিনেমা বক্স অফিসে তেমন সফলতা অর্জন করতে পারে না। ফলে শাকিব খানের ক্যারিয়ার আবার একটা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। ফলত পরের সিনেমাগুলো শাকিব খানের ক্যারিয়ারের নতুন যাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চলেছিল। এই সময় মুক্তি পায় মেহেদী হাসান হৃদয় পরিচালিত সিনেমা “বরবাদ”। বক্স অফিসে প্রিয়তমার মতো ঝড় তোলা বরবাদ সিনেমাটিতে শাকিব খানের অভিনয় খুব প্রশংসিত হয়। শাকিব খানের অভিনয় রীতি-পোশাক-স্টাইলে একটা আলাদা স্মার্টনেস দেখা যায়।
এরপর ২০২৫ সালের ঈদুল আজহায় মুক্তি পায় রায়হান রাফি পরিচালিত সিনেমা “তাণ্ডব”। সিনেমাটি পুরোপুরি বাংলাদেশে নির্মিত হয় দেশি কলাকুশলীদের দিয়ে। র্যাপ গান, অন্যরকমের ডান্স, মাংকি মাস্কের ব্যবহার - সঙ্গে ভিন্নধর্মী প্লট এই সিনেমাকে দর্শকের কাছে সমাদৃত করে। সিনেমা মুক্তির ছয় দিনের মাথায় এই সিনেমার এইচ ডি প্রিন্ট লিক না হলে তান্ডব - এর বক্স অফিস সফলতার পরিমাণটা আরো বাড়ত। তবে “তান্ডব” সিনেমাটি অদ্যাবদি শাকিব খানের সবচেয়ে স্মার্ট সিনেমা হিসাবে আখ্যা পেয়ে উচ্চবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত দর্শকের মধ্যে শাকিব খান এর অবস্থানটি আরো উপরে নিয়ে যায়।
বরবাদ থেকে তাণ্ডবের মধ্য দিয়ে শাকিব খান সত্যি সত্যি গুলিস্তান থেকে গুলশান সব ধরনের দর্শকের নায়ক হয়ে উঠেন। যদিও এই দুটি সিনেমা দিয়ে শাকিব খান অভিনেতার সামাজিক দায় থেকে সরে এসেছেন। খুবই জনপ্রিয় নায়ক হয়ে তিনি স্ক্রিনে এমন কিছু করেছেন যা দর্শকের মনে নেতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে বলে মনস্তাত্ত্বিকরা মনে করছেন; কিন্তু সিনেমার বর্তমান বাস্তবতায় সামাজিক দায়ের বিষয়টি এখন তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়- ব্যবসায়িক সফলতাই যেন এখন মূল বিচার্য বিষয়- দর্শক, এমনকি গণমাধ্যমের কাছেও।
সারা জীবন বেশিরভাগ সিনেমায় সামাজিক দায় মেনে সিনেমা করে শাকিব খান বুঝেছেন এখন সিনেমা হলে নতুন প্রজন্ম কি চায়? শাকিব খান বুঝে বুঝে সেগুলোই নিয়ে আসছেন। সেই সঙ্গে চরিত্র নির্বাচন, পোশাক, অভিনয় রীতি, নায়িকা নির্বাচন ইত্যাদির ফলে শাকিব খান “গুলিস্তান থেকে গুলশান” সব দর্শককেই সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন। নতুন শাকিব খান ভীষণ দ্রুতগতিতে প্রতিনিয়ত শাকিব খান যেন নিজেকেই নিজে অতিক্রম করছেন। এই অতিক্রমের হার ইঙ্গিত দেয়- শাকিব খানকে হয়তো খুব শিগগিরই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের সিনেমাতেও দেখা যাবে। তবে তার আগে শাকিব খানের হাতে থাকা দেশি সিনেমাগুলো তাকে আরও কতটা খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়- সেটি দেখার বিষয়। শাকিব খান নিজেকে নিজে অতিক্রম করার পাশাপাশি দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ঈদনির্ভর বাংলা সিনেমার একমাত্র রক্ষাকর্তা। শাকিব খানের সফলতার ওপর ভিত্তি করে এখন বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। তাই শাকিব খানের সফলতা ও ব্যর্থতার ওপর এখন নির্ভর করছে অনেক কিছু অন্তত যখন বাংলাদেশের সিনেমা হলের সংখ্যা চরম আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করেছে।
সৌরেন হাবীব: চলচ্চিত্র সমালোচক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে